অঙ্কন: কুণাল বর্মন।
‘কালো দেখে ভুলি নে আর, আলো দেখে ভুলেছে মন, আমায় তুমি ছলেছিলে, এ বার আমি তোমায় ছলেছি মা’— দস্যু রত্নাকর গাইছেন। কালী ছেড়ে তখন তিনি সরস্বতী-সাধনায়। রক্তপিপাসা ছেড়ে সারস্বত ব্রতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্মীকি-প্রতিভায়। বিসর্জনের দেবীও রক্ত চাইতেন।
সে দেবী রক্তপিপাসুর কালী। তিরিশ বছর বয়সে অকস্মাৎ স্বামীকে এবং বছর কয়েকের মধ্যে শিশুপুত্রকে হারানো এক যুবতীর বৃদ্ধা হওয়া পর্যন্ত আশ্রয় ছিলেন— রবীন্দ্রনাথ, গান এবং ঈশ্বর। কালীরূপে একটি ছোট্ট ফ্রেম। তার সামনে দাঁড়িয়ে বাগানের ফুল দিয়ে তিনি মঙ্গলকামনা করতেন সবার। পুত্রকে হারানোর পর আত্মজাকে হারানোর ভয় বাকি জীবন তাঁকে কুরে কুরে খেয়েছে। তাই মেয়ের জীবনের দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন এক কালীকে (সম্ভবত কালীঘাটের), বড় নাতনির দায়িত্ব ছিল মহীশূরের কালীর আর ছোটর দায়িত্বে ছিলেন ফিরিঙ্গি কালী। ফলে দিদার হাত ধরে কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর এবং ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি যাওয়ার অভিজ্ঞতা দুই নাতনিরই ছিল। ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি যাওয়ার উৎসাহের পিছনে অবশ্য আর একটি কারণও কাজ করত, ফেরার পথে অবধারিতভাবে দিদা কিনবেন গুঁইয়ের দোকানের ক্ষীরের চপ এবং খাঁটি ঘিয়ে ভাজা লাল-নীল বড় বড় বোঁদে, বাড়িতে সোনালি বড় কৌটোয় তা রাখা থাকবে।
দিদা বড় ভাল গাইতেন, রজনীকান্ত সেনের গান—‘কবে তৃষিত এ মরু ছাড়িয়া যাইব তোমার রসালো নন্দনে। কবে তাপিত এ চিত করিব শীতল তোমারি করুণা চন্দনে।’
বহু বহু বছর পরে মনে হচ্ছে, কোথাও কি মিলে যেত, রামপ্রসাদ সেনের ভালবাসার গান, যার পোশাকি নাম শ্যামাসঙ্গীত—‘পৃথিবীর কেউ ভাল তো বাসে না
এ পৃথিবী ভাল বাসিতে জানে না,...যেথা আছে শুধু ভাল বাসাবাসি,’
এ পৃথিবী ভাল বাসিতে জানে না, এমন ভালবাসার উচ্চারণ , ভাল বাসাবাসির মতো শব্দ উৎসারিত হয়েছে পূজা ও প্রেম থেকে, যার মূলে সেই শ্যামা। পাড়ার মণ্ডপে নরমু্ণ্ডমালা পরা, খাঁড়া হাতে দাঁড়ানো যে মেয়েটির মুখ বড় মিষ্টি। ডাকিনী, যোগিনীর বীভৎসতা তাকে মুছতে পারে না।
আসলে দেবদেবীকে উচ্চাসনে বসিয়ে রেখে পূজা করার প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক চক্র এক কথা, আর নিজের জীবনে তাকে মিশিয়ে নেওয়া আর এক। বা বাস্তব প্রয়োজনে। দমদমের আদি বড়কালীর (এখন তিনি উচ্চতায় ছোট হয়েছেন ) বিসর্জনের শোভাযাত্রা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন, তা দেখলে ভক্তি, প্রতিমার পবিত্রতার সংজ্ঞাগুলোই বদলে যেতে বাধ্য। বিরাট উচ্চতার প্রতিমা, ফলে শোভাযাত্রার সময়, প্রতিমার কাঁধে পা ঝুলিয়ে বসে বাঁশের লগি হাতে টেলিফোনের তার উঁচু করতে করতে যাচ্ছে দুই যুবক। দেবীর কাঁধে ওঠার আগে তারা নিশ্চয় ‘অপরাধ নিও না মা’, জাতীয় কথা বলত, আবার বলত না হয়তো, কিন্তু কালীর কাঁধে কেন পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে, তা নিয়ে কেউ কোনও দিন গেল গেল রবও তোলেনি, হায় হায়ও করেনি। বাস্তব দেবীকে নিজের মতো করেই গড়েপিটে নেয়। ভক্তিকেও। ভূতকেও।
দিদা বলতেন, ‘ঘোড়ারা ভূত দেখে, আমার পিসেমশাইয়ের ঘোড়া ভূত দেখেছিল।’ দেখতেই পারে। ঘোড়ারও তো মন আছে, ভয় আছে, দুর্বলতা আছে। মানুষেরই মতো। মায়ের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যে রিকশয় যেতে যেতে স্পষ্ট দেখলাম, উল্টো দিকের রিকশয় মা বসে আছে, পাশে ছোট্ট আমি। মুহূর্তের বিভ্রম। রিকশয় এক তরুণী মা ছিলেন, পাশে ছোট মেয়ে। মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মায়ের মৃত্যুরই পর একটি সংস্থার অফিসে গিয়েছি, বেরনোর সময়ে দ্বাররক্ষী বললেন, আপনি ...থাকেন?
হ্যাঁ।
চাকরি করেন?
হ্যাঁ।
আপনার দুটো মেয়ে আছে না?
না।
আপনি কলেজে পড়ান তো? সকালে ট্রেন ধরতে যেতেন মাঠের মধ্যে দিয়ে, দাদার সঙ্গে।
না তো।
বেরিয়ে আসার পর মনে হল—আরে ইনি তো আমার মায়ের কথা বলছেন।
একই এলাকায় থাকেন, এক সময় হয়তো নিয়মিত দেখেছেন মাঠ পেরিয়ে যাওয়া বাবা-মাকে, সেই স্মৃতি থেকে মায়ের মুখ বসানো মেয়েকে বলছেন সেই কথা। একেই তো বলে ফিরে আসা। এক পরিচিত খুব ভাল ভূতের গল্প বলত। একবার বলল, চার বন্ধুর সঙ্গে বসে গল্প করছে। একজনের খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী সম্প্রতি মারা গিয়েছে, তাকে বাকিরাও চিনত। কথক মেয়েটি বলল, ‘‘জানো, হঠাৎ দেখলাম আমার ওই বন্ধুর মুখটা বদলে যাচ্ছে, হঠাৎ ওই মৃত মেয়েটির মতো হয়ে গেল। পর মুহূর্তেই আবার স্বাভাবিক।আমি হতবাক। বন্ধুটি আমাকে বলল, ‘‘তুমি দেখেছো? ভয় পেয়ো না, She visits me very often।’’ আমরা তো এই ভাবেই দেখি প্রিয় মানুষের ভূত— চোখে, চেহারায়, ভঙ্গিতে। বিবাহিতা প্রেমিকাকে হারানোর পর এক যুবক বলেছিল, ‘‘ কী ভাল হত বলো, যদি ভূত বলে কিছু থাকতো, ওকে দেখতে তো পেতাম।’’
ভূত চতুর্দশীর রাতে বা অন্য অনেক দিনে, প্রহরে আমরা, স্মৃতিআক্রান্ত, শোকবিহ্বল আমরা দেখি, অনুভব করি। শুনি।
অশালীন শব্দবাজি আর ভক্তির ধর্ম-মত্ত উল্লাসের সাধ্য কি তাকে বোঝে?
সে কী করে বুঝবে হিম পড়া রাতে একটি একটি করে প্রদীপ, একটি একটি করে মোমবাতি সাজানোর আনন্দ। তারাবাতির নির্মল ফুলকি।
বাজি পোড়ানো মানেই তো ভ্রমর, তাই না?
মাঠে ফুটে উঠবে আলোর বাজি, ময়ূর, গাছ, আরও কত কী।
সেই বাজি পোড়ানো দেখার পর ফিরতে ফিরতে ‘খড়কুটোর’ ভ্রমর গাইবে, ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’।
যে ভ্রমর বলত, ‘আমরা বড় নিষ্ঠুর, ভালবাসা জানি না।’
অমল তাই ভেবেছিল, ‘ভালবাসা যে জানে, সে ভ্রমরের মতন। ভালবাসা জানলে ভ্রমরের মতন অসুখ করে, যে অসুখে রক্তর লালটুকু মরে যায়....।’
এ পৃথিবী ভালবাসিতে জানে না!
কৃতজ্ঞতা— খড়কুটো: বিমল কর
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy