সচেতনতা: এ ভাবেই ভ্যানে বোর্ড টাঙিয়ে ঘোরেন বিমল। নিজস্ব চিত্র
ভ্যানের সামনে টাঙানো একটি বোর্ড। তাতে লেখা রয়েছে ‘সাপে কামড়ালে ওঝা-গুনিনের কাছে না গিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যান’—দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে ক্যানিংয়ে এ ভাবেই প্রচার চালাচ্ছেন ভ্যান চালক বিমল পাত্র।
দিনের পর দিন সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। সম্প্রতি অতীতেও ক্যানিং মহকুমায় একাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সাপের কামড়ে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে এ বিষয়ে সচেতনতা শিবির গড়ে সাধারণ মানুষকে সাপের কামড়ের চিকিৎসা সমন্ধে সচেতন করা হলেও, এখনও যে সব মানুষ সচেতন হয়েছেন তেমনটা নয়। মাঝেমধ্যেই খবর পাওয়া যায় সাপের কামড়ের পর রোগীকে ওঝা বা গুনিনের কাছে নিয়ে গিয়েছেন পরিবারের লোকজন। আর সঠিক চিকিৎসা পরিষেবা না পাওয়ার ফলে এই সব রোগীদের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে।
বছর সতেরো আগে ক্যানিংয়ের বাহিরবেনা গ্রামের বাসিন্দা বিমলের প্রতিবেশী এক যুবককে সাপে কামড়ায়। যুবকের পরিবার তাঁকে স্থানীয় একটি ওঝার কাছে নিয়ে যান। দু’দিন ধরে সেখানে চলে ঝাড়ফুঁক। ওঝার কেরামতি দেখতে বিমলও যান সেখানে। কিন্তু যত সময় গড়ায় ততই ওই তরতাজা যুবককে নেতিয়ে পড়তে দেখা যায়। কার্যত সকলের সামনেই তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরেও দেহে প্রাণ ফিরে আসবে বলে ওঝা নিদান দিলে কলার ভেলা তৈরি করে ওই যুবকের দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় মাতলা নদীতে। কিন্তু আর ফিরে আসেনি সে। এই বিষয়টি মনে দাগ কেটেছিল ক্লাস ফোর পাশ বিমলের। ওঝা, গুনিন যদি মানুষের রোগ সারিয়ে দেবেন তা হলে হাসপাতাল, চিকিৎসকরা কেন রয়েছেন? এই প্রশ্ন জাগে বছর চল্লিশের বিমলের মনে।
এরপরেই এ বিষয়ে বিভিন্ন মানুষের কাছে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন তিনি। অবশেষে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় ক্যানিংয়ের যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার কর্মীদের। সেখান থেকেই জানতে পারেন সাপে কামড়ালে সরকারি হাসপাতালেই রোগীকে নিয়ে যাওয়া উচিত। তাহলেই বাঁচবে প্রাণ। কারণ, সাপের কামড়ের একমাত্র ওষুধ ‘অ্যান্টি ভেনাম সিরাম’ বা ‘এভিএস’ শুধুমাত্র সরকারি হাসপাতালেই পাওয়া যায়। সেই শুরু, পথেঘাটে, নিজের কর্মস্থলে সর্বত্রই ‘সাপে কামড়ালে নিয়ে চলো হাসপাতালে’ এই বার্তা দিয়ে আসছে ভ্যান চালক বিমল। তিনি বলেন, “চোখের সামনে একজন তরতাজা যুবককে মরতে দেখেছি। সেটা আজও ভুলতে পারিনি। পরিবারের মানুষ একটু সচেতন হলেই বাঁচানো যেত ওকে। তাই সাপের কামড়ের চিকিৎসা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজ শুরু করি।’’ বিগত পনেরো বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করে চলেছেন তিনি। বহু মানুষ সচেতন হয়েছেন। তবে কাজ আরও বাকি। যেদিন সাপের কামড়ে এই এলাকা মৃত্যুহীন হবে সে দিন তাঁর চেষ্টা সফল হয়েছে বলে তিনি মনে করবেন।
শুধু ভ্যান সচেতনতার বোর্ড লাগিয়েই ক্ষান্ত নন এই যুবক। সময় সুযোগ পেলে মাঝেমধ্যেই বাংলার সাপের মানচিত্র নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন। কোনও সাপ বিষধর, কোনটিই বা বিষহীন সে সম্পর্কে সচেতন করেন তিনি। তা ছাড়া রাত বিরেতে কারও বাড়িতে সাপ ঢুকে পড়লে তাঁকে উদ্ধার করতে ডাক পড়ে বিমলের। মানুষজন অসুস্থ হয়ে পড়লেও নিজে ভ্যান নিয়ে সেখানে পৌঁছে যান। অসুস্থ রোগীকে উদ্ধার করে তাঁকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন এই যুবক। বিমলের এই কাজে খুশি তাঁর প্রতিবেশীরা।
এ বিষয়ে তার প্রতিবেশী আসমদ গাজি, হোসেন সর্দাররা বলেন, “ছোট থেকেই বিমল পরোপকারী। বহু বছর ধরেই ও মানুষকে সাপ সম্পর্কে ও সাপের কামড়ের চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতন করে চলেছে।’’
ভ্যান চালিয়ে সংসার চলে বিমলের। তবু সাপ ও সাপের কামড়ের চিকিৎসা সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার বর্তমানে অন্যতম সৈনিক বিমল। তাই সংগঠনের কাজে একদিকে যেমন এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে যান তিনি, তেমনি আশপাশের বিভিন্ন জেলাতে ও যেতে হয় তাঁকে। যুক্তিবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার সহ সম্পাদক নারায়ণ রাহা বলেন, “ছোট থেকেই বিমল খুবই পরিশ্রমী ও পরোপকারী। ও নিজের উদ্যোগেই মানুষকে সচেতন করার কাজ করছে। ওর প্রচেষ্টাকে আমরা সম্মান করি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy