অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র
পুজো যে আসছে, সেটা বুঝতে পারত ছোট্ট মেয়েটা। নীল আকাশে সাদা মেঘ, ধান খেতের পাশে কাশফুল দেখে নয়। সে তো সবাই বোঝে। সে বুঝত মাটির গন্ধ পেয়ে।
আমন চাষের বীজতলা তৈরির মাটি। বর্ষার সময়ের মাটির সেই গন্ধ লেগে থাকত মায়ের গায়ে। মা বলত, ‘‘মাটিই আমাদের মা।’’ ছোট্ট মেয়েটা বুঝতে পারত, এরপর কালো আকাশের রং নীল হবে। তাদের জমির আল বেয়ে বেয়ে হেঁটে গেলে দূরে দেখা যাবে কাশ।
শরতের সেই গন্ধ পেতে পেতেই সেই মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। এখন মাটির গন্ধ তার গায়েও। মা-বাবাকে চাষ করতে দেখেই তারও চাষের প্রতি ভালবাসা শুরু। সেই ভালবাসায় ভর করেই আজ উত্তর ২৪ পরগনার হাবড়ার আনখোলা গ্রামের তরুণী, সমাপ্তি মণ্ডল হয়েছেন ‘কৃষক রত্ন’।
পড়াশোনা করা লোক চাষ করে নাকি? সমাজের এমন নানা বাঁকা কথা, কটাক্ষকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে ভূগোলে স্নাতক সমাপ্তি চালিয়ে যাচ্ছেন চাষের কাজ। তাঁর বয়সি আর সবার পুজো-প্ল্যানে যেমন খাওয়া-ঘোরা-সেলফি থাকে, সমাপ্তির সেই সঙ্গে থাকে নিজের খেত দেখাশোনা করার কাজ।
‘‘দশভূজা দুর্গা বলতেই কিন্তু আমার নিজের মা, দিদিদের কথাই বেশি মনে পড়ে’’— বলেন সমাপ্তি। চাষবাস-সহ সংসারের সব কাজ যেন দশ হাতেই সামলাতেন তাঁর মা অঞ্জলি মণ্ডল, দিদি পুষ্প মণ্ডল। সমাপ্তির মনে পড়ে, তিনি তখন স্কুল পড়ুয়া। চাষবাস করে সংসার চালাতেন বাবা ভোলানাথ মণ্ডল। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সেই কাজই শুরু করেন মা। বাড়িতে তাঁরা ছয় বোন। সমাপ্তি সবার ছোট। মায়ের সঙ্গে কাজে যোগ দেয় দিদিরা। সমাপ্তি বললেন, ‘‘ওঁদের সঙ্গে মাঠে যেতে যেতে ছোট বয়সেই শিখে ফেলি বীজতলা তৈরি, চারা রোপণ, মই দেওয়া, লাঙল দেওয়ার কৌশল।’’
এখন কৃষি আধিকারিকদের পরামর্শে সমাপ্তি প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন চাষে। তাঁকে দেখে প্রযুক্তির ব্যবহারের ভয় কাটিয়ে এগিয়ে আসছেন আরও চাষিরা। তিনি আরও জানান, গত বছর মেশিনে ধান চাষ করেছেন তিনি। সাফল্যও পেয়েছেন। পলিমাঞ্চিং পদ্ধতিতে পটল চাষেও লাভের মুখ দেখেছেন। সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন সমাপ্তি। সম্প্রতি একটি পার্টটাইম কাজেও যুক্ত হয়েছেন। তবে চাকরি পেলেও চাষ চালিয়ে যাবেন সমাপ্তি। তাঁর কথায়, ‘‘নিজের হাতে করতে না পারলেও যুক্ত থাকবই। চাষ শুধু আমার পেশা নয়, ভালবাসাও।’’
ছোট থেকেই ভূগোল ভাল লাগত। পরে ভূগোল নিয়েই কলেজে ভর্তি হন সমাপ্তি। ক্লাস চলাকালীন উঠে দাঁড়িয়ে শিক্ষককে বলেছিলেন, ‘‘আমি নিজে হাতে চাষ করি।’’ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষক ও সহপাঠীরা।
তবে সমাপ্তি জানেন, তথাকথিত ভদ্র, শিক্ষিত হয়ে চাষের কাজ করাটা অনেককে অবাক করলেও ভারতবর্ষের বাস্তব তা নয়। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও দেশের ৭০ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে নির্ভরশীল কৃষির উপরে। অক্সফ্যামের রিপোর্ট বলছে, পূর্ণ সময়ের কৃষি-শ্রমিকদের ৭৫ শতাংশই নারী। দেশের উৎপন্ন ফসলের ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ অবধি তৈরি হয় সমাপ্তি, সমাপ্তির মায়েদের মতো হাজার হাজার নারীর শ্রমে।
পুরুষদের সঙ্গে সেই শ্রমের ক্ষেত্রেও বৈষম্য। অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী, চাষের মরসুমে একজন নারী যেখানে ৩৩০০ ঘণ্টা কাজ করেন, সেখানে একজন পুরুষ কাজ করেন ১৮৬০ ঘণ্টা। নারীর এই বর্ধিত শ্রমের উপযুক্ত পারিশ্রমিক তো মেলেই না, বরং সেই পারিশ্রমিক একজন পুরুষের তুলনায় অনেক কম। তার একটা কারণ দেশে জমির মালিকানা পাওয়ার ক্ষেত্রেও পিছনের সারিতে নারীরা। অক্সফ্যামের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে জমি রয়েছে এমন নারীর সংখ্যা মাত্র ১২.৮ শতাংশ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীদের বাবা, স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির জমিতে নিখরচায় শ্রম দিতে হয়।
দেবী-আরাধনার এমন প্রস্তুতি পর্বেই তাই সমাপ্তির মনে হয়, এই বাস্তবতাটা বদলানো খুব দরকার। চোখে ভাসে বছর চারেক আগে মহারাষ্ট্রে হওয়া কৃষকদের লং মার্চে যোগ দেওয়া সেই বৃদ্ধা চাষির ছবি।
সমাপ্তি বলেন, ‘‘ওঁর ফোস্কা পড়া রক্তাক্ত পায়ের ছবি আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল রোজ যে খাবারে আমরা পেট ভরাই, তার পিছনে আছে ওই দেবীদের রক্ত-ঘাম। ওঁরাই তো আসল দুর্গা।’’
—
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy