Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Titagarh

ফুচকা বেচেই জ্যোতির খোঁজে ইঞ্জিনিয়ার ভাই-বোন, টিটাগড়ে ‘হিট’ ৭ স্বাদের পানিপুরি

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, নামি সংস্থায় চাকরি করার পরেও লকডাউন পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করেছে ফুচকা বিক্রি করতে। সিঁড়ি ভেঙে চলেছেন ওঁরা।

ফুচকা বিক্রিতে ব্যস্ত জ্যোতির্ময়ী সাহা।

ফুচকা বিক্রিতে ব্যস্ত জ্যোতির্ময়ী সাহা। নিজস্ব চিত্র

কণাদ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২১ ১২:৪৭
Share: Save:

সিঁড়িভাঙা অঙ্কের সমাধান করতে শেখাটা যে জীবনে এতটা কাজে লেগে যাবে তা ভাবতে পারেননি ওঁরা দুই ভাই, বোনে। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে, নামি সংস্থায় চাকরি করার পরেও লকডাউন পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করেছে ফুচকা বিক্রি করতে। জীবন-অঙ্ক মেলাতে এখন সিঁড়ি ভেঙেই চলেছেন ওঁরা।

উত্তর ২৪ পরগনার টিটাগড়ের বিবেকনগরের বাসিন্দা দেবজ্যোতি সাহা এবং তাঁর বোন জ্যোতির্ময়ী। ঘটনার সূত্রপাত ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে। জ্যোতির্ময়ীর কথায়, ‘‘সময়টা গত বছরের মে মাস। দাদার বেসরকারি সংস্থার চাকরিতে বেতন অর্ধেক হল। কারণ করোনা তখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে .. আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে আর্থিক টানাটানি দেখা দিল। আমি ডিপ্লোমা করছি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে। স্বপ্ন ছিল এক দিন বি টেক করে বড় কোনও সংস্থায় কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কাজে যোগ দেব। কিন্তু হঠাৎ করে কেমন যেন কালো মেঘ নেমে এলো আমাদের পরিবারে।’’

এ তো গেল সঙ্কটের কাহিনি। যা লকডাউনের সময় অনেকের জীবনের সঙ্গেই মিলে যায়। কিন্তু যেটা অনেক সময় মেলে না, সেটা সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায়। দেবজ্যোতি এবং জ্যোতির্ময়ী কী ভেবেছিলেন সে সময়? সদ্য পেরিয়ে আসা সময়টাকে ধরলেন একুশের জ্যোতির্ময়ী। বললেন, ‘‘আমাদের মধ্যবিত্ত জীবনে সম্বল বলতে ছিল বাবার একটি মুদিখানার দোকান। দোকানটা গত বছর ধরে বন্ধ। সেখানেই খুলে ফেললাম ফুচকার দোকান। দিনটা গত বছরের ১৮ অক্টোবর। তার আগে অবশ্য মাসখানেক ধরে আমার খুড়তুতো, মামাতো ভাইবোনেরা মিলে নানা ধরনের ফুচকা বাড়িতে বানিয়েছি। দেখেছি কোনটা ভাল লাগছে। বেশ কয়েক রকম ফুচকা তৈরির পর, সেরা ৭টা নিয়ে আমরা ওই দোকান শুরু করি। তার মধ্যে চিকেন ফুচকা এবং বাংলাদেশি ফুচকা সকলের প্রিয়।’’

টিটাগড়ের সেই ফুচকার স্টল।

টিটাগড়ের সেই ফুচকার স্টল। নিজস্ব চিত্র

কিন্তু ফুচকার দোকানই কেন? মৃদু হেসে জ্যোতির্ময়ী বললেন, ‘‘দাদার যা পুঁজি ছিল তাতে ফুচকার দোকান ছাড়া আর কিছু হত না। প্রথম দু’তিন মাস কোনওরকম চালানোর পর, আমরা ভাবছিলাম হয়ত দোকানটা বিক্রি করে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের স্বপ্ন তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। আমরা ওই দোকানটাকে দাঁড় করাতেই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলাম।’’ বোনের কথায় সমর্থন জোগালেন দেবজ্যোতিও।

মধ্যবিত্ত পরিবারের ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া। ফুচকার দোকান দিতে কেউ বাধা দিল না? আত্মবিশ্বাসের সুরে জ্যোতির্ময়ীর উত্তর, ‘‘দাদা তো বরাবরই পাশে ছিল। মা-ও সমর্থন করেছে। প্রথমে বাবার বাধো বাধো ঠেকেছিল। তবে উনি নিজেই এখন ফুচকার দোকানে আমাদের সাহায্য করেন। আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এই উদ্যোগের কথা শুনে সমর্থন করেছিল। তবে অনেক বয়স্ক লোকজনকে সে সময় পাশে পাইনি। তাঁরা বলেছিলেন, ‘এ সব করিস না’। কিন্তু লকডাউন অন্য ভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। ওই সময়ে আর্থিক সঙ্কট আমাদের মধ্যবিত্ত তকমা ঘুচিয়ে দিয়েছে।’’ দেবজ্যোতি জ্যোতির্ময়ীর বাবা শ্রীদাম সাহার নিজেরও এক সময় মুদিখানার দোকান ছিল। আজ সেই দোকানই বদলে গিয়েছে ফুচকার স্টলে। মা সুশীলা সাহা আইসিডিএস কর্মী।

দাদা দেবজ্যোতির সঙ্গে জ্যোতির্ময়ী।

দাদা দেবজ্যোতির সঙ্গে জ্যোতির্ময়ী। নিজস্ব চিত্র

জ্যোতির্ময়ীর কথায়, ‘‘আমার এবং দাদার স্বপ্ন ছিল, ভাল চাকরি করব। সব মধ্যবিত্ত মানুষের যেমন এই স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্ন আমি ছাড়িনি। তবে যেখানেই যাই না কেন, এই ফুচকাওয়ালা হওয়াটা আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এখন অনলাইন খাবার সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। আগে ভাবতাম, পাশের বাড়ির লোক কী বলবে! এখন ভাবি, থেমে না থেকে সেই সময় ভাগ্যিস সাহস করে এগিয়ে গিয়েছিলাম।’’

সিঁড়িভাঙা অঙ্কটা যে এখনও চালিয়ে যেতে হবে তা বুঝতে পারেন ছাব্বিশের যুবক দেবজ্যোতি। আকণ্ঠ আত্মবিশ্বাস নিয়ে তিনি বলছেন, ‘‘এখনও আমি চাকরি করছি। তবে ফুচকার দোকান ছাড়ব না। এটার জন্যই পরিচিতি এবং ভালবাসা পেয়েছি। অনেকে সাহস জোগাচ্ছেন। এটাই আমাদের প্রেরণা।’’

জীবনে নতুন জ্যোতির সন্ধানে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন টিটাগড়ের দেবজ্যোতি এবং জ্যোতির্ময়ী।

অন্য বিষয়গুলি:

Panipuri Titagarh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy