মালদহের বাড়িতে বাবা গজেন্দ্রনাথ সরকার, মা রানিদেবী ও বোন জয়িতার সঙ্গে গীতশ্রী। —নিজস্ব চিত্র।
সমাবর্তনের মঞ্চে এক ছাত্রীর পদক ও শংসাপত্র প্রত্যাখ্যানের দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। ২৪ ঘণ্টা পরে, বৃহস্পতিবার তিনিই বললেন, “গীতশ্রী সরকার (প্রতিবাদী ছাত্রী) রাজনীতির শিকার। ওকে রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।” উপাচার্যের বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে গীতশ্রী অবশ্য এ দিন বলেছেন, “বিবেকের ডাকেই যা করার করেছি। এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক প্ররোচনা ছিল না।” মেয়ের কাজ সমর্থন করে তাঁকে ভরসা জুগিয়েছেন শিক্ষক মা-বাবাও।
কলকাতা থেকে মালদহের ইংরেজবাজারের বাড়িতে ফেরা গীতশ্রীর মধ্যে এ দিন রাজনৈতিক চাপের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি বলে তাঁর মা-বাবার সাক্ষ্য। তাঁরা জানান, বৃহস্পতিবার ছোট মেয়ে জয়িতার জন্মদিন। বড় মেয়ে বাড়ি ফিরেই তাঁদের সঙ্গে বড়দিন আর বোনের জন্মদিন পালনে মেতে উঠেছেন।
বুধবার সকালে যাদবপুরের বার্ষিক সমাবর্তনের প্রথমেই এ বারের কলা শাখার শ্রেষ্ঠ স্নাতক গীতশ্রীর নাম ঘোষণা করা হয়েছিল। আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তাঁর দিকে পদক-শংসাপত্র বাড়িয়ে দিলেও হাত জোড় করে ওই ছাত্রী জানিয়ে দেন, তিনি ওগুলো নেবেন না। গীতশ্রী পরে জানান, উপাচার্য অভিজিৎবাবুর বিরোধিতা করার জন্যই তিনি পদক-শংসাপত্র নেননি। রাজ্যপাল অবশ্য গীতশ্রীর কোনও ব্যাখ্যা না-শুনেই তাঁকে মঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলেন। নেমে যান গীতশ্রী।
পুরো ঘটনায় তিনি কি অনুতপ্ত?
জবাবে গীতশ্রী এ দিন বলেন, “রাজ্যপালকে অসম্মান করার কোনও উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। তবে আমার আচরণে তিনি অসম্মানিত হয়ে থাকলে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”
সমাবর্তনের পরে ইংরেজবাজারে বাঁশবাড়ির বাড়িতে ফেরার জন্য বুধবার রাতের ট্রেন ধরেন যাদবপুরের এই কৃতী ছাত্রী। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে আত্মীয়পরিজন, বন্ধুদের অনেকেই তাঁকে ফোন করেন। গীতশ্রীর দাবি, “প্রত্যেকেই আমার পদক ও শংসাপত্র বয়কটের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছেন।” রাতারাতি খবরের শিরোনামে চলে আসা তরুণীকে নিয়ে পাড়ায় অবশ্য তেমন কলরব নেই। পড়শিদের অনেকে জানেনই না গীতশ্রীর ঘরে ফেরার কথা। অনেকে এই কৃতী কন্যার অনমনীয় মনোভাবকে কুর্নিশ করেছেন। মন্তব্য এড়িয়েও গিয়েছেন অনেকে।
ফাইনাল পরীক্ষায় ভাল ফল করায় মেয়ে সমাবর্তনে আচার্য-রাজ্যপালের হাত থেকে শংসাপত্র নেবেন জেনে বেশ গর্বই হয়েছিল মা-বাবার। তবে শেষ পর্যন্ত যা ঘটেছে, তাতে কোনও দোষ দেখছেন না গীতশ্রীর শিক্ষক বাবা-মা গজেন্দ্রনাথ ও রানি সরকার। মেয়ের আচরণ সমর্থন করে গজেনবাবু এ দিন বলেন, “আমি নিজে এক জন শিক্ষক। যদি দেখি, আমার আচরণের বিরোধিতায় ছাত্রছাত্রীরা পুরস্কার নিচ্ছে না, তা হলে নিজের ভূমিকাটাই আর এক বার খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি।” মেয়ের মতো তিনিও মনে করেন, যাদবপুরের উপাচার্যের পদত্যাগই করা উচিত। বুধবারের মতো গীতশ্রী এ দিনও ফের বলেন, “শংসাপত্র নেওয়ার সুযোগ আর ফিরবে না জেনেও যে-মঞ্চে উপাচার্য ছিলেন, সেখানে দাঁড়িয়ে শংসাপত্র নিতে আমার মন সায় দেয়নি।”
বাঁশবাড়ি অবশ্য গীতশ্রীকে বরাবরের চুপচাপ, শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসেবেই চেনে। মালদহ বাল্য বালিকা বিদ্যালয়ের এই ছাত্রীটি পড়াশোনার জন্যই কলকাতায় গিয়েছেন। তাঁর এই ‘প্রতিবাদী’ চারিত্র পড়শিদের কাছে নতুন। আর তাঁদের সেই শান্ত মেয়ে বলছেন, “কলকাতায় নানা রকম পরিস্থিতি আমাকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। মুখ খুলতে শিখিয়েছে।” যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা শাখার এসএফআই পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদিকা তিনি। “তাই আন্দোলনকারী সব পড়ুয়ার হয়েই সমাবর্তন মঞ্চে রাজ্যপালকে নিজেদের বক্তব্য জানাতে চেয়েছিলাম,” নিজের সে-দিনের আচরণের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন গীতশ্রী।
তবে যাঁকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই উপাচার্য অভিজিৎবাবু এ দিন গীতশ্রীর কাজের সমালোচনায় মুখর। তিনি সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, “গীতশ্রী রাজনীতির শিকার। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই তাঁকে কাজে লাগানো হয়েছে।” তবে ছাত্রীটির জন্য সহানুভূতির সুরও শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। ওই কাজের জন্য গীতশ্রীকে পুরোপুরি দায়ী করতেও রাজি নন উপাচার্য। তাঁর কথায়, “গীতশ্রী যা করেছে, তাতে আমার নৈতিক সমর্থন নেই। কিন্তু গীতশ্রীকে নিশ্চয়ই কেউ ভুল বুঝিয়েছেন। ওকে রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।” তাঁর মতে, সমাবর্তনের মঞ্চে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে নিজেই তার শিকার হয়েছেন গীতশ্রী। ওই ছাত্রীর কাছে সমাবর্তনের দিনটি কালো দিবস হয়ে থাকল বলেও মনে করেন উপাচার্য। অভিজিৎবাবুর বক্তব্য উড়িয়ে দিয়ে গীতশ্রী অবশ্য রাজনৈতিক প্ররোচনা ছিল না বলেই জানান।
রাজনৈতিক প্ররোচনার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুও। তিনি বলেন, “আচার্য যে-ভাবে ছাত্রীকে বেরিয়ে যেতে বলেছেন, তা অপ্রত্যাশিত। উপাচার্যের আচরণও অনভিপ্রেত।” বিজেপি নেতা রাহুল সিংহ অবশ্য বুধবারেই বলেছিলেন, “পড়াশোনা করে না, এমন কিছু বিপথগামী পড়ুয়া এ-সব করছে। কিছু শিক্ষকও যুক্ত। এমন আন্দোলন বরদাস্ত করি না।”
গীতশ্রীর পদক্ষেপে যাদবপুরের আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীরা স্বভাবতই উৎসাহিত। তাঁরা এ বার লাগাতার অনশনের কথা ভাবছেন। বড়দিনের ছুটি শেষ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে ২ জানুয়ারি। বৃহস্পতিবার তাঁরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পরে এক সপ্তাহ উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে প্রচার-আন্দোলন চলবে। তার পরেই ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ সভা ডেকে অরবিন্দ ভবনের সামনে অবস্থান এবং অনশন কর্মসূচির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy