সবিতা মাহাতো| পাশে পুত্রবধূ রেখা|
যারা খুন করল, আত্মসমর্পণ করে তারা এখন দিব্যি আছে! অথচ যারা খুন হল, তাদের পরিবারের খোঁজ কি কেউ রেখেছে?
প্রশ্নটা এত দিন চাপা ছিল জঙ্গলমহলের কিছু বিধ্বস্ত পরিবারের অন্দরে। সংসারের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এ বার তা পৌঁছে গেল রাজ্যের প্রশাসনিক সদরে। জঙ্গলমহলে খুন-জখমে অভিযুক্ত বেশ কিছু মাওবাদী নেতা-নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় পুনর্বাসন পেয়ে নতুন জীবন শুরু করেছেন। যাঁদের জীবন তাঁদের হাতে শেষ হয়ে গিয়েছে, তেমন বেশ কিছু মানুষের পরিজনেরাও এ বার পুনর্বাসন চেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে আর্জি জানিয়েছেন। ‘অপরাধীদের জন্য চাকরি, প্যাকেজ ইত্যাদির বন্দোবস্ত হল। তা হলে ওদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো কী দোষ করল?’— প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের হাতে নিহতদের একাংশের পরিজনেরা মিলে একটি সংগঠন গড়েছেন— ‘মাওবাদীদের হাতে নিহত পরিবার কল্যাণ সমিতি।’ আপাতদৃষ্টিতে যার পিছনের রাজনীতির সংশ্রব নেই। পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে দরবার করে ফল না-হওয়ায় সম্প্রতি তারা নবান্নে এসেছিল, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য তখন দার্জিলিঙে। সমিতির অভিযোগ, পুলিশও স্মারকলিপি জমা নিতে চায়নি। পরিবর্তে তাদের দিয়ে সাদা কাগজে একটা বিবৃতি লিখিয়ে নিয়েছে।
এক পাতার সেই চিঠিতেই নিজেদের ভবিষ্যৎ বদলানোর আর্জি জানিয়েছেন স্বজনহারারা। কী রকম?
সমিতির দাবি: নিহতদের পরিবারের এক জনকে চাকরি দিতে হবে। যারা ক্ষতিপূরণ পায়নি, তাদের দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সমিতির অভিযোগ, কোনও কোনও পরিবার কেন্দ্রীয় টাকা পেলেও রাজ্যের আর্থিক সহায়তা পায়নি, কিংবা উল্টোটা। জলদি এর সুরাহা চাই। পাশাপাশি নিখোঁজদের দ্রুত খুঁজে বার করার দাবিও জানানো হয়েছে।
প্রশাসনের খবর: পশ্চিমবঙ্গে পালাবদলের পরে সুচিত্রা মাহাতো, জাগরী বাস্কে, রাজারাম সোরেন-সহ জঙ্গলমহলের অন্তত ৩৫ জন উঁচু দরের মাওবাদী নেতা-নেত্রী বা জনগণের কমিটির সক্রিয় সদস্য ধরা দিয়েছেন। রাষ্ট্রদ্রোহিতা, খুন, হামলা, নাশকতা, ভাঙচুর, লুঠ-তোলাবাজির মতো বিবিধ মামলা চলছে ওঁদের বিরুদ্ধে। যদিও অভিযোগ, সরকারপক্ষ মামলা সম্পর্কে বিলকুল উদাসীন। অভিযুক্তেরা কেউ কেউ সরকারি চাকরি পেয়েছেন। অনেকে শাসকদলের সঙ্গে থেকে ঠিকাদারি বা পরিবহণ কারবারে নেমেছেন। কেউ কেউ আবার শাসকদলের গ্রামস্তরের নেতা, যাঁদের অনেকের ছেলে-মেয়েকে সিভিক ভলান্টিয়ার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কাজ দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে নিহতদের পরিজনদের অবস্থা যে–কে-সেই। মন্মথ মাহাতো, জগদীশ মাহাতো, হরিপদ মাহাতো বা ইন্দ্রাণী মাইতির মতো ভুক্তভোগীদের আক্ষেপ, “বছর তিনেক আগে মুখ্যমন্ত্রী বেলপাহাড়ির প্রশাসনিক জনসভায় আমাদের জন্য চাকরি বা পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিছুই হয়নি!’’
সত্যিই কেমন আছেন ওঁদের মতো মানুষগুলি?
সমিতির সূত্র ধরে পৌঁছানো গিয়েছিল ঝাড়গ্রামের সিমলি গ্রামে, যেখানে সবিতা মাহাতোর বাড়ি। পাঁচ বছর আগের এক দুপুরে তাঁর বড় ছেলে অসিতকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল কয়েক জন। পর দিন পাশের গ্রামে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ মেলে। অভিযোগ, রাজনৈতিক সংশ্রবহীন বছর পঁয়ত্রিশের যুবকটিকে পুলিশি চর ঠাউরে চরম শাস্তি দিয়েছে মাওবাদীরা। মাটির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধা মা ছুড়ে দিলেন কান্নাভেজা প্রশ্ন— “যারা খুন করল, তাঁরা এখন রাজা। যে খুন হল, তার পরিবারের খোঁজ কেউ রেখেছে?” ক্ষতিপূরণ বাবদ এ যাবৎ রাজ্যের এক লক্ষ ও কেন্দ্রের তিন লক্ষ টাকা মিলেছে। ‘‘ওতে কী হবে? বৌমার একটা চাকরি না হলে সংসারটা যে ভেসে যায়।”— কান্না বাঁধ মানে না সবিতাদেবীর। বৌমা, অর্থাৎ অসিতবাবুর স্ত্রী রেখাদেবীর বাপের বাড়ি জামবনির পরশুলি গ্রামে। ২০১০-এর জুলাইয়ে মাওবাদীদের হাতে তাঁর বাবা কমল মাহাতোও খুন হন। ‘‘চার ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, শাশুড়ির চিকিৎসা। আমার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে। শুধু চিন্তা, বেঁচে থাকব কী করে।’’— বলেন স্বামীহারা।
ওঁর মতোই মাটি কামড়ে বাঁচার লড়াই চালাচ্ছেন ঝাড়গ্রামের জিতুশোল গ্রামের বিশ্বজিৎ মাহাতোর স্ত্রী সুরেখা। বছর চল্লিশের বিশ্বজিৎকে পাঁচ বছর আগে জিতুশোল বাসস্ট্যান্ড থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল মাওবাদীরা। দেহ পাওয়া যায় ক’ঘণ্টা বাদে। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা। বাবা উপেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘ও জিতুশোল চকে খাবারের দোকান চালাত। অশান্তিতে দোকান বন্ধ হল। পরে ওকে চরের তকমা দিয়ে মারা হল।’’ সুরেখাদেবীও খুনের হুমকি পেয়েছিলেন। যার জেরে তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি গ্রামছাড়া। ক্ষতিপূরণের টাকায় ঝাড়গ্রামে একচিলতে বাড়ি বানিয়ে রয়েছেন। মেয়েরা ঝাড়গ্রামের স্কুলে পড়ে। সপ্তাহে এক দিন শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখে যান। সুরেখা বলেন, ‘‘সামান্য জমির চাষে ওঁদের কোনও মতে চলছে। একটা চাকরি না হলেই নয়।’’
বিশ্বজিতের মা রুক্মিণীদেবীর প্রশ্ন, ‘‘খুনি মাওবাদীরা প্যাকেজ নিয়ে আরামে থাকবে। আর আমরা দুয়োরানি হয়ে? এ কেমন বিচার?”
ছ’বছর আগে ঝাড়গ্রামের শিরষি গ্রামের বাসিন্দা তপন মাহাতোকেও মেরেছিল মাওবাদীরা। বছর ষাটের ওই সিপিএম নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মেলে ক্ষতবিক্ষত দেহ। দুই ছেলের মধ্যে বড় ধীমান জন্মান্ধ। ছোট লোহিত কিছু দিন হল সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজ পেয়েছেন। তপনবাবুর স্ত্রী তুলনাদেবীর আকুল আর্তি, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী ধীমানের একটা সুরাহা করে দিন।” নবান্নে আসা সমিতির দলে ছিলেন ইন্দ্রাণী মাইতি। পাঁচ বছর আগে তাঁর স্বামী সুধাংশুবাবুকে মাওবাদীরা খুন করেছে। সমিতির প্রতিনিধিদলে থাকা মন্মথ মাহাতোর বাবা জ্যোতিরিন্দ্রবাবু খুন হন ছ’বছর আগে। পুনর্বাসনের দাবিতে ওঁরাও গলা মিলিয়েছেন।
উপরন্তু ওঁদের প্রায় সকলেরই অভিযোগ, শাসকদল দরকারের সময় তাঁদের ব্যবহার করে সহানুভূতির ভোট কুড়িয়েছে। যে অভিযোগকে ‘ন্যায্যতা’র তকমা দিয়ে সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের কটাক্ষ, ‘‘মমতাকে ক্ষমতায় বসাতে মাওবাদীরা সক্রিয় হয়েছিল। প্রতিদানে উনি সুচিত্রা, জাগরীদের পুনর্বাসনকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। নিহতদের পরিবার তখন সহানুভূতি আদায়ের কাজে লেগেছিল। কাজ ফুরোলে ওদের ভুলে গিয়েছেন!’’
রাজনীতির স্বার্থে আক্রমণকারীদের ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ ও দরকার ফুরোলে আক্রান্তদের ‘স্বার্থ উপেক্ষা’ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। যেমন, অসমে আলফা জঙ্গিদের পুনর্বাসনের সময়ে। অভিযোগ উঠেছিল, যারা নির্বিচারে লোক মারল, তারা বহাল তবিয়তে থাকলেও ক্ষতিগ্রস্তেরা তলিয়ে গিয়েছে দুর্দশার অতলে। কাশ্মীরি জঙ্গিদের কিংবা মধ্যপ্রদেশে মাওবাদীদের জন্য ঘোষিত আর্থিক প্যাকেজ ঘিরেও সমালোচনার ঢেউ ওঠে।
সমাজবিজ্ঞানীরাও মানছেন, ক্ষমতার সমীকরণে সওয়ার হয়ে এই প্রবণতা দিনে দিনে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে। ‘‘ এই রাজনীতিই পৃথিবীতে একশো বছর ধরে চলে আসছে।’’— বলছেন সমাজবিজ্ঞানী আন্দ্রে বেতেই। তাঁর কথায়, ‘‘আক্রমণকারীদের পুরস্কৃত করা ঠিক নয়। কিন্তু এ-ও ঠিক যে, পূর্ণ সামাজিক ন্যায়বিচার অসম্ভব। কারও না কারও ক্ষোভ থাকবেই।’’ সমাজবি়জ্ঞানী আশিস নন্দীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘জঙ্গিদের মূল স্রোতে ফেরাতে সরকারি ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিতর্ক সর্বত্র। সব ক্ষেত্রেই সরকারের উচিত সমস্ত ভুক্তভোগীর জন্য ব্যবস্থা করা।’’
জঙ্গলমহলের আক্রান্তদের মনেও বাসা বাঁধা এই ‘উপেক্ষার ক্ষোভ’কে বিরোধীপক্ষ স্বভাবতই অস্ত্র করছে। ‘‘এ শুধু প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির এটাই হলমার্ক!’’— বলছেন মহম্মদ সেলিম। কংগ্রেসের মানস ভুঁইয়ার মন্তব্য, ‘‘মাওবাদী পুনর্বাসনের পিছনে হয়তো রাজনৈতিক তাগিদ ছিল। কিন্তু নিহত নিরীহ লোকজনের পরিবার কেন বিচার পেল না, তা ভেবে আমরা বিস্মিত ও ব্যথিত!’’
রাজ্য সরকার কী বলে?
শাসকদলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সমিতির দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। যদিও বিরোধীদের অভিযোগ মানতে তিনি নারাজ। পার্থবাবুর হিসেবে, অন্তত ৯০% ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ভুক্তভোগীদের পুনর্বাসন দিয়েছে। ‘‘যাদের হয়নি, তাদের হয়তো চাকরি পাওয়ার মতো যোগ্য কেউ ছিল না। বা অন্য সমস্যা ছিল।’’— যুক্তি মন্ত্রীর।
তা-ও ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে। যার আঁচ গিয়ে লেগেছে শাসকমহলেও। তাই শ্রীকান্ত, সৃষ্টিধর, শান্তিরামের মতো জঙ্গলমহলের নেতাদের ‘সক্রিয়’ হতে বলেছে তৃণমূল। পার্থবাবুর কথায়, ‘‘ভুল হয়ে থাকলে দলীয় স্তরে তালিকা তৈরি করতে বলেছি।’’
‘ভুল’ ধরা পড়লেও দুর্ভাগাদের কপালে শিকে ছিঁড়বে কিনা, সেটাই এখন দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy