নুর হোসেন আনসারি।
ট্রেন প্রায় ঘাড়ের উপরে এসে পড়েছে, সে কথা চিৎকার করে বলছিল বন্ধুরা। কিন্তু ভিডিয়ো তোলানোয় মশগুল তরুণের কানে সে কথা যায়নি। রবিবার সন্ধ্যায় পুরুলিয়া শহরের ভূতগড়িয়া এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হল মহম্মদ নুর হোসেন আনসারির (১৬)। জখম তার বন্ধু সাদাব আলম। পুলিশের দাবি, চলন্ত ট্রেনের সামনে রেললাইনে হাঁটাহাঁটি করছিল নুর। আর মোবাইলের ‘টিকটক অ্যাপ’-এ তার ভিডিয়ো করছিল সাদাব।
পুরুলিয়া শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের চুনাভাটি এলাকার বাসিন্দা মহম্মদ নুর এই বছরই স্থানীয় মাদ্রাসা ইসলামিক হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক দিয়েছিল। বন্ধুদের মধ্যে মোবাইলের নানা কারসাজিতে দড় বলে তার পরিচিতি ছিল। ‘টিকটক’ নামে একটি ‘অ্যাপ’ ব্যবহার করে মোবাইলে ভিডিয়ো তোলার সময়ে নেপথ্যে গান জুড়ে দেওয়া যায়। তেমন ভিডিয়ো তৈরি করে ফেসবুকে পোস্ট করত নুর। এর আগেও রেল লাইনের কাছে চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে ভিডিয়ো তৈরি করে ‘আপলোড’ করেছে সে।
পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সাদাবের দাবি, রবিবার বিকেল ৪টে নাগাদ তাকে ডাকতে এসেছিল নুর। সাদাব বলে, ‘‘আগের মতো আবার চলন্ত ট্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে টিকটক ভিডিয়ো তৈরি করতে চাইছিল। আমার মোবাইলে বেশি সুযোগ-সুবিধা থাকায় ওর সঙ্গে যাওয়ার জন্য জোরাজোরি শুরু করে।’’ সাদাবের দাবি, রাস্তায় আরও দুই বন্ধু তাদের সঙ্গে জুড়ে যায়। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাদাবের কথায়, ‘‘কয়েকটা ভিডিয়ো তোলার পরে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে বাড়ি ফিরতে বলেছিলাম। কিন্তু নুর জেদ ধরেছিল, শেষ আরও একটা ভিডিয়ো তুলবে।’’
‘টিকটক’-এর বলি
• ৩১ জুলাই বিহারের হাজিপুরের বছর আঠারোর বিবেকের মৃত্যু হয় ‘টিকটকে’ ভিডিয়ো বানাতে গিয়ে। চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল সে। পা ফসকে লাইনে গিয়ে পড়ে।
• ২৩ জুলাই বিহারের দ্বারভাঙার বাসিন্দা ২৩ বছরের আফজল রেহানের মৃত্যু হয় জলে ডুবে। বন্যায় ভেসে যাওয়া জলাধারে ঝাঁপ দিয়েছিল সে। বন্ধুরা ভিডিয়ো করছিল।
• মাস খানেক আগে উত্তরপ্রদেশের যুবক দানিশ ও আশিক ভিডিয়ো বানাতে সেতু থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিল। দানিশকে স্থানীয়রা বাঁচাতে পারলেও ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ অটোচালক আশিক।
সাদাবের দাবি, আগে থেকে পুরুলিয়া-চাণ্ডিল শাখার রেল লাইনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল নুর। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঘটনাস্থলে থাকা নুরের আরও এক বন্ধু জানায়, তখন বরাভূম-পুরুলিয়া প্যাসেঞ্জার আসার সময়। পুরুলিয়া স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে এগিয়ে আসছে দেখে তারা চিৎকার করে নুরকে লাইন সরে যেতে বলে। ‘‘কিন্তু ট্রেনের আওয়াজে বোধ হয় আমাদের কথা শুনতে পায়নি,” বলে ওই বন্ধুটি।
রেল লাইন থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে ভিডিয়ো তুলছিল সাদাব। সে জানাচ্ছে, ট্রেনের ধাক্কায় নুর ছিটকে তারই উপরে এসে পড়ে। সাদাব ছিটকে গিয়ে পড়ে কিছুটা দূরের নর্দমায়। কিছু সময়ের জন্য জ্ঞান হারায়। এলাকার লোকজন তাদের উদ্ধার করে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। ততক্ষণে মৃত্যু হয়েছে নুরের।
‘টিকটক’ ভিডিয়ো তোলার নেশায় গত ৩১ জুলাই বিহারের হাজিপুরের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছিল। বিবেক নামে বিহারের হাজিপুরের বছর আঠারোর ওই ছেলেটি চলন্ত ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল। পা ফসকে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। সোজা গিয়ে পড়ে লাইনে। পুরুলিয়ার রবিবারের ঘটনার পরে চিন্তিত আদ্রা ডিভিশনের কর্তারাও। ডিসিএম আশিস মিশ্র বলেন, ‘‘মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। রেল কর্তৃপক্ষ সব সময়েই লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্বী না তোলা, মোবাইলে কথা বলতে বলে লাইন পার না হওয়ার মতো নানা বিষয়ে সচেতনতা প্রচার করে। কিন্তু অনেকেই এখনও সচেতন হয়নি।”
সোমবার সকালে ময়না-তদন্তের পরে পরিজনেরা নুরের দেহ নিয়ে ফিরে যান চুনাভাটিতে। পুরো পাড়ার ভিড় তখন ভেঙে পড়েছে তাদের বাড়ির সামনে। নুরের বাবা রফিক আনসারি শহরেরই একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন। বড় ছেলের মৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন তিনি। বলেন, ‘‘বিকেলে এক বার ফোন করেছিলাম। বলেছিল, স্টেশনে আছে। একটু পরে বাড়ি ফিরবে। পরে পাড়ার এক জন দুর্ঘটনার খবর দিল।’’ খবর পেয়েই হাসপাতালে ছুটে গিয়ে রফিক শোনেন, ছেলের মৃত্যু হয়েছে। অঝোরে কাঁদছিলেন নুরের মা ফারহানা বানু।
মৃত তরুণের বন্ধু মহম্মদ সাবির, শেখ সানু, শেখ নাজিররা জানাচ্ছে, ভাল ক্রিকেট খেলত নুর। মোবাইল কেনার পরে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’য় তার আসক্তি বেড়ে চলেছিল। ঝোঁক চেপেছিল ‘টিকটক ভিডিয়ো’ তৈরি করে ‘আপলোড’ করার। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া বলেন, ‘‘অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এই ভাবে ঝুঁকি নিয়ে যাতে পড়ুয়ারা টিকটক ভিডিও না তোলে সেই বিষয়ে আমরা স্কুল-কলেজে সচেতনতা প্রচারে জোর দেব।” ঘটনায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেছে পুরুলিয়া সদর থানার পুলিশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy