মিনাখাঁয় বাঁধ ভেঙে গ্রামে ঢুকছে জল। নীচে, সাগরের গ্রামে জল ঢুকছে। ছবি: নির্মল বসু
ঠিক তিন মাস আগের কথা। আমপানের তাণ্ডবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ এলাকা। বুধবার রাত থেকে কোটালের জলোচ্ছাসে ফের নদী ও সমুদ্র বাঁধ ভাঙল কিছু জায়গায়। বাঁধ উপচেও প্লাবিত হয়েছে এলাকা। চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকেছে। ক্ষতি হয়েছে মাছ চাষের পুকুর। বেশ কিছু বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। অনেককে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিরাপদ জায়গায়।
কাকদ্বীপ মহকুমার বিভিন্ন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বুধবার রাক থেকেই জল বাড়ছে নদী-সমুদ্রে। সঙ্গে নিম্নচাপের জেরে টানা বৃষ্টিও চলছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার দু’দিন ধরে উপকূলবর্তী এলাকায় ভেঙেছে একের পর এক বাঁধ। বাসিন্দাদের সরিয়ে এনে ত্রাণ শিবিরে রাখার ব্যবস্থা করেছে প্রশাসন। আরও জল বাড়ার আশঙ্কায় নদী ও সমুদ্র বাঁধ লাগোয়া বাসিন্দাদের সরিয়ে আনা শুরু হয়েছে প্রশাসনের তরফে। এলাকায় পৌঁছে গিয়েছেন পঞ্চায়েত কর্মী, ব্লক প্রশাসন ও সেচ দফতরের আধিকারিকেরা।
বুধবার সকালে পাথরপ্রতিমার গোবর্ধনপুরে প্রায় ৫০০ মিটার সমুদ্র বাঁধ ভেঙে যায়। জলের তলায় চলে যায় প্রায় ২০০ বিঘা কৃষিজমি। বৃহস্পতিবার সাগর ব্লকের ধসপাড়া সুমতিনগর ২ পঞ্চায়েতের সুমতিনগর ও বঙ্কিমনগর গ্রামের কাছে মুড়িগঙ্গা নদীর প্রায় তিন কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা নোনা জলে প্লাবিত হয়েছে। ওই দু’টি গ্রামের সমস্ত ঘরবাড়ি কোমর সমান জলের তলায়। জলে ডুবে রয়েছে ধান, পান, আনাজ-সহ শয়ে শয়ে মাছ চাষের পুকুর। রাতে আরও জল বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে প্রশাসন। তাই স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে স্থানীয় স্কুলে, ক্লাবঘরে ত্রাণ শিবিরে আনা হয়েছে।
বাঁধ মেরামতের চেষ্টায় গ্রামবাসী। ছবি: দিলীপ নস্কর
সুমতিনগর ২ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান বিপিন পড়ুয়া বলেন, “নদী বাঁধ ভেঙে সব প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। অমাবস্যার ভরা কোটালে রাতে নদীর জল আরও বাড়বে। সমস্ত নদী লাগোয়া বাসিন্দাদের সরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমপানে কিছুটা ভাঙলেও এই দু’দিনের মধ্যে প্রায় ৩ কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। সেচ দফতরকে সবই জানানো হয়েছে।”
এ দিন সাফঘেরি গ্রামের কাছে সমুদ্র বাঁধ উপচে বহু কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে। একই অবস্থা ঘোড়ামারা পঞ্চায়েতেও। বটতলা নদী বাঁধ ভেঙে হাটখোলা, চুনপুড়ি, খাসিমারা গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এলাকায় কয়েকশো বিঘা কৃষিজমি, পানের বরজ জলের তলায়। নোনা জলে ডুবে রয়েছে পুকুর, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। সাগরের বোটখালি এলাকাতেও প্রায় ২০০ মিটার সমুদ্র বাঁধ ভেঙেছে। নামখানা ব্লকের মৌসুনি পঞ্চায়েতে সিগন্যাল পয়েন্টের কাছে বটতলা নদী বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন হয়েছে মৌসুনি গ্রাম। গোবর্ধনপুরে বৃহস্পতিবার আরও ভাঙন বেড়েছে। বেশ কিছু মাটির বাড়ি ভেঙে পড়েছে।
বাড়ি বাড়ি জল ঢুকে যাওয়ায় উঁচু রাস্তার উপরে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকেই। বাসিন্দারা জানান, আয়লার পর থেকেই বাঁধ বিপজ্জনক অবস্থায় ছিল। আমপানে সেই বাঁধের আরও ক্ষতি হয়। সেচ দফতর কোনও মতে তা মেরামত করে। সময় মতো পোক্ত বাঁধ তৈরি না হওয়ায় এই বিপত্তি বলেই মনে করছেন এলাকার মানুষ।
গোপালনগর পঞ্চায়েতের টুকরো গোপালনগর গ্রামের কাছে আমাপানে সোলেমারি নদীবাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছিল। সে সময়ে সেচ দফতর থেকে তড়িঘড়ি বাঁধ মেরামত করলেও ভরা কোটালে আবার নদী বাঁধ ভেঙে এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জল আটকাতে স্থানীয় বাসিন্দারা সেচ দফতরের অপেক্ষায় বসে না থেকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে নিজেরাই মাটি ফেলে জল আটকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা অশোক মাঁকর বলেন, “কয়েকটি জায়গায় বাঁধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে চাষের জমি ও মাছের পুকুর ক্ষতি হয়েছে। বেশ কিছু বাড়িতেও জল ঢুকে গিয়েছে। আমরা প্রশাসনের অপেক্ষায় বসে না থেকে নিজেরাই মাটি ফেলে জল আটকানোর চেষ্টা করছি।”
সাগরের বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বলেন, “সুমতিনগর ও বঙ্কিমনগরের কাছে মুড়িগঙ্গা নদীতে পাকা বাঁধ তৈরি হবে। তার জন্য ১৯ কোটি টাকা অনুমোদন হয়ে গিয়েছে। আবার ঘোড়ামারায় বটতলা নদীতেও বাঁধের কাজ চলছিল। মৌসুনি পঞ্চায়েতে সিগন্যাল পয়েন্টের কাছেও পাকা বাঁধ তৈরির অনুমোদন মিলেছে। কিন্ত বাঁধ তৈরির আগেই কোটালে জোয়ারের জল বেড়ে যাওয়ায় বাঁধগুলির ক্ষতি হয়েছে।” সেচ দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, জল নেমে গেলে বাঁধগুলি সারানোর ব্যবস্থা করা হবে।
বাসন্তী, গোসাবা-সহ জেলার অন্য নদী তীরবর্তী ব্লকগুলিতে অবশ্য সে ভাবে বাঁধ ভাঙেনি। আমপানের ফলে গোসাবা ও বাসন্তীর ভেঙে যাওয়া বাঁধগুলি বাঁধ আগেই মেরামত করেছে প্রশাসন। তবুও বেশ কিছু জায়গায় নদী বাঁধের খারাপ অবস্থা ছিল। কোটাল এবং নিম্নচাপের পূর্বাভাস থাকায় দিন তিনেক আগেই ব্লক প্রশাসন সেচ দফতরকে সঙ্গে নিয়ে সেই দুর্বল নদীবাঁধগুলি মেরামতের কাজ শুরু করে। গোসাবা ব্লকের চণ্ডীপুর, মন্মথনগর, বালি, শম্ভুনগর, কচুখালি এলাকায় নদীবাঁধ সারানো হয়। অন্য দিকে, বাসন্তী ব্লকের বিরিঞ্চিবাড়ি এলাকায় নদী বাঁধ মেরামত হয়। ফলে এ যাত্রায় বাঁধ ভাঙেনি। তবে চণ্ডীপুর এলাকায় বেশ খানিকটা জায়গায় নদী বাঁধে ধস নেমেছে। সেচ দফতর সেই ধস মেরামতির কাজ শুরু করেছে।
বাসন্তীর বিডিও সৌগত সাহা বলেন, “আবহাওয়ার পূর্বাভাস আগে থেকে পেয়েই যে জায়গায় নদী বাঁধ দুর্বল ছিল, সেই জায়গায় মেরামত করা হয়েছে। ফলে নতুন করে এ দিন বাঁধ ভেঙে গ্রাম প্লাবিত হয়নি।”
উত্তর ২৪ পরগনার উপকূলবর্তী কিছু এলাকায় বাঁধ ভেঙেছে। এ দিন সকালে মিনাখাঁর মোহনপুর অঞ্চলের মল্লিকঘেরি এলাকায় বিদ্যাধরী নদীর বাঁধ ৫০ ফুট এলাকা জুড়ে ভেঙে গ্রামের মধ্যে জল ঢুকে পড়ে। সন্দেশখালি ১ ব্লকের পার্সেমারি গ্রামে বাঁধ উপচে জল ঢোকে। বসিরহাটে ইছামতী নদীর জল উপচে বসিরহাট পুরাতন বাজারে দোকানপাট জলমগ্ন হয়ে পড়ে। আশপাশের বাড়ির মধ্যেও জল ঢুকে পড়েছে। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যায়নি। তবে বিভিন্ন দোকানের চাল, ডাল, নুন, আলু, তেল, পেঁয়াজ, সার নোনা জলে নষ্ট হয়ে যাবে বলেই মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। হাসনাবাদ পুরাতন বাজার, হিঙ্গলগঞ্জ বাজার-সহ সুন্দরবন অঞ্চলের একাধিক নদী সংলগ্ন হাট ও বাজারগুলিতে জল ঢুকেছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy