নতুন বছরে, নতুন ক্লাসে উঠেছে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। তবে ফি বাবদ টাকা নয়, তাদের দিতে হবে একটি করে ফলগাছের চারা! স্কুল চত্বর ও তার আশপাশেই রোপণ করা হবে সেই চারাগাছ, ওই ছাত্রছাত্রীদেরই নামে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর ব্লকের ঘোড়াদল বাজারের কাছে জ্বালাবেড়িয়া গ্রামে সম্প্রতি এ ভাবেই পরিবেশ বাঁচানোর বার্তা দিলেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাতে সাড়া দিয়ে নারকেল গাছের চারা-সহ ছেলেমেয়েদের স্কুলে এনে ভর্তি করালেন অভিভাবকেরা।
সুন্দরবনের জ্বালাবেড়িয়া গ্রামের জ্বালাবেড়িয়া আদিবাসী অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে। বছর তিনেক আগেও স্কুলটির ভগ্নপ্রায় দশা ছিল। পড়ুয়া সংখ্যা ছিল পাঁচ। তবে গত কয়েক বছরে শুধু যে স্কুলের হাল ফিরেছে তা-ই নয়, পড়ুয়া সংখ্যাও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬। নার্সারি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়তে আসে আশপাশের গ্রামের খুদেরাও। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা নয়, গাছের পরিচর্যা, পরিবেশ সচেতনতা, প্লাস্টিক বর্জনের শিক্ষাও দেওয়া হয় পড়ুয়াদের।
ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে শোভন মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘অবৈতনিক স্কুল হওয়ায় অভিভাবকদের মধ্যে কিছুটা গয়ংগচ্ছ ভাব লক্ষ্য করছিলাম। গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই নিম্নবিত্ত, মূলত কৃষিকাজ করেন। তাই স্কুলের সঙ্গে তাঁদের আরও একটু একাত্ম করতে এবং পড়ুয়াদের পরিবেশের পাঠ পড়াতেই ফি হিসাবে গাছ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।’’ ৮৬ জন পড়ুয়ার অভিভাবকদের সম্প্রতি বলা হয়, এ বার থেকে নতুন ক্লাসে ওঠার দিনে একটি করে চারা আনতে হবে পড়ুয়াদের। তবেই ছেলেমেয়েরা নতুন ক্লাসে উঠতে পারবে, নতুন বইখাতাও হাতে পাবে। চারাগুলি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও রয়েছে খুদে পড়ুয়া ও তাদের অভিভাবকদেরই কাঁধে। শোভন জানান, পড়ুয়াদের পরিবারের অনেকে পেশাগত ভাবে বাঁশ বা কঞ্চি দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে থাকেন। তাঁদের বলা হয়েছিল, ক্লাসে ভর্তির ফি হিসাবে কঞ্চির বেড়া দিতে, যাতে তা দিয়েই চারাগাছগুলিকে রক্ষা করা যায়। এ ছাড়া, পড়ুয়াদের নামে গাছ লাগানোয় তাদেরও গাছটির প্রতি মমত্ববোধ থাকবে। আর ফলের গাছের প্রতি গ্রামবাসীদের মধ্যেও আগ্রহ, উৎসাহ থাকবে। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রথমে নারকেল গাছ দিয়ে শুরু করা হয়েছে। পরে অন্য ফলের গাছও ফি হিসাবে আনতে বলা হবে। বছরে দু’বার এই ফি নেবে স্কুল। ‘‘ভবিষ্যতে গাছগুলির দায়িত্ব দেওয়া হবে গ্রামের পরিবারগুলিকে। তাতে তাঁদেরও কিছুটা আর্থিক সাহায্য হতে পারে।’’— বলছেন শোভন।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক জগদীশ হালদার জানান, নতুন ক্লাসে ওঠার সময়ে অভিভাবকেরা গাছ নিয়ে এসে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করিয়েছেন। এতে তাঁদের উৎসাহ বেড়েছে। সময়ের আগে স্কুলে এসে পড়ুয়ারাও গাছগুলিতে জল দিচ্ছে, পরিচর্যা করছে। নিজের নামে গাছ লাগাতে পেরে প্রবল উত্তেজিত ওই খুদেরা।
আর অভিভাবকেরা? স্কুলে ভর্তি করাতে এসে পূজা রায় নামে এক অভিভাবক বলেন, ‘‘একটি গাছ, একটি প্রাণ। ছেলেমেয়ের নামে গাছ বসানো হচ্ছে বলে আরও ভাল লাগছে। আরও গাছ লাগানো হোক, পরিবেশ বাঁচুক, এটাই চাই।’’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)