দরদী: মানুষের বিপদে এই ভ্যান নিয়েই পৌঁছে যান স্বপন ঢালি। ছবি: সুজিত দুয়ারি।
পারিশ্রমিক নিতে চান না। জোর করে কেউ হাতে গুঁজে দিলে সেই টাকায় গরিব রোগীদের ওষুধ কিনে দেন। আর, বিপদের সময়ে করোনা-সংক্রমিতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ এলে ভ্যান আর ‘পাল্স অক্সিমিটার’ নিয়ে সোজা হাজির হন রোগীর বাড়ি। তিনি বাণীপুর ইতনা নতুন কলোনির বছর বেয়াল্লিশের ভ্যানচালক স্বপন ঢালি। করোনা-আবহে যাতায়াতের সঙ্কট-কালে করোনা-রোগীদের ভরসা জোগাচ্ছেন স্বপন।
সম্বল বলতে স্বপনের রয়েছে ব্যাটারি-চালিত একটি ভ্যান। আর রয়েছে বিপদে পড়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা। টিনের ভাড়া বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন স্বপন। এখন ভ্যানে যাত্রী পরিবহণ করেন না। গত বছর থেকে সেটি ব্যবহার করছেন করোনা-রোগীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কাজে। সাইকেলে চড়ে বাড়িবাড়ি ঘুরে লোহা-লক্কড় সংগ্রহ করেন স্বপন। তা বিক্রি করে যা রোজগার করেন তাতে ডাল-ভাতের সংস্থান হয়ে যায়। গত বছর করোনার ধাক্কায় যখন টালমাটাল রাজ্য, তখন থেকেই করোনা-রোগীদের নিজের ভ্যানে চাপিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন তিনি। বিনিময়ে টাকা দিতে এলে মুখের উপরে ‘না’ বলে দেন। স্বপন সঙ্গে রাখেন ‘পাল্স অক্সিমিটার’। প্রয়োজনে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের মাত্রাও মেপে দেন।
সম্প্রতি হাবড়ার বাণীপুরের এক মহিলার করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। পরিবারের সদস্যেরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়ির খোঁজ করেন। কিন্তু, করোনার উপসর্গ থাকায় কেউ রাজি হননি। ওই মহিলার ছেলে কৌশিক বসু তখন ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ গ্রুপের সদস্যদের থেকে স্বপনবাবুর নম্বর পান। ফোন করার পরেই নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর বাড়ি পৌঁছে যান স্বপন। তার পরে রোগীকে নিয়ে যান হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে। সেখানে করোনা-পরীক্ষার পরে ফের তাঁকে ভ্যানে চাপিয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেন। কৌশিকবাবুর কথায়, ‘‘মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে সমস্যায় পড়েছিলাম। স্বপনবাবু পারিশ্রমিক ছাড়াই মাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। জোর করে তাঁকে কিছু টাকা দিই। সেই টাকা দিয়ে তিনি গরিব অসুস্থ মানুষের জন্য ওষুধ কিনে দিয়েছেন। আমরা ওঁর কাছে কৃতজ্ঞ।’’ ওই এলাকার আর এক বাসিন্দা সুজয় চক্রবর্তী জানান, তাঁর শাশুড়ি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রতিবেশীরা কেউ এগিয়ে আসেননি। এসেছিলেন স্বপনবাবু। কৌশিক এবং সুজয়ের মতো আরও অনেকেই স্বপনবাবুর প্রতি কৃতজ্ঞ। তাঁরা জানান, ভরদুপুর হোক বা গভীর রাত—রোগী-পরিষেবায় সর্বদা প্রস্তুত স্বপন। তাঁর কাজের কথা শুনেছেন হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সুপার বিবেকানন্দ বিশ্বাস। তিনি স্বপনকে পিপিই কিট, গ্লাভস ও মাস্ক দিয়েছেন। সুপারের কথায়, ‘‘করোনা-পরিস্থিতিতে স্বপন ভাল কাজ করছেন। তাঁকে সহযোগিতা করছি। ওঁর কাজ অন্যদের প্রেরণা জোগাবে।’’ তবে ওই কাজ করতে গিয়ে স্বপন যাতে সংক্রমিত হয়ে না পডেন তার জন্য এলাকার ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ গ্রুপের সদস্যরাও তাঁকে পিপিই কিট দিয়েছেন। সেটা পরে রোগীদের হাসপাতাল, প্যাথোলজি সেন্টার বা নার্সিংহোমে নিয়ে যান তিনি।
তিন বছর ধরে ভ্যান চালাচ্ছেন স্বপন। এখনও পর্যন্ত প্রায় একশো করোনা-রোগীকে তিনি হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। অর্থকষ্টের কথা তুললে স্বপন বলেন, ‘‘দু’জনের সংসার। ঠিক চলে যাচ্ছে।’’
আর্থিক অনটনের কারণে দশম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি স্বপন। বই পড়া তাঁর অভ্যাস। স্বপন জানান, শেক্সপিয়ারের একটা লেখা পড়ে তিনি মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আপদে বিপদে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আনন্দ পাই। কেউ তো একজন আছেন, যিনি আমার কাজ দেখছেন।’’
স্বপনের ফোন নম্বর সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘রেড ভলান্টিয়ার্স’ গ্রুপের সদস্যদের থেকেও তাঁর নম্বর সংগ্রহ করেন সাহায্যপ্রার্থীরা। স্বপনের বন্ধু রামকৃষ্ণ মজুমদার বলেন, ‘‘বহু বছর ধরে স্বপন মানুষের আপদে বিপদে কাজ করছেন। আমরা ওঁকে সহযোগিতা করি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy