স্মৃতি: বাদুড়িয়ার মামুদপুর গ্রামে এখানেই ছিল আনিসুজ্জামানের পাঁচিল ঘেরা মাটির দেওয়ালের বসতবাটি। দেখাচ্ছেন খুড়তুতো ভাই আকরামুজ্জামান। ইনসেটে, ঢাকায় নিজের বাড়িতে লেখক
তখনও স্কুলছাত্র তিনি। বয়স মাত্র পনেরো। জড়িয়ে পড়লেন ভাষা আন্দোলনে। সালটা ছিল ১৯৫২। স্মৃতি কথায় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, অন্তরের আবেগের টানেই সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। আসলে ভাষা আন্দোলন বোধহয় তাঁর রক্তেই ছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ায় শেখ আব্দুর রহিম মুন্সি দেশভাগেরও বহু আগে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে এ রকমই এক আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, বাংলা ভাষাকে শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। আব্দুর রহিম মুন্সি ছিলেন আনিসুজ্জামানের ঠাকুরদা।
দেশভাগের সময়ে ভিটে ছাড়লেও শিকড়কে কোনও দিন ভোলেননি আনিসুজ্জামান। সে কথা বারবার লিখেছেনও তিনি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ শোকে মূহ্যমান তাঁর এ পার বাংলার পরিজনেরা। আনিসুজ্জামান কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলেও তাঁর আদি বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়ার মামুদপুর গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নিয়মিত। মামার বাড়ি ছিল বসিরহাটে। সেখানেও আসতেন। এলাকার প্রবীণ বাসিন্দাদের অনেকেই প্রয়াত। ফলে তাঁর জন্মস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বলেন, বসিরহাটের মামার বাড়িতে জন্ম হয়েছিল তাঁর। কারও দাবি, কলকাতায়।
তবে সে সব নিয়ে মোটেই চিন্তিত নন সদ্যপ্রয়াত অধ্যাপকের খুড়তুতো ভাই আকরামুজ্জামান। বাংলাদেশে সকলের কাছে তিনি ‘আনিস স্যার’ হলেও আকরামুজ্জামান বরাবর তাঁকে ‘বড়ভাই’ বলেই ডাকতেন। মামুদপুরের বাড়ির শাল-সেগুনের কড়ি-বর্গায় শেখ আব্দুর রহিম মুন্সির নাম এখনও খোদাই করা আছে। সাহিত্য চর্চা এবং সাংবাদিকতার জন্য এলাকায় আব্দুর রহিম মুন্সির নাম আজও স্মরণ করা হয়।
বাদুড়িয়ার যদুরহাটি বাজার থেকে দু’কিলোমিটার গেলেই মামুদপুর গ্রাম। দাদু রহিম শেখের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে এ দিন আকরামুজ্জামান বলেন, “দাদুর পরে বড়ভাই বাংলা ভাষার নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।” কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের আনিসুজ্জামানের ঢাকার বাড়িতে গিয়েছিলেন আকরামুজ্জামান। সে প্রসঙ্গে বললেন, “কত বড় মনের মানুষ ছিলেন বড়ভাই। মুজিবর রহমান থেকে ইন্দিরা গাঁধী সকলেই চিনতেন তাঁকে। অথচ বিন্দুমাত্র অহংভাব ছিল না। বার বার খোঁজ নিয়েছিলেন দেশের বাড়ির সকলের সম্পর্কে।”
বসিরহাটের টাকিতে সাহিত্য চর্চা করেন দীপক বসু। তিনি জানান, ১৯৪৫ সালে পিতামহের মৃত্যুর পরে আনিসুজ্জামান পরিবারের সঙ্গে কয়েক মাস মাহমুদপুরের বাড়িতে কাটান। ১৯৪৭ এ দেশভাগের তাঁর হোমিওপ্যাথ বাবা এটিএম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশে চলে যান। ১৯৫৯ সালে বসিরহাটে মামার বাড়িতে এসে বেশ কিছু দিন কাটিয়েছিলেন। দীপক বলেন, “এখানকার কেউ গেলে তিনি যে কী খুশি হতেন। আমি দু’বার তাঁর ঢাকার গুলশনের বাড়িতে গিয়েছি। সে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষক তিনি। একেবারে সাদামাঠা, মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন।”
গুলশনের বাড়ির চায়ের আসর আসর আজও দীপকের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। বললেন, ‘‘চা খেতে খেতে সাহিত্যের আলোচনা যেমন হয়েছে, তেমনই তিনি এখানকার খুঁটিনাটি বিষয়েও খোঁজখবর নেন। মৌলবাদ ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বহু ঘটনা শুনেছি তাঁর কাছে। গল্প মেতে গেলে আর সময়ের খেয়াল থাকত না তাঁর।”
আনিসুজ্জামানের মৃত্যুর খবর জানার পরে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন এ পার বাংলার কবি বিভাস রায়চৌধুরীও। বনগাঁ শহরের বাসিন্দা বিভাস গিয়েছিলেন আনিসুজ্জামানের ঢাকার বাসভবনে। সালটা ছিল ২০১৬। বাংলাদেশের একটি প্রকাশন সংস্থা বিভাসের একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে। বিভাস ওই কাব্যগ্রন্থটি আনিসুজ্জামানকে উৎসর্গ করেছিলেন। ওই বছর ২১ ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিভাস ঢাকায় যান। লেখকের বাড়িতেও গিয়েছিলেন। নিজের বইটি হাতে তুলে দেন। চা-নাস্তা খেতে খেতে গল্প হয় বিভাসদের। বিভাস বলেন, ‘‘কাব্যগ্রন্থটি পেয়ে উঁনি খুবই খুশি হয়েছিলেন। লেখার বিষয়ে উৎসাহ দিয়েছিলেন।’’
পরবর্তী সময়ে, ২০১৭ সালে ফের একবার কথা হয়েছিল দু’জনের। সে বারও লেখালেখি নিয়ে খোঁজ নিয়েছিলেন আনিসুজ্জামান। বিভাস বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে একজন অভিভাবককে হারালাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy