শোকে ভেঙে পড়েছেন মৃতদের পরিজন। রবিবার নদিয়ার শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
ছোট্ট দু’কামরার বাড়ির সামনে বড়সড় একটা জটলা। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এক জন আঙুলের কর গুনছিলেন। ‘‘দুই ছেলে, এক ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, ভাইঝি, মা...’’
হিসেব শুনে পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা ডুকরে কেঁদে উঠে পাশে সরে গেলেন।
যাঁকে নিয়ে আলোচনাটা চলছিল, সেই নিভা বিশ্বাস তখন ছোট্ট বাড়ির এক চিলতে উঠোনে আছাড়িপিছাড়ি খেয়ে কেঁদে চলেছেন। বিলাপ করছেন বুক চাপড়ে। এক সময়ে থেমে গেল কান্না। আর দম নেই সেটুকুরও।
উত্তর ২৪ পরগনার বাগদা ব্লকের পারমাদন গ্রামের বছর পঁয়ষট্টির নিভা বিশ্বাস দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন দুই ছেলে, ভাই, ভাইয়ের মেয়ে, বোনের মেয়েকে। দুই বোন বিভা সরকার ও সুচিত্রা বিশ্বাসও মারা গিয়েছেন।
নিভার মা শিবানী মুহুরি অবশ্য মারা গিয়েছেন পরিণত বয়সেই। নব্বই বছরের বৃদ্ধার দেহ নবদ্বীপের শ্মশানে নিয়ে যেতে গিয়েই শনিবার রাতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন বাগদার গ্রামের কয়েক জন। তাঁদের মধ্যে নিভার পরিবারেরই ১০ জন। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে নিভাকে বলতে শোনা গেল, ‘‘এর পরে আমি কী নিয়ে বাঁচব। আর বাঁচার ইচ্ছে নেই।’’
সে কথা শুনে আঁচলে মুখ চাপা দিলেন গ্রামের মেয়ে-বৌরা। পাশে শুয়ে তখন কেঁদে চলেছেন নিভার এক বৌমা। স্বামীকে হারিয়েছেন তিনি। ‘‘কে যে কাকে সান্ত্বনা দেবে’’— দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শোনা গেল এক পড়শিকে।
শনিবার দুপুরে গোবরডাঙায় ছোট মেয়ের বাড়িতে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গিয়েছিলেন শিবানী। দেহ আনা হয় পারমাদনের বাড়িতে।
গ্রামের রীতি মেনে দেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল নবদ্বীপে। প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরের পথ। বনগাঁয় শ্মশান আছে। দূরত্ব মোটামুটি অর্ধেক। কিন্তু পারমাদনের লোকজন সৎকারের জন্য নবদ্বীপে যেতেই অভ্যস্ত। গ্রামের অনেকে এখন আফসোস করছেন, কাছাকাছির মধ্যে দাহ করলে হয় তো এত বড় বিপত্তি ঘটত না।
শনিবার রাত পৌনে ১২টা নাগাদ দেহ নিয়ে গ্রাম থেকে গাড়ি ছেড়েছিল নবদ্বীপের দিকে। ঘণ্টাখানেক পরেই দুর্ঘটনার খবর আসে। পিছনের একটি গাড়িতে ছিলেন অভিজিৎ বিশ্বাস। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটা অন্য রাস্তা ধরেছিলাম। হঠাৎ ফোন এল, অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। কত বড় অ্যাক্সিডেন্ট, তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। হাঁসখালি গিয়ে দেখি, গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সব লোক। এ দিক ও দিক ছিটকে পড়ে আছে অনেকে। ততক্ষণে পুলিশ এসেছে। আমাদের দিশাহারা লাগছিল। গ্রামের অনেককে ফোনে খবর দিতে শুরু করি।’’
নিভার দুই ছেলে অমর ও অমলেন্দু বিশ্বাস মারা গিয়েছেন। দু’জনেরই ছোটখাট দোকান। অমলেন্দু বাড়ির একমাত্র রোজগেরে সদস্য। মেয়ে কলেজে পড়ে। ছেলে ছোট। অমলেন্দুর স্ত্রী মল্লিকা জানান, স্বামীর শ্মশানে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। আত্মীয়েরা বলায় রাজি হন। অমর ও তাঁর স্ত্রী বাসন্তীর এক ছেলে, এক মেয়ে। ছেলে পড়ে অষ্টম শ্রেণিতে। মেয়ে কলেজে। উঠোনে চিৎকার করে কাঁদছিলেন মল্লিকা। বললেন, ‘‘ছেলেমেয়ে দু’টোকে কী করে মানুষ করব, কিছুই মাথায় আসছে না।’’
অমর-অমলেন্দুর বাবা প্রভাস দুর্ঘটনার খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। দুই ছেলের দেহ দেখে ঠিক থাকতে পারেননি। বুকে ব্যথা শুরু হয়। তাঁকেও শক্তিনগর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
নিভার ভাই বৃন্দাবন মুহুরি ও তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী মারা গিয়েছেন দুর্ঘটনায়। তাঁর আরও দুই ভাই স্বপন ও বিশ্বনাথ শক্তিনগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
স্বপনের মেয়ে শ্রাবণীর মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনায়। বিয়ের দেখাশোনা চলছিল তরুণীর। তাঁর বান্ধবী মঞ্জু বলেন, ‘‘শনিবার সকালেও কথা হল। পুজোর জন্য দুর্বা তুলছিল ও। রাতে শুনি সব শেষ।’’ দু’জনে এক সঙ্গে পড়াশোনা করেছেন। খেলাধুলা করেছেন। টিফিন ভাগ করে খেয়েছেন ছেলেবেলায়। কাঁদতে কাঁদতে সে সব স্মৃতিকথা বলে চলেছিলেন মঞ্জু।
স্বপনের ছেলের ঘরের নাতনি পাঁচ বছরের অনন্যাও মারা গিয়েছে। অত ছোট শিশুকে কেন রাতবিরেতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সে কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেল অনেককেই।
নিভার দাদা বিশ্বনাথ হাসপাতালে ভর্তি। স্ত্রী নমিতা, মেয়ে দীপালি বিশ্বাসরা খোঁজ পাচ্ছিলেন না তাঁর। দীপালির মেয়ে প্রিয়াঙ্কা চলে যান হাসপাতালে। সেখানে দেখতে পান বাবাকে। ভিডিয়ো কলে মাকেও দেখিয়েছেন। তারপরে কিছুটা স্বস্তি ফেরে পরিবারে।
পাশেই থাকেন সুকুমার বিশ্বাস। পেশায় ভাগচাষি। গ্রামে হরিনাম সংকীর্তনের দলে ছিলেন। এলাকায় কেউ মারা গেলে ওই দলের লোকজন নাম সংকীর্তন করতে শ্মশানযাত্রায় শামিল হন। সুকুমারও গিয়েছিলেন সে কারণে। আর ফেরেননি। তাঁর এক ছেলে সুমিতের সবে কলেজে পড়া শেষ হল। স্ত্রী শ্যামলী বার বার জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। বিজয় মণ্ডলও সংকীর্তন দলের সদস্য। ছেলে দেবাশিস জানালেন, বাবা সচরাচর দূরে কোথাও যেতে চাইতেন না। পড়শিরা ডাকাডাকি করায় গেলেন। আর ফিরলেন না।
নিভার বোন কাঞ্চনের মেয়ে অশোকা রায় থাকতেন নদিয়ার বীরনগরের চণ্ডীতলায়। দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন তিনিও। দুই মেয়ে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী অঙ্কিতা এবং চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী অন্বেষাকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি। তারা জানে, জখম হয়েছেন মা। বার বার দু’জন জানতে চাইছে, মা কেমন আছে।
রবিবার সকাল থেকে পারমাদনে এসেছিলেন বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করেন তিনি। পরে গ্রামে আসেন বনগাঁ উত্তরের বিধায়ক অশোক কীর্তনিয়া, বনগাঁ দক্ষিণের বিজেপি বিধায়ক স্বপন মজুমদার, গাইঘাটার বিধায়ক সুব্রত ঠাকুর। পরিবারগুলির সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় ওসি উৎপল সাহা, এসডিপিও সুকান্ত হাজরাদের।
সন্ধের পরে বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক কয়েক জনের দেহ নিয়ে গ্রামে আসেন। সারি সারি দেহ রাখা হয় এক জায়গায়। ভিড় ভেঙে পড়ে সেখানে। চোখের জল সামলাতে পারছিলেন কেউ। মৃতদের সকলের পরিবারকে ইতিমধ্যেই রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ২ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়।
গ্রামের কারও ঘরেই কার্যত হাঁড়ি চড়েনি এদিন। কবিতা মণ্ডল নামে এক মহিলার কথায়, ‘‘রান্না করে কী হবে, খাবেটা কে? জলটুকুও তো গলা দিয়ে নামছে না!’’
সহ প্রতিবেদন: সম্রাট চন্দ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy