Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Kanyashree

শাঁখা-পলা খুলে হাজির কন্যাশ্রীর টাকা নিতে 

দেউলি এলাকার এক ছাত্রীর লকডাউনের মধ্যে বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়িও চলে যায় বলে প্রতিবেশীদের থেকে খোঁজ নিয়ে সে কথা জানতে পারেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রীর পরিবার কিছু দিন আগে স্কুলে তথ্য জমা দিতে এলে শিক্ষকেরা আপত্তি করেন। তখন স্থানীয় নেতারা স্কুলে এসে গন্ডগোল শুরু করেন বলে অভিযোগ।

ফাইল চিত্র

ফাইল চিত্র

নবেন্দু ঘোষ
হিঙ্গলগঞ্জ শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:২৬
Share: Save:

প্রধান শিক্ষক বিলক্ষণ জানেন, যে মেয়েটি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে দাবি করছে সে অবিবাহিত, মাস তিনেক আগেই বিয়ে হয়েছে তার। স্কুলে আসা বন্ধ করেছে মেয়েটি। অথচ, হাতের শাঁখা-পলা খুলে, মাথায় সিঁদুরটুকু না দিয়ে সেই মেয়েই হাজির কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকার দাবি নিয়ে। সঙ্গে পঞ্চায়েত প্রধানের দেওয়া শংসাপত্র, যাতে বলা হয়েছে, বিয়ে হয়নি তার। নিমরাজি হয়েও কন্যাশ্রী প্রকল্পের জন্য মেয়েটির নাম পাঠাতে বাধ্য প্রধান শিক্ষক। গত কয়েক বছরে এমন একাধিক অভিজ্ঞতার সাক্ষী হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদের একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। সকলেরই বক্তব্য, তাঁদের হাত-পা বাঁধা। ২০১৩ সালে চালু হওয়া কন্যাশ্রী প্রকল্পের মূল লক্ষ্যই ছিল নাবালিকা বিয়ে আটকানো। কিন্তু চোরাগোপ্তা নাবালিকা বিয়ে যে এখনও আকছার ঘটছে, সে কথা মানেন প্রশাসনের কর্তাদের একাংশও। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন গিয়ে শেষ মুহূর্তে বিয়ে বন্ধ করে। কিন্তু এই প্রবণতা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। অনেকে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও নানা রকমের শংসাপত্র নিয়ে এসে কন্যাশ্রীর টাকা দাবি করছে। এতে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন প্রধান শিক্ষকদের একাংশ। আঠারো বছরের আগে বিয়ে করে বা পড়াশোনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়েও অনেকে কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা তুলছে বলে অভিযোগ।

কন্যাশ্রী প্রকল্পের নিয়ম হল, অষ্টম শ্রেণিতে পড়তে হবে মেয়েটিকে এবং ১৩ বছর বয়স হতে হবে। সে সময় থেকে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধা পেতে শুরু করে ছাত্রীরা। প্রত্যেক বছর ১ হাজার টাকা করে পায়। ১৭ বছর পেরিয়ে গেলে নির্দিষ্ট সময়ে ওই ছাত্রীকে কিছু তথ্য জমা দিতে হয় স্কুলে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল, অবিবাহিত হিসাবে শংসাপত্র দাখিল করা। আর এখানেই কারচুপি হচ্ছে বলে অভিযোগ। যারা বিয়ে করে নিয়েছে, তারাও পঞ্চায়েতের প্রধানের থেকে অবিবাহিত শংসাপত্র পেয়ে যাচ্ছে বলে জানাচ্ছেন অনেক প্রধান শিক্ষক। সেই শংসাপত্র দাখিল করে কন্যাশ্রী প্রকল্পের সুবিধাও নিচ্ছে তারা। হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের এক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, “প্রতি বছর আমার স্কুল থেকে কমপক্ষে ১০-১৫ জন ছাত্রী বিয়ে করেও অবিবাহিত শংসাপত্র দেখিয়ে প্রকল্পের সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। কয়েক দিন আগেই রমাপুরের বাসিন্দা এক ছাত্রী দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তে পড়তে সতেরো বছরে বিয়ে করেছে। তারপরেও অবিবাহিত শংসাপত্র এনে জমা দিল আমার কাছে। আমি সব জেনেও কিছু করতে পারলাম না।” তবে এ কথা অস্বীকার করে হিঙ্গলগঞ্জের যোগেশগঞ্জ পঞ্চায়েতের প্রধান নগেন্দ্রনাথ বৈদ্য বলেন, ‘‘আমরা জানি, কার বিয়ে হয়েছে কার হয়নি। তাই যাদের শংসাপত্র দেওয়া হয়, জেনে নিয়েই দেওয়া হয়। অনেক সময়ে বিয়ে করে অবিবাহিত শংসাপত্র নিতে আসেন বাবা-মা। তবে আমরা দিই না।’’ হেমনগর থানা এলাকার একটি স্কুল সূত্রের খবর, মাধবকাটি এলাকার এক ছাত্রী একাদশ শ্রেণিতে উঠে আর স্কুলে যেত না। সম্প্রতি তার কন্যাশ্রী প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বের ২৫ হাজার টাকা পাওয়ার সময় হয়েছে বুঝে কিছু দিন আগে হঠাৎ একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। শিক্ষকেরা জানতে পারেন, মেয়েটির বিয়ে হয়েছে। কিন্তু মেয়েটি অবিবাহিত হিসাবে শংসাপত্র নিয়ে আসে পঞ্চায়েত থেকে। ফলে সত্যিটা জেনেও প্রধান শিক্ষকের কিছু করণীয় থাকে না।

দেউলি এলাকার এক ছাত্রীর লকডাউনের মধ্যে বিয়ে হয়। শ্বশুরবাড়িও চলে যায় বলে প্রতিবেশীদের থেকে খোঁজ নিয়ে সে কথা জানতে পারেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ছাত্রীর পরিবার কিছু দিন আগে স্কুলে তথ্য জমা দিতে এলে শিক্ষকেরা আপত্তি করেন। তখন স্থানীয় নেতারা স্কুলে এসে গন্ডগোল শুরু করেন বলে অভিযোগ। পুলিশ হস্তক্ষেপ করে। স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রধান অবিবাহিত শংসাপত্র দিলে স্কুল বাধ্য হয় প্রকল্পের সুবিধা দিতে। হিঙ্গলগঞ্জের এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেন, “কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা তো আমপানের টাকার মতো হয়ে গিয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কোনও কোনও ছাত্রীর পরিবার প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছে অনৈতিক ভাবে। আমরা জেনেও আটকাতে পারছি না। যেহেতু প্রধানেরা শংসাপত্র দিয়ে দিচ্ছেন, তাই আমাদের হাত-পা বাঁধা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালেও কাজ হচ্ছে না।’’

হাসনাবাদ ব্লকের এক প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘‘এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ায় যাতে বিঘ্ন না হয়, তাই ছাত্রীরা সিঁদুর না পরে, শাঁখা-পলা খুলে স্কুলে আসে।” হাসনাবাদের পাটলি খানপুর পঞ্চায়েত প্রধান পারুল গাজি বলেন, ‘‘গ্রামে কার মেয়ের বিয়ে হয়েছে বা হয়নি, তা জানা প্রধানের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই মেয়ের বাবা-মা লিখিত ভাবে যদি জানান, বিয়ে হয়নি তখন শংসাপত্র দিয়ে দিই।’’ সমস্যা সন্দেশখালি ব্লকেও রয়েছে, তা জানা গেল বিভিন্ন প্রধান শিক্ষকদের থেকে। বসিরহাটের মহকুমাশাসক বিবেক ভাসমি বলেন, ‘‘বিষয়টি জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখব।”

অন্য বিষয়গুলি:

Kanyashree Mamata Banerjee Hingalganj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy