Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

স্পনসর না পেয়ে জৌলুস হারাচ্ছে সাবেকি পুজো

পনেরো বছর আগের কথা। বোসপুকুরের ভাঁড়ের মণ্ডপের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ভিড় টেনেছিল পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট। তার পর থেকে উত্তর ও মধ্য কলকাতার ভিড়ের অনেকটাই টেনে নিত পোস্তার ওই পুজো। ওই পুজো থেকেই শহরে নাম করেছেন বহু শিল্পী।

দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট।

দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট।

সৌভিক চক্রবর্তী ও মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:২৬
Share: Save:

পনেরো বছর আগের কথা। বোসপুকুরের ভাঁড়ের মণ্ডপের সঙ্গে টক্কর দিয়ে ভিড় টেনেছিল পোস্তার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট। তার পর থেকে উত্তর ও মধ্য কলকাতার ভিড়ের অনেকটাই টেনে নিত পোস্তার ওই পুজো। ওই পুজো থেকেই শহরে নাম করেছেন বহু শিল্পী।

পিকনিক গার্ডেন সুনীলনগরকে বলা হত, পুজো ময়দানের ভবানীপুর-উয়াড়ি। গড়ের মাঠে যেমন তারকা খেলোয়াড়েরা ওই সব ক্লাব থেকে উঠে আসত, তেমনই সুনীলনগর থেকেও পুজোয় উঠে এসেছেন বহু তারকা শিল্পী।

এ বছর ৫০ বছর হল দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের পুজো। কিন্তু গোবরের প্রলেপ দেওয়া মণ্ডপ কিংবা ডোকরা শিল্প দিয়ে তাক লাগানো সেই জৌলুস কোথায়! থিমের বাহার ছেড়ে সাবেকি পুজোয় ফিরে যেতে হয়েছে তাদের। সুনীলনগর নামী শিল্পী পায়নি। পূর্ব মেদিনীপুরের ডেকরেটরকে দিয়ে ‘শতদলে শতরূপা’র থিম সাজাতে হয়েছে তাদের। কলকাতার প্রথম বারোয়ারি পুজো শ্যামপুকুর সর্বজনীনেরও অবস্থা অনেকটা এক। ‘‘স্পনসরের অভাবেই থিম ছেড়ে সাবেকি পুজোয় ফিরতে হয়েছে,’’ বলছেন শ্যামপুকুরের এক পুজো-কর্তা।

স্পনসর কিংবা প্রভাবশালী কর্তা না-থাকায় যে ভাবে গড়ের মাঠের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত ক্লাবগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সে ভাবেই পুজোর ময়দানেও ধুঁকছে বেশ কিছু সাবেকি ক্লাব। তবে আজও পুজো এলেই উঠেপড়ে লাগেন ক্লাবের কর্তারা। হাজারো সমস্যা কাটিয়ে পাড়ায় পাড়ায় জ্বলে ওঠে উৎসবের আলো।

দর্পনারায়ণের পুজো-কর্তা বিকাশ দে-র আক্ষেপ, শহরের পুজোয় এখন রাজনীতির রমরমা। যে সব পুজোয় রাজনৈতিক নেতারা জড়িত, তাদের স্পনসর পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। রাজনীতির বাইরে থাকা পুজোগুলি সে ভাবে কল্কে পায় না। ‘‘পুজোকে ঘিরে যে দিন থেকে ব্যবসা শুরু হয়েছে সে দিন থেকেই কদর কমেছে আমাদের,’’ বলছেন বিকাশবাবু। একই কথা উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার আরও কিছু পুজোর কর্তাদের। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক সংস্রব থাকলে স্পনসর বা অনুদান জোগাড় করা অনেক সহজ। না-থাকলে কার্যত মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। কম টাকায় নামী শিল্পীরাও কাজ করতে চান না।

সুনীলনগর সর্বজনীন

পুরনো হলেও মধ্য কলকাতার কপালিটোলা লেন, আরপুলি লেনের উত্তরণ কিংবা উত্তর কলকাতার জেলিয়াটোলা সর্বজনীন, হরি ঘোষ স্ট্রিটের পুজো আশপাশের নামী পুজোর জৌলুসে কিছুটা হলেও চাপা পড়েছে। এ সব পুজো-কর্তাদের অনেকেরই মনে ইচ্ছে, জৌলুস যদি আর একটু বাড়ানো যায়। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয় না। ‘‘বড় হওয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাধ্য নেই,’’ বলছেন কপালিটোলা সর্বজনীনের সম্পাদক দিব্যেন্দু দত্ত।

দক্ষিণ কলকাতার পুরনো বাসিন্দারা জানেন, এক সময় আদি বালিগঞ্জ, বাঁশদ্রোণী রায়নগরের পুজোর জৌলুস কেমন ছিল। তরুণ বয়সে পুজো ঘোরার স্মৃতি নিয়ে গান বাঁধতে গিয়ে এক বাঙালি গায়ক তো আদি বালিগঞ্জকে তুলে এনেছেন গানের লাইনেও! কিন্তু বাস্তবে শহরের বড় ক্লাবের চোখ ধাঁধানো জৌলুসে অনেকটাই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে পুরনো এই সব পুজো। সুনীলনগরের এক পুজোকর্তা বলছেন, ‘‘বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে খায়, তেমনই অবস্থা হয়েছে আমাদের। ঘর থেকে টাকা দিয়ে আর তো পেরে উঠছি না।’’ হরি ঘোষ স্ট্রিট ১৭ পল্লির সম্পাদক সুরজিৎ মুস্তাফি বলছেন, ‘‘কাছাকাছি বড় পুজো থাকার সমস্যা অনেক। সবাই বড় পুজোয় টাকা দিতে চায়।’’

১৭ পল্লী সাধারণ দুর্গোৎসব সমিতির মণ্ডপে এ বারের পুজো।

শুধু স্পনসর নয়, কাছাকাছি তারকা পুজো থাকলে দর্শকদের নজরও ঘুরে যায় সেই দিকে। যেমন কালীঘাট-চেতলা এলাকা। বাদামতলা আষাঢ় সঙ্ঘ ও ৬৬ পল্লির কাছেই রয়েছে দিলীপ স্মৃতি সংঘ, শ্রী সংঘ বা প্রতাপাদিত্য রোড ত্রিকোণ পার্কের পুজো। কালীঘাট মেট্রো থেকে বেরিয়ে আসা ভিড়ের বেশির ভাগটাই চলে যায় বাদামতলা ও ৬৬ পল্লিতে। হাতিবাগান থেকে শোভাবাজার মেট্রোর দিকে যাওয়ার সময় কেউ কেউ ঢুঁ মেরে যান গ্রে স্ট্রিটের পুজোগুলোয়। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার থেকে বেরিয়ে ভিড়টা কলেজ স্কোয়ারে যাওয়ার মুখে হাতেগোনা কিছু লোক হয়তো উত্তরণের পুজো দেখেন।

তবে ছোট পুজোর এই পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে কেউ কেউ দায়ী করছেন, নবীন প্রজন্মের অনুৎসাহকেও। শহরের অনেক পুজোকর্তাই বলছেন, একে তো কাজ কিংবা পড়াশোনার জন্য নবীন প্রজন্ম পুজোয় সে ভাবে মাতছে না। তার উপরে জৌলুস না থাকায় পাড়াকে ভালবেসে পুজোয় থাকবে, এমন তরুণ-যুবকের সংখ্যাও অনেক কম। জেলিয়াটোলা নবদুর্গার সম্পাদক নিতাই ভৌমিক যেমন বললেন, নতুন ছেলেরা এখন নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যস্ত। পাড়ার পুজোর যে একটা মজা আছে সেটা টানছে না তাদের। তিনি বলেন, ‘‘আমরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে চাঁদা তুলতাম। এখনও তুলি। কিন্তু ওরা নাকি লজ্জা পায়! আমরা না থাকলে কী হবে কে জানে?’’

তবে সহজে হাল ছাড়া নেই। দশমীর দুপুরেই যেমন একটি মণ্ডপে গোল হয়ে বসেছিলেন পুজো-কর্তারা।

আলোচনার বিষয়? এ বারের হিসেব মিলিয়ে পরের বারের প্রস্তুতির ছক।

— নিজস্ব চিত্র।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy