গতিহারা: ইছামতীর এই দশা হয়েছে বনগাঁর বিস্তীর্ণ প্রান্তে। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের অভাবে স্রোত হারিয়ে ইছামতী নদী বহু দিন হল মৃতপ্রায়। নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দারা দীর্ঘ দিন ধরে নদীটি সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছেন। ২০০০ সালে বন্যার পর থেকে ওই দাবি আরও জোরদার হয়েছে। সাধারণ মানুষের দাবি মেনে কেন্দ্র ও রাজ্যের পক্ষ থেকে বিক্ষিপ্ত ভাবে নদী সংস্কারের কাজ যে কখনও হয়নি, তা নয়। কিন্তু কাজ যা হয়েছে, তাতে স্রোত সে ভাবে ফেরেনি। সংস্কার হয়নি নদীর উৎসমুখেরও।
এ বার ‘পশ্চিমবঙ্গ ইছামতী নদী সংস্কার সহায়তা কমিটি’র পক্ষ থেকে ফের উৎসমুখ-সহ নদীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দাবি তোলা হল। বৃহস্পতিবার বনগাঁ শহরে সংস্কার কমিটির বার্ষিক সম্মেলন হয়ে গেল। সেখানেই ইছামতীর পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের দাবি তোলা হয়। নদী বিশেষজ্ঞেরাও উপস্থিত ছিলেন। কমিটি সূত্রে জানা গেল, নদী বাঁচাতে এ দিন কয়েকটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে। প্রস্তাবগুলি হল— ইছামতীর উৎসমুখের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার, নদীটির বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ৩৬.০৫ কিলোমিটার পথের সংস্কার, কাবিলপুর থেকে বসিরহাট পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার নদীগর্ভ থেকে পলি তোলা এবং নদীবক্ষ থেকে প্রতি বছর কচুরিপানা সরানো।
কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, খাতায়কলমে নদিয়ার মাজদিয়ার পাবাখালিতে মাথাভাঙা নদী থেকে ইছামতীর উৎপত্তি। সেখান থেকে বসিরহাটের হাসনাবাদ পর্যন্ত দূরত্ব ২১০ কিলোমিটার। বাস্তবে অবশ্য ইছামতীর আজ কোনও উৎসমুখ খুঁজে পাওয়া যায় না। পাবাখালি থেকে ফতেপুর পর্যন্ত সাড়ে ১৯ কিলোমিটার নদীপথে কোনও জলই নেই। সেখানে নদীর মধ্যে এখন চাষের কাজ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গাড়িও চলে। ফতেপুর থেকে মোবারকপুর হয়ে নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফের দত্তফুলিয়ার কাছে নদী এ দেশে প্রবেশ করেছে। নদী সংস্কার কমিটি সূত্রে জানা গিয়েছে, দত্তফুলিয়া থেকে গাইঘাটার বর্ণবেড়িয়া পর্যন্ত নদীর অবস্থা খুবই শোচনীয়।
কমিটির কর্ণধার সুভাষ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যে নদীর উৎসমুখ নেই, তাকে মৃত নদী বলে। ইছামতীও তাই। এ নদীর প্রাণ ফেরাতে হলে উৎসমুখে ড্রেজিং করে পলি তুলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার জরুরি। এ দিনের সম্মেলন থেকে উঠে আসা প্রস্তাবগুলি কেন্দ্র ও রাজ্যে সরকারকে জানানো হবে। সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করার দাবিও করা হচ্ছে।’’
নদী বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, ইছামতীর তলদেশের একটি ‘কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান’ (পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা) তৈরি করা জরুরি। সেটি তৈরি হলে নদীর বাস্তব পরিস্থিতির প্রকৃত ছবিটা জানা যাবে। সেই মতো সংস্কারের কাজও এগোতে পারে। একদা স্রোতস্বিনী ইছামতী আজ কচুরিপানায় মুখ ঢেকেছে। নাব্যতা হারিয়ে প্রায় বদ্ধ জলাশয়ের চেহারা নিয়েছে সেটি।
বাম আমলে ২০০৫ সালে প্রায় ২৫ কোটি টাকা খরচ করে গাইঘাটার কালাঞ্চি সেতু থেকে স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়া সেতু পর্যন্ত নদীপথে পলি তোলা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, পলি তুলে নদীপাড়েই রাখার ফলে বর্ষায় সেই পলি ধুয়ে ফের নদীগর্ভেই চলে গিয়েছিল। যদিও সংস্কারের ফলে নদীপাড়ের বাসিন্দারা সাময়িক সুফল পেয়েছিলেন। সে বছর বন্যায় তাঁদের ভাসতে হয়নি। নদী মরে যাওয়ায় প্রায় প্রতি বছরই ভারী বৃষ্টিতে বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। খেতে জল ঢুকে যায়।
২০১০ সালে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে গাইঘাটার বর্ণবেড়িয়া থেকে কালাঞ্চি সেতু পর্যন্ত ২০.৪১ কিলোমিটার অংশে প্রায় ১৫ লক্ষ ঘন মিটার পলি তোলা হয়েছিল। কেন্দ্রের খরচ হয়েছিল ৩৯ কোটি টাকা। গভীরতা বেড়েছিল ২.৬ মিটার। তৃণমূল সরকারের আমলেও কালাঞ্চি সেতু থেকে স্বরূপনগরের টিপি পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার অংশে পলি তোলা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই নদী থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে কচুরিপানা তোলা হয়। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতেই ফের কচুরিপানায় মুখ ঢাকে নদী। একমাত্র অতি বর্ষা হলেই নদী কচুরিপানা মুক্ত হয়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্রোত না ফিরলে স্থায়ী সমাধান হবে না।
বনগাঁর মহকুমাশাসক কাকলি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বনগাঁ শহর এলাকায় ইছামতী থেকে কচুরিপানা তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিদ্যাধরী ড্রেনেজ ডিভিশন কাজটি করবে।’’ বনগাঁর প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ সম্প্রতি বারাসতে মুখয়মন্ত্রীর প্রশাসনিক সভায় নদীর উৎসমুখ সংস্কারের প্রসঙ্গটি তাঁর কাছে তুলেছিলেন। গোপাল বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ করবেন। কচুরিপানা তোলার জন্য ৭৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। শীঘ্রই কচুরিপানা তোলার কাজ শুরু হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy