কিছু কিছু দলবদল ইতিহাস তৈরি করে দেয়। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২১ সালের ১১ জুন থেকে ২০২৩ সালের ২৯ মে। গত প্রায় দু’বছরে মুকুল রায় থেকে বাইরন বিশ্বাস যোগ দিয়েছেন তৃণমূলে। হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে গত সাড়ে ২৩ মাসে ১১টি গুরুত্বপূর্ণ যোগদান হয়েছে তৃণমূলে। কিন্তু তাদের মধ্যে সেরা কার দলদবল? বা কাদের?
রাজনীতিতে দলবদল অবশ্য নতুন নয়। জাতীয় রাজনীতিতে এমন যাওয়া-আসা কম হয়নি। অতীতে তো বটেই, সাম্প্রতিক কালেও হয়েছে। সে দিক থেকে এগিয়ে বিজেপি। সাধারণ ভাবে কোনও নির্বাচনের মুখে মুখে দলবদল হয়ে থাকে। নিজের দলের থেকে টিকিট না-পেয়ে অন্য দলে যোগ দেন রাজনীতিকদের একাংশ। আবার অন্য দলের আমন্ত্রণ পেয়েও দলবদলের ঘটনা ঘটে। এ রাজ্যে অবশ্য সেটা বড়সড় আকারে শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে।
বাংলার দারুণ ফলাফল হবে ধরে নিয়ে গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি তৃণমূল ভাঙানোর খেলা শুরু করেছিল। তাদের সবচেয়ে বড় ‘সাফল্য’ ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। যিনি বিজেপির টিকিটে জিতে রাজ্য দলের অন্যতম মুখ এবং বিরোধী দলনেতা। একই ভাবে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা মুকুল বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন ২০১৭ সালের শেষে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে। তবে শুভেন্দু বা মুকুলের বিজেপিতে যোগদানে কোনও চমক ছিল না। অনেক আগে থেকেই তৃণমূলের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব এবং বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত মিলেছিল।
কিন্তু মুকুলের তৃণমূলে ফেরা ছিল ‘চমক’। ১১ জুন সকালেও কেউ জানতে পারেননি যে, দুপুরে তৃণমূল ভবনে পুত্র শুভ্রাংশু রায়কে নিয়ে গিয়ে তৃণমূলে ফিরে যাবেন মুকুল। সেই যোগদান পর্বে হাজির ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
জুন মাসে মুকুলের যোগদান দিয়ে খাতা খোলে তৃণমূল। তার পরেই একে একে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েছেন বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তন্ময় ঘোষ, রায়গঞ্জের বিধায়ক কৃষ্ণ কল্যাণী, কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায় এবং বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। মাস কয়েক আগেই অভিষেকের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি বিধায়ক সুমন কাঞ্জিলাল। এই ছয়ের মধ্যে আবার সুমন ‘গুরুত্বপূর্ণ’। কারণ, বাকিরা সকলেই আগে তৃণমূলে ছিলেন। কিন্তু সুমন রাজনীতি শুরু করেন বিজেপি দিয়েই।
এর মধ্যেই বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরে আসেন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিধাননগরের প্রাক্তন মেয়র সব্যসাচী দত্ত। মুকুলের হাত ধরে ২০১৯ সালে বিজেপিতে-যাওয়া সব্যসাচী বিজেপির টিকিটে বিধাননগর বিধানসভা আসনে হেরে যান। তাঁকে তৃণমূলে ফিরতে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ২০২১ সালের ৭ অক্টোবর দরজা খোলে তৃণমূল। তাঁর যোগদানও ছিল ‘আড়ম্বরহীন’। বিধানসভায় গিয়ে তৎকালীন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বসে পুরনো দলে ফেরেন সব্যসাচী। আর রাজীবের যোগদান হয়েছিল ত্রিপুরায়। ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর ত্রিপুরা গিয়ে অভিষেকের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা পান রাজীব। জনপ্রতিনিধি না হলেও রাজ্য রাজনীতিতে এই দুই যোগদান প্রথম একাদশে জায়গা পাওয়ার মতো। কারণ, দু’জনকেই বিজেপি গুরুত্ব দিয়েছিল। দলের রাজ্য কর্মসমিতির সদস্য বানিয়েছিল।
তবে বিজেপির দুই সাংসদ যান তৃণমূলে। এক জন আসানসোলের বাবুল সুপ্রিয়, দ্বিতীয় ব্যারাকপুরের অর্জুন সিংহ। দু’জনের যোগদানেই ছিল চমক। বাবুল দু’বারের বিজেপি সাংসদ। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর মন্ত্রিসভায় রদবদল করলে বাদ পড়েন বাবুল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজনীতি ছাড়ার সিদ্ধান্ত জানান। তৃণমূলে যাবেন না বলেই ঘোষণা ছিল। কিন্তু ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে চমক দিয়ে অভিষেকের দফতরে গিয়ে তাঁর হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা নেন বাবুল। একই রকম চমক দিয়েছিলেন অর্জুন। ২০২২ সালের ২২ মে বিজেপি সাংসদ তৃণমূলে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলাম।’’ তবে তাঁর পুত্র ভাটপাড়ার বিজেপি বিধায়ক পবন সিংহ এখনও গেরুয়া শিবিরেই।
একাদশ চমক হলেন বাইরন বিশ্বাস। মাস তিনেক আগে সাগরদিঘি উপনির্বাচনে তৃণমূলকে প্রায় ২৩ হাজার ভোটে হারানো বাইরন ফিরেছেন তৃণমূলে। তিনিও ফিরলেন অভিষেকের হাত ধরে। হিসাব করলে দেখা যাবে এই পর্বে সব্যসাচী ছাড়া সকলেরই যোগদান হয়েছে অভিষেকের হাত থেকে তৃণমূলের পতাকা নিয়ে। সেই অর্থে সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি তৃণমূলের থেকেও বেশি অভিষেক।
এখন প্রশ্ন হল, কে কী ছেড়ে এসেছেন এবং বদলে কী পেয়েছেন। মুকুল তৃণমূলে এসে দলীয় কোনও পদ পাননি। পেয়েছিলেন বিধানসভায় পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যান পদ। অনেক বিতর্ক, আইন, আদালতের মাঝে সেটাও ছেড়ে দেন। দলের কোনও দায়িত্বও পাননি। এখন নাকি তিনি খাতায়কলমে যেমন, তেমনই মনে মনেও বিজেপিতে। যদিও সে স্বীকৃতি দিতে নারাজ বিজেপিই। মুকুল ছাড়া বাকি যে পাঁচ বিজেপি বিধায়ক তৃণমূলে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কৃষ্ণ কল্যাণী এখন পিএসি-র চেয়ারম্যান। বাগদার বিজেপি বিধায়ক বিশ্বজিৎ বনগাঁ জেলা তৃণমূলের সভাপতি। তৃণমূলের প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি হয়েছেন কালিয়াগঞ্জের বিজেপি বিধায়ক সৌমেন। পদ পেয়েছেন সব্যসাচীও। তিনি এখন বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন। রাজীব পদ না পেলেও দলের ত্রিপুরার সংগঠন দেখভাল করেন। কোনও পদ পাননি অর্জুন।
তবে এঁদের মধ্যে ধারেভারে এগিয়ে বাবুলই। তৃণমূলে যোগের দিন জানিয়েছিলেন, ‘প্লেয়িং ইলেভেন’ অর্থাৎ প্রথম একাদশে থাকতে চান তিনি। রাজনৈতিক মহলের ধারণা ছিল, তৃণমূলে যোগ দিয়ে সংগঠনে কোনও দায়িত্ব পাবেন বাবুল। সেটা পাননি। তবে কিছু অপেক্ষার পরে বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হয়েছেন। অনেক অবশ্য বলছেন, ‘চমক’ হিসাবে এগিয়ে বাইরন। কারণ, সাগরদিঘির স্মৃতি এখনও টাটকা। সোমবার বাইরনের যোগদানে অতীতের তুলনায় চমক ছিল বেশি। বিজেপি ৭৫ থেকে কমে ৬৯ হলেও এই যোগদান শূন্য থেকে এক হওয়া কংগ্রেসকে বিধানসভায় আবার শূন্য করে দিয়েছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy