ত্রাণের খাবারই ভরসা পরিযায়ী শ্রমিকদের।— ফাইল চিত্র
যাঁরা পরিযায়ী
হাজার হাজার মানুষ দুই জেলা থেকে কাজের খোঁজে যান বিভিন্ন রাজ্যে, বিদেশেও। প্রথম দিকে পুরোপুরি বন্দি ছিলেন সেই সব জায়গাতেই। ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল সামান্য জমানো টাকা। অর্ধাহারে, অনাহারে, ধারকর্জ করেও আর টানা যাচ্ছিল না। ঘরে ফেরার জন্য আকূল হয়ে পড়েন মানুষজন। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ফিরেও অনেকে মুখোমুখি হলেন আমপানের। ঘরদোর সব ভেঙে চুরমার। ঘরের ভাত পেটে পড়বে, এই আশায় যাঁরা ফিরেছিলেন ভিটেয়, সেই বাড়িঘরই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল কত মানুষের। সরকার বলেছিল, কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেবে গ্রামেই। একশো দিনের কাজ প্রচুর দেওয়াও হচ্ছিল। কিন্তু ভিন রাজ্যে বা বিদেশে রোজগার অনেকটাই বেশি। নিয়মিত কাজ মেলে। তাই পরিয়ায়ী শ্রমিকদের অনেকেই ফিরতে শুরু করলেন যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানেই। হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, সন্দেশখালি, ন্যাজাট, ক্যানিং, গোসাবা— সর্বত্রই প্রায় একই চিত্র।
নড়বড়ে শিক্ষা
যে ধাক্কা লেগেছিল গোটা শিক্ষাব্যবস্থায়, তা এখনও সামলে ওঠা যায়নি। শুধু শিক্ষাই নয়, সমবয়সীদের সঙ্গ থেকেও একটা বছর বঞ্চিত পড়ুয়ার দল। তাদের মানসিক বিকাশেও বড় ছাপ ফেলে গেল লকডাউন। শুরু শুরুতে ভাবা গিয়েছিল, অনলাইন ক্লাস করে সামলে নেওয়া যাবে পড়াশোনার দিকটা। শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে হয় তো কিছুটা সামাল দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে নেটওয়ার্কের সমস্যা প্রকট। তার উপরে লকডাউনে কাজ হারিয়ে রোজগার নেই বহু পরিবারে। নেটের বাড়তি খরচ সামলাবে কোথা থেকে। ফলে পিছিয়ে পড়তে থাকল প্রত্যন্ত গ্রামের বাংলা-ইস্কুলের ছেলেমেয়েরা। এরই মধ্যে সব কিছু তছনছ করে দিয়ে গেল আমপান। নেটসংযোগটুকুও নড়বড়ে হয়ে গেল বেশ কিছু দিনের জন্য। অনেক দিন স্কুলে না গিয়ে বহু পড়ুয়া শ্রমিকের কাজ শুরু করেছে, এমনও দেখা গিয়েছে। তাদের অনেকে এখনও পড়াশোনায় ফিরতে পারেনি। মাস দু’য়েক হল নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে পড়ুয়ারা অনেকে আসছে না বলেই খবর। কিছু কিছু স্কুলে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে পড়াশোনার ব্যবস্থা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বেড়েছে নাবালিকা বিয়ের সংখ্যা। আগে স্কুল খোলা থাকলে অনেক সময়ে সহপাঠিনীর বিয়ের খবর জানতে পেরে মাস্টারমশাই-দিদিমণিদের জানাতো পড়ুয়ারাই। খবর পৌঁছত পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। কিন্তু এখন সে সব বন্ধ। সমস্যা পড়েছে প্রশাসনও।
দুর্বিপাকে গৃহশিক্ষক
স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার কারণে এমনিতেই উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কয়েক হাজার গৃহশিক্ষক আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিলেন। এরই মধ্যে গত বছর আচমকা করোনা পরিস্থিতির কারণে লকডাউনের ঘোষণায় তাঁরা ভয়াবহ আর্থিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। রুজিরোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ছাত্র পড়ানো বন্ধ হওয়ায় গৃহশিক্ষকদের পরিবারের অনেকেই উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। আধপেটা খেয়ে, ধারদেনা করে সংসার চালিয়েছেন। সামাজিক পরিচয়ের কারণে লঙ্গরখানায় খাবারের লাইনে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করেছেন অনেকে। রাজ্য গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির সদস্য শুভ্র দাস বলেন, ‘‘লকডাউনের প্রথম তিন মাস আমাদের রুজিরোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। পরে দু’একজন করে ছাত্র পড়ানোর অনুমতি মিললেও অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠাননি। প্রায় আট মাস রোজগার কার্যত বন্ধ ছিল।
মুখ থুবড়ে পরিবহণ
পথেঘাটে বেরনো মানা। ফলে লকডাউনের শুরু থেকেই ধাক্কা খেল পরিবহণের ব্যবসা। রাস্তায় বেরোচ্ছে না বাস, টোটো, অটো, রিকশা, ভ্যান, ছোট যাত্রিবাহী গাড়ি। পরিবহণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক-মালিকদের রোজগার রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল। লকডাউন পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই বহু মানুষ ভিন রাজ্যে পাড়ি দিলেন কাজের খোঁজে। পেশা বদলে নিলেন অনেকে। হাসনাবাদ থেকে রূপমারি রুটের প্রায় ২২ জন অটো চালক এখন আর গাড়ি চালান না। যাঁরা চালাচ্ছেন, তাঁরা জানান, বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকেরা মোটা টাকার বিনিময়ে অটো রিজার্ভ করে সারা বছর যাতায়াত করতেন। সে সবও বন্ধ। বনগাঁর অন্যতম বড় ব্যবসা পরিবহণ। কয়েক হাজার মানুষ এই ব্যবসার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত। লকডাউনের ফলে ট্রাকের ব্যবসা মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য সব বন্ধ ছিল। দীর্ঘ দিন ট্রাক বসে থাকায় যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়েছে। মালিকদের অনেকেই ট্রাক কেনার কিস্তির টাকা শোধ করতে পারেননি। চালক-খালাসিদের বেতন দেওয়া সম্ভব হয়নি। ট্রাক মাকিকেরা জানালেন, তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছেন। মালিকদের কথায়, ‘‘এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও লকডাউনের আর্থিক ক্ষতি পোষাতে সময় লাগবে।’’
বেসামাল পর্যটন
প্রবল ধাক্কা সামলাতে হয়েছে পর্যটন শিল্পকে। সুন্দরবনে পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায় লকডাউনের পর থেকে। বিপাকে পড়েন হেমনগর থানা এলাকার একাধিক গেস্ট হাউস মালিক, মাঝি ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীরা। ডায়মন্ড হারবার, বকখালির পিকনিক স্পট জনমানবহীন হয়ে পড়ে। হোটেল এবং তাকে কেন্দ্র করে অনুসারি ছোট ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যায়। এ বছর গঙ্গাসাগর মেলাতেও পূণ্যার্থীদের ঢল নামেনি। প্রচুর ক্ষতি হয়েছে ব্যবসায়ীদের। মাস তিনেক ধরে পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে আবার ভিড় জমতে শুরু করেছে। তবে গত বছরের লোকসান এখনও সামলে উঠতে পারেননি অনেকেই।
শিল্পে সঙ্কট
বানতলায় এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ চর্মনগরীও লকডাউনে বিপর্যয়ের মুখে। এক বছর পরে এখনও স্বাভাবিক হয়নি ব্যবসা। বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলিতে এখনও লকডাউন চলতে থাকায় রফতানিতে গতি ফেরেনি। লকডাউনের আগে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হত। এখন তা কমে হয়েছে বছরে চার হাজার কোটি হয়েছে। সব মিলিয়ে পুরনো ছন্দে ফিরতে আরও অনেকটা সময় লাগবে বলে মনে করছেন বানতলা চর্মনগরীর ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা। চর্মনগরীতে প্রায় ২ লক্ষ শ্রমিক কাজ করতেন। যার মধ্যে অধিকাংশ শ্রমিক বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড-সহ অন্যান্য রাজ্যের। লকডাউনের সময়ে অধিকাংশ শ্রমিক নিজের বাড়িতে ফিরে যান। লকডাউন উঠে যাওয়ার পরেও প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক ফেরেননি। চর্মনগরীকে ঘিরে ভাঙড় সহ আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় কুটির শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট চামড়ার ব্যাগ তৈরির কারখানা। বরাত কমেছে সেই সব ছোট কারখানাগুলিতেও। এক কারখানার মালিক জানালেন, আগে ৭০-৮০ জন কারিগর দিয়ে কাজ করাতেন। এখন ১০-১৫ জনকে দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে। ফলতা অর্থনৈতিক অঞ্চলের সমস্ত কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। লকডাউন ওঠার পর একে একে কারখানা খুললেও বেশ কিছু কারখানা এখন প্রায় বন্ধ। কারণ, তাদের কাঁচামাল আসত বিদেশ থেকে। রফতানির সমস্যাও কাটেনি অনেকের।
রোজগারহীন
গণ পরিবহণের অনেক কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলেও লোকাল ট্রেন চলেনি দীর্ঘ দিন। যদি বা চলা শুরু হল ট্রেন, হকারদের প্ল্যাটফর্মে বসার অনুমতি দিল না রেল। ট্রেনে ওঠারও অনুমতি নেই তাঁদের। এই অবস্থায় বহু হকার পরিবার মুখ থুবড়ে পড়েন। একেই সামান্য আয়ে চলত সংসার। তারপরে মাসের পর মাস বন্ধ থেকেছে রোজগার। অনেকে পেশা বদলে নিয়েছেন। সমস্যায় পড়তে হয়েছে গৃহ সহায়িকাদের। লোকাল ট্রেন না চলায় অনেকে কাজে যেতে পারেনি। বিশেষ করে, ক্যানিং-ডায়মন্ড হারবার, বনগাঁ-বসিরহাট শাখা থেকে বহু মহিলা শহরে আসেন বাড়ির কাজ করতে। জীবিকা হারিয়েছেন তাঁরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও অনেকে কাজ ফিরে পাননি।
পা পড়ে না মাঠে
অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে মাঠের মানুষজনের। দিনের পর দিন খেলাধূলা থেকে দূরে থাকতে গিয়ে ফিটনেসে প্রভাব পড়েছে। যা ক্রীড়া জগতের মানুষের কাছে ভয়ানক ক্ষতি। লকডাউনে মাঠে-ময়দানে খেলাধুলা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রশিক্ষকেরা অনটনে পড়েন। বনগাঁর ফুটবল প্রশিক্ষক কাশীনাথ রুদ্রর ফুটবল কোচিং সেন্টার আছে। সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১১৫। লকডাউনের ফলে ৮ মাস কোচিং বন্ধ ছিল। রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। কোচিং করানোর পাশাপাশি তিনি খবরের কাগজ ফেরি করেন। তা-ও দু’মাস বন্ধ ছিল। লোকজন বাড়িতে কাগজ নেওয়া বন্ধ দিয়েছিলেন। ক্যানিং মহকুমার একমাত্র স্টেডিয়াম স্পোর্টস কমপ্লেক্সে অস্থায়ী কোভিড হাসপাতাল তৈরি হওয়ার কারণে এখনও খেলাধূলা বন্ধ। যাঁরা সেখানে প্র্যাকটিস করতেন, তা চালু হয়নি। সুইমিং পুলও বন্ধ দীর্ঘ দিন ধরে। জিম খোলেনি অনেক দিন। শরীরচর্চা যাঁরা করতেন, তাঁরা বাড়িতে চেষ্টা চালিয়েছেন কেউ কেউ। তবে অনেকেরই ফের ভুঁড়ি বেড়েছে লকডাউনে। নতুন করে জিম, সাঁতার শুরু করতে পারেননি অনেকেই। পাড়ায় পাড়ায় খেপ খেলে যাঁরা সংসার বা হাতখরচ চালান, লকডাউনে টুর্নামেন্ট দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়েছিলেন তাঁরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy