আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ। —ফাইল চিত্র।
সারাটি বছর তোমাকে দিলাম। আর জি করের মৃত ও ধর্ষিত তরুণী-চিকিৎসক, ২০২৪-এর অনেক আঁধার এবং অনেক আলো রাখা থাক তোমার জন্য।
হাসপাতালে কর্তব্যরত অবস্থায় তোমার বেঁচে থাকা শরীর লালসায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছে অবিকল মানুষের মতো দেখতে জীবের হাতে! সেই পাপের চিহ্ন দ্রুত মুছে ফেলতে চাওয়ার অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, তারাও জীবকুলে মনুষ্য বলে গণ্য!
আইন আইনের কথা বলছে। বিচার বিচারের পথে চলছে। ফল কী হবে এবং কবে, কে জানে! তবে বছরের শেষ প্রহরে এটা বোঝা গেল, ঘটনার মাস পাঁচেক পরেও অনেক কিছুই এখনও ঘন কুয়াশায় ঢাকা। সিবিআই-এর তদন্তের ফাঁসে প্রতীক্ষার প্রহর বরং দীর্ঘতর হচ্ছে। শাসক, বিরোধী, নাগরিক সমাজ, চিকিৎসকমহল— কারও পক্ষেই এই পরিস্থিতি মুখ বুজে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। প্রতিবাদ তাই পথেই ফিরেছে। যদিও দৃশ্যততা স্তিমিত।
কিন্তু কন্যা, তোমার নিথর দেহ প্রশ্ন রেখে গেল, চারপাশে যাদের সঙ্গে নিয়ে এই বেঁচে থাকা, তাদের কি সত্যিই আমরা চিনি? বোধ হয় না! বড় অসহ এই অনুভব। পাপের আঁধার যার পরতে পরতে। নিকষ অন্ধকারে পথ খুঁজে না-পাওয়ার অব্যক্ত যন্ত্রণা তোমাকে এ ভাবেই নিঃশেষ করেছে। আমাদের এই পৃথিবী তোমার জন্য জীবনের আলো দেখাতে পারেনি।
তবু এখানেই সব শেষ হয়ে যায় না। আমাদের চেতনায় ঘা মেরে আলো জ্বালিয়েছ তুমি-ই। তাই কান্না-চোখে প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছে। হাতে হাত ধরে এগিয়ে চলার প্রেরণা তৈরি হয়েছে। রাত-পথে মোমবাতির শিখা তার দিশা দেখিয়েছে। তুমি বুঝিয়ে দিয়েছ, ন্যায়ের দাবিতে রাজনীতি-বর্জিত, নেতাহীন সামাজিক আন্দোলনের প্রভাব বড় কম নয়। নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচল কালো। যেখানে পড়ল, সেখানে আলো। সেই আলো থাকল তোমার কাছে।
তবে এ শুধু একটি বছরের একটি ঘটনা বা প্রতিবাদের জয়-পরাজয় দিয়ে পরিমাপ করার বিষয় নয়। বঙ্গ-বিবেক চাইলে এই রকম আলোকদীপ অনির্বাণ হতে পারে। সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় এবং সুবিচারের দাবিতে বারবার দীপ্ত হতে পারে সেই আলোকবর্তিকা। সমস্বরে দৃপ্ত হতে পারে— ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ রব।
আসলে মত-পথ যার যার হলেও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘জাস্টিস’-এর দাবি নির্বিশেষ। এটা সবার কথা, সবার চাওয়া। অনৈক্য, ভেদাভেদ, দলের রাজনীতি সেখানে স্বাভাবিক মনুষ্যত্বের পরিপন্থী। আর জি কর-এ নির্যাতিতার প্রাণহীন দেহটি আমাদের সামনে সেই উপলব্ধির অন্যতম প্রেরণা হয়ে রইল। ২০২৪-এর এটি সবচেয়ে মূল্যবান বার্তা।
রাজনীতি ইদানীং এতটাই গতানুগতিক হয়ে গিয়েছে যে, তা আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে না। ২০২৪ সেখানে কিছুটা ব্যতিক্রমী বলা চলে। লোকসভা নির্বাচনের আবহে বছরটি শুরু হয়েছিল রাজনীতির তাপ গায়ে মেখে। এক দিকে, রাজ্যে সরকার ও শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ, সিবিআই-ইডি-র তৎপরতা, আদালতের ভূমিকা ইত্যাদি। অন্য দিকে, জাতীয় স্তরে বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে গড়া ‘ইন্ডিয়া’ জোটে বাংলার দল তৃণমূলের অবস্থান নিয়ে জট। আর ছিল রাজ্যের ভোটের হাওয়ায় অবিরত প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার হিসাব কষা।
মাঝ-বছরে ভোটে দেখা গেল, বাংলায় বিরোধী-জোট হওয়া দূরস্থান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল একাই লড়ে অপ্রতিরোধ্য। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি সঙ্কুচিত এবং কংগ্রেস ও সিপিএম কার্যত লোপাট। পরবর্তী ছ’মাসে, বিশেষত একটি লোকসভা ও দশটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে, বিজেপি-র স্বাস্থ্যহানি আরও স্পষ্ট। বাকিদের নিয়েআলোচনা আপাতত অর্থহীন। অর্থাৎ, রাজ্যে একা শাসকের ঊর্ধ্বগতি। অবশ্য দুর্বলতর বিরোধীপক্ষ গণতন্ত্রের পক্ষে কতটা সহায়ক, বাংলায় সেই জিজ্ঞাসার পরিসর এর ফলে আরও বাড়ল।
তবে সব কিছু ছাপিয়ে বর্ষশেষে রাজ্যের রাজনীতিতে আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ সমীকরণ। মমতার হাতে সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে তাঁর ভাইপো অভিষেকের দ্রুত উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে দলে আদি-নব্য টানাপড়েন চর্চায় এসেছে কিছুকাল। এ ক্ষেত্রে অনেক বিষয় মমতার ‘অভিপ্রেত’ হয়নি। বছর শেষের প্রশ্ন, তিনি কি তা হলে এ বার ‘রাশ’ টানছেন?
সম্প্রতি মমতা নিজেই জানিয়েছেন, দল এবং সরকার দুই-ই তিনি নিজে ‘দেখবেন’ একেবারে ব্লক স্তর পর্যন্ত। সংগঠনে এবং সরকারে রদবদলের পালাও শুরু হয়েছে। যদিও এই পর্বের শেষ কোন দিকে গড়াবে, তার স্পষ্ট উত্তর এই বছর মিলল না। তবে যেটুকু ইঙ্গিত ভেসে এল, আগামী দিনের রাজ্য-রাজনীতির জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সর্বজনীন আগ্রহের তো বটেই। অতএব ’২৪-এর বিদায়বেলাতেও বঙ্গ-রাজনীতি খানিকটা সরগরম!
রাজনীতির অনুষঙ্গেই এই বছর দুই বিশিষ্টের প্রয়াণ রাজ্যের নিরিখে বিশেষ গুরুত্ব দাবি করে। এঁদের একজন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অপরজন রতন টাটা। বামফ্রন্ট সরকারে জ্যোতি বসুর উত্তরসুরি বুদ্ধদেব ছিলেন এ-যাবৎ সিপিএম তথা ফ্রন্টের শেষ মুখ্যমন্ত্রী। দশ বছর সরকার চালিয়েছেন। ২০১১ সালে তাঁদের ভোটে হারিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হন তৃণমূলনেত্রী মমতা।
আর সেই নির্বাচনী-রণে মমতার অন্যতম নিশানায় ছিলেন রতন টাটা, যাঁকে সিঙ্গুরে গাড়ি-কারখানা গড়তে রাজ্যে আহ্বান করে এনেছিলেন ‘শিল্প-বন্ধু’ হয়ে ওঠা বুদ্ধদেব। সিঙ্গুরে ‘চাষের জমিতে’ মমতার কারখানা-বিরোধী আন্দোলন সেই সময় তৃণমূলের রাজ্যপাটের পথ অনেকখানি প্রশস্ত করেছিল। কিছু বিনিয়োগ করেও ফিরে যেতে হয়েছিল টাটাকে। পিছু হটেছিলেন বুদ্ধদেব। সেই ইতিহাস কারও অজানা নয়।
এক অদ্ভুত সমাপতনে বুদ্ধবাবু এবং রতন টাটা পরপর প্রয়াত হলেন মাত্র মাস দুয়েকের ব্যবধানে। অগস্টে বুদ্ধদেব এবং অক্টোবরে রতন। শারীরিক কারণে রাজনীতি থেকে স্বেছাবসর নিয়েছিলেন সিপিএমের শীর্ষনেতা বুদ্ধবাবু। তবে তাঁর গুরুত্ব সিপিএমের কাছে কমেনি। অন্য দিকে, মমতার সঙ্গেও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। স্মৃতিটুকু থাক।
এক একটি বছর এমন আসে, যা স্মৃতিভারে শুধু কাতর করে না, রিক্ত করে। ২০২৪ তেমনই। বছরের গোড়াতেই, ৯ জানুয়ারি, কণ্ঠশিল্পী উস্তাদ রাশিদ খানের অকালমৃত্যু দিয়ে তার সূচনা। ভারতীয় রাগসঙ্গীতের আকাশে এটি আক্ষরিক অর্থে নক্ষত্রপতন। তাঁর তুল্য প্রতিভার অকস্মাৎ চলে যাওয়া সহজে পূরণ হওয়ার নয়। তাঁর উত্থান ও প্রতিষ্ঠা কলকাতা থেকে ।কলকাতা হারাল তার ‘নিজের ছেলে’কে।
বছর ফুরনোর মাত্র পনেরো দিন আগে আমেরিকায় প্রয়াত হয়েছেন তবলাশিল্পী উস্তাদ জ়াকির হুসেন। স্থান-কালের গণ্ডিতে এঁরা সীমাবদ্ধ নন। তাঁর মৃত্যুও তাই আমাদের সকলের মনে অসীম শূন্যতার বোধ তৈরি করেছে। কলকাতার সঙ্গে, বাংলার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তার আরও বড় কারণ।
মৃত্যু অনিবার্য। তবু প্রয়াণের তালিকা দীর্ঘ হলে মন ভারী হয়ে থাকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতী আরও অনেকেরই জীবনাবসান হয়েছে ’২৪-এ। তাঁদের মধ্যে আছেন নামী অর্থনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বিবেক দেবরায়, বিশিষ্ট অভিনেতা-নাটককার মনোজ মিত্র, অভিনেত্রী অঞ্জনা ভৌমিক, শ্রীলা মজুমদার, অভিনেতা দেবরাজ রায়, চিত্র-পরিচালক উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, রাজা মিত্র, দেবকুমার বসু। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালি’ ছবিতে দুর্গা-র চরিত্র ছাড়া জীবনে কোনও দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াননি উমা দাশগুপ্ত। এই একটিতেই তিনি ‘অমরত্ব’ পেয়েছিলেন। এ বছর তাঁকেও হারাতে হল। উল্লেখ থাক সঙ্গীত পরিচালক ও শিল্পী অসীমা মুখোপাধ্যায়েরও।
শোক জয় করে এগিয়ে চলা জীবনের ধর্ম। ২০২৪-এ বাঙালির প্রাপ্তির ভান্ডার কিন্তু নেহাৎ অপূর্ণ নয়। বিজ্ঞান-সাধনায় বাঙালির কৃতিত্ব স্বীকৃত। ভাটনগর সম্মান ভারতে বিজ্ঞান-চর্চার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। এই বছর যুব-ভাটনগর পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ঊর্বশী সিংহ। যৌথ ভাবে ‘বিজ্ঞানশ্রী’ পুরস্কার পেয়েছেন আইআইএম কলকাতার অঙ্ক ও কম্পিউটার সায়েন্স-এর অধ্যাপক রাহুল মুখোপাধ্যায় এবং সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্স-এর নবকুমার মন্ডল।
ব্যাক্টিরিয়ার জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে কী ভাবে ‘বুদ্ধিমান’ করে তোলা যায়, সেই গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন সাহা ইন্সটিটিউটেরই বিজ্ঞানী সংগ্রাম বাগ ও তাঁর সহযোগীরা। এ বছরেই প্রথম এশিয়াবাসী হিসাবে আমেরিকার জিওলজিক্যাল সোসাইটির জর্জ বার্ক ম্যাক্সে ‘ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছেন খড়্গপুর আইআইটি-র ভুবিজ্ঞানী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়।
খেলার জগতে অনীশ সরকারকে এ বার বছরের বিস্ময় বলা যেতে পারে। চার বছরেরও কম বয়সে কৈখালির অনীশ পেশাদার দাবায় আন্তর্জাতিক ফেডারেশনের ‘রেটিং’ অর্জন করে নিয়েছে। এই রেটিং হল একজন দাবাড়ুর দৃঢ়তা ও স্থৈর্যের মাপকাঠি।
ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, টেবল টেনিসে বাংলার মেয়েদের সাফল্যও এ বার নজর কাড়ার মতো। একদিনের জাতীয় ক্রিকেটে হরিয়ানার বিরুদ্ধে ৩৯০ রান তাড়া করে বাংলার মেয়েদের জয় নজির গড়েছে। অনূর্ধ্ব ১৫-বছরের মেয়েদের জাতীয় ক্রিকেটেও বাংলা চ্যাম্পিয়ন। জুনিয়র জাতীয় ব্যাডমিন্টনে ডাবলস-এ সেরা আর্যমা চক্রবর্তী। সিঙ্গলস-এ তার দখলে ব্রোঞ্জ। কাজ়াখস্তানে ২৭-তম এশিয়ান টেবল টেনিসে মেয়েদের ডাবলস-এ দলগতভাবে ব্রোঞ্জ জয়ী সুতীর্থা মুখোপাধ্যায় ও ঐহিকা মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া ফুটবলের আইএসএল লিগ-শিল্ডে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান সুপার জায়ান্ট। প্রথমবার আই লিগ চ্যাম্পিয়ন মহমেডান।
সাহিত্য-ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাস এ বার নেই। তবে বাংলা সিনেমায় কিছু আছে। যেমন, ‘বহুরূপী’ ছবিটি ১৬ কোটি টাকার উপর ব্যবসা করে বছরের ব্লকবাস্টার। দর্শক পেয়েছে অনেক দিন পরে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির ‘অযোগ্য’। বছরের শেষ লগ্নে ‘খাদান’ দিয়ে চমক জাগিয়েছেন দেব।
বাংলা সিনেমার আর একটি বড় পাওয়া দর্শক। সিনেমা হলে দর্শক কমে যাওয়ার সাধারণ প্রবণতা বেশ কিছুকাল ধরে আলোচিত। এ বারের খবর, উত্তরবঙ্গের একটি জেলা শহরের মাল্টিপ্লেক্সে বাংলা ছবির রাত দুটোর শো হাউজ়ফুল!
সব ভাল, যার শেষ ভাল। কিন্তু মুক্তকণ্ঠে তা বলা যাচ্ছে কই? কয়েক মাস ধরে প্রতিবেশী বঙ্গভাষী দেশের অভ্যন্তরীণ প্রতিকূল পরিস্থিতি এখানেও নানা উদ্বেগ, অস্বস্তি ও চাপের কারণ হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের নীতি আছে, সকল দেশের ভৌগোলিক সীমানাও নির্দিষ্ট। কিন্তু মনের তো মানচিত্র নেই! আছে সদিচ্ছা। শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক, সম্প্রীতিতে আস্থা থাকুক— আমাদের বাংলার আপাতত এটাই চাওয়া।
নতুন সূর্য ‘আলো’ দাও। স্বাগত ২০২৫।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy