Advertisement
২৮ নভেম্বর ২০২৪

তৃণ-জুজুতে ঠুঁটো পুলিশ, জেলার রোগ কলকাতায়

জেলার ‘রোগ’ ছড়াচ্ছে কলকাতাতেও! যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে, উর্দিধারী পুলিশকর্মীর গায়ে হাত তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে হামলাকারীরা নিজেরাই শাসক দলের সঙ্গে জড়িত বা তারা নিজেদের ‘খুঁটি’র জোর বোঝাতে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম নিচ্ছে। আর তাতেই পুলিশ থমকে যাচ্ছে। শাসক দলের সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানার পরে অভিযুক্তদের যে ধরা যাবে না সেই বার্তা সর্বত্র পৌঁছে যাওয়াতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকছে না বলে কলকাতা পুলিশের নিচুতলা এখন অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। জেলা পুলিশের এই ‘রোগ’ এখন কলকাতা পুলিশের মধ্যেও সংক্রামিত হওয়ায় শঙ্কিত আইন রক্ষকদের একাংশ।

শিবাজী দে সরকার
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০৩:৪২
Share: Save:

জেলার ‘রোগ’ ছড়াচ্ছে কলকাতাতেও!

যার যখন ইচ্ছে হচ্ছে, উর্দিধারী পুলিশকর্মীর গায়ে হাত তুলছে। অনেক ক্ষেত্রে হামলাকারীরা নিজেরাই শাসক দলের সঙ্গে জড়িত বা তারা নিজেদের ‘খুঁটি’র জোর বোঝাতে শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের নাম নিচ্ছে। আর তাতেই পুলিশ থমকে যাচ্ছে। শাসক দলের সঙ্গে যোগাযোগের কথা জানার পরে অভিযুক্তদের যে ধরা যাবে না সেই বার্তা সর্বত্র পৌঁছে যাওয়াতেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় থাকছে না বলে কলকাতা পুলিশের নিচুতলা এখন অভিযোগ তুলতে শুরু করেছে। জেলা পুলিশের এই ‘রোগ’ এখন কলকাতা পুলিশের মধ্যেও সংক্রামিত হওয়ায় শঙ্কিত আইন রক্ষকদের একাংশ। রাজ্য পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা মুচকি হেসে বলেন, “পুলিশ এখন মন্দিরের ঘণ্টা। যার-যখন ইচ্ছে বাজাবে। ব্যাপারটা প্রায় এ রকমই হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

কী বলছে পুলিশের নিচুতলা? দক্ষিণ কলকাতার একটি থানার এক সাব-ইনস্পেক্টর বলেন, “সার্ভে পার্ক থানার সন্তোষপুরে ট্রাফিক সার্জেন্টদের নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল। কিন্তু অভিযুক্ত তৃণমূলের কাউন্সিলর বলে আমাদের সহকর্মীরা কিছু করতে পারেননি। আলিপুর থানায় হামলার ঘটনায় অভিযুক্তেরা সবাই এক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ। সেখানেও লালবাজার হাত-পা বেঁধে দিল। এক জন ‘কুচো’ হামলাকারীকে ধরা ছড়া আর কিছু করতে পারলাম না।”

ঘটনা আরও আছে। উত্তর কলকাতার এক থানার সাব ইনস্পেক্টর টানছেন এনআরএস-কাণ্ড। তাঁর ক্ষোভ, “অভিযুক্তদের মাথায় শাসক দলের স্বাস্থ্য সেলের নেতাদের একাংশের হাত আছে। তাই আমরা হস্টেলের আবাসিকদের ডেকে জেরাই করতে পারলাম না। তদন্ত করে অপরাধী ধরার অধিকারটাই আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” হরিদেবপুর থানায় তাঁর এক সহকর্মীর আক্ষেপ, “বুধবার রাতে আমাদের এলাকায় পুলিশের থেকে অভিযুক্তকে ছিনিয়ে নেওয়া হল। উর্দিকে কেউ ভয় পাচ্ছে না। সবাই পুলিশকে মারার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে।”

কেন এমন হচ্ছে? রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলেন, “বীরভূম-সিনড্রোম বলতে পারেন।” তাঁর ব্যাখ্যা, রাজ্যের একটা জেলাতেই যদি পুলিশকে বোম মারার পরামর্শ দিয়ে শাসক দলের নেতা অনুব্রত মণ্ডল বহাল তবিয়তে থাকতে পারেন, পায়ে পিষে খুন করার কথা প্রকাশ্যে বলেও তৃণমূল বিধায়ক মনিরুল ইসলাম গ্রেফতার না হন, থানায় ঢুকে পুলিশকে মারধর করেও যুব তৃণমূল (বহিষ্কৃত) নেতা সুদীপ্ত ঘোষ ধরা না পড়েন তা হলে অন্য জেলার মানুষও ভাবতেই পারেন পুলিশের সঙ্গে এমনটা করাই যায়। ঘটনাচক্রে বৃহস্পতিবার বীরভূমের নলহাটি থানায় স্মারকলিপি দিতে ঢুকে ওসি-র সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল নেতা তথা নলহাটি পুরসভার প্রাক্তন কাউন্সিলর একরামুল হকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ওই নেতা দাবি করেছেন, তিনি ‘একটু উত্তেজিত’ হয়ে পড়েছিলেন।

শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের ‘উত্তেজনা’ কী চেহারা নিতে পারে রবিবার ডানকুনির টোলট্যাক্স বুথে দেখেছেন টোল-কর্মীরা। সৌজন্যে তৃণমূল নেতা আবু আয়েশ মণ্ডল। টোলকর্মীদের জুতো পেটা করার অভিযোগ ওঠার পরেও বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। আবার বুধবার রাতে হাওড়ার গোলাবাড়ি থানা এলাকার একটি ফ্ল্যাট-বাড়িতে বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার সোনালী গুহর ‘দিদিগিরি’-র সময়ে পুলিশ ছিল নীরব দর্শক।

এমন ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা বাহিনীর সার্বিক ভাবমূর্তি আরও খারাপ করেছে বলে মনে করছে পুলিশের নিচুতলা। বন্দর এলাকার একটি থানার এক ইনস্পেক্টর বলেন, “পুলিশকে যতো বেশি এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্তদের আড়াল করার কাজে লাগানো হবে, ততোই হরিদেবপুরের মতো ঘটনা ঘটবে। আমরা কি স্রেফ ‘যেমন বলবেন স্যার’ বলার জন্যই আছি?” পুলিশ অফিসারদের একাংশ ২৯ নভেম্বর সংখ্যালঘুদের সমাবেশে পুলিশের উপরে হামলার ঘটনা টেনে আনছেন। ওই দিন কলকাতা পুলিশের চার শীর্ষ কর্তা-সহ ১০ পুলিশকর্মী আহত হন। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেন একটি ক্লাবে। ওই ঘটনায় সংগঠকদের বিরুদ্ধে মামলা করায় প্রশাসনের শীর্ষ-কর্তাদের ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে লালবাজারের বহু পুলিশ কর্তাকে। নবান্ন সূত্রের দাবি, ওই সংগঠকদের বিরুদ্ধে কেন মামলা করা হল, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (তিনি পুলিশমন্ত্রীও) ভর্ৎসনা করেছেন কলকাতা পুলিশের কর্তাদের।

লালবাজারের পুলিশ-কর্তাদের একাংশ এই সব অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁদের যুক্তি, “এই তো কালীঘাট থানায় সোমবার রাতে পুলিশের উপরে হামলার ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে তিন জনকে ধরা হয়েছে। কে বলল আমরা অভিযুক্তদের হাতে পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছি?” কলকাতা পুলিশের সদর দফতরের অন্য কিছু কর্তা ঘনিষ্ঠ মহলে পুলিশের ‘দশা’ নিয়ে অস্বস্তি লুকোননি। তাঁদের বক্তব্যের নির্যাসকলকাতা শহরে তল্লাশি চালানোর সময় যদি পুলিশকে ধাক্কাধাক্কি করে কেউ অভিযুক্ত ছিনিয়ে নিয়ে যায়, তবে পুলিশের উপরে মানুষের আস্থা থাকবে কেন?

পুলিশের উপরে হামলার ঘটনায় অবশ্য বিস্মিত নন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পুলিশ নিরপেক্ষ না হলে, ওই রকম ঘটনা আবার ঘটবেই।” তাঁর জিজ্ঞাসা, “যেখানে পুলিশ কর্মীদেরই নিরাপত্তা নেই, সেখানে জনতা নিরাপত্তা পাবে কী ভাবে?” প্রায় একই সুরে কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার বলছেন, “আলিপুরের ঘটনা থেকে পুলিশ শিক্ষা না নেওয়ার ফলেই হরিদেবপুরের মতো ঘটনা ঘটছে।” এ পরিস্থিতি থেকে বেরনোর উপায় কী? তুষারবাবুর পরামর্শ, “ভাবমূতির্র্ উদ্ধারে পুলিশের শীর্ষ মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাঁরা যদি অপরাধীদের না ধরতে মদত দেন তা হলে দুষ্কৃতীরাই উৎসাহিত হবে।”

বাহিনীর এই অবস্থা দেখে কী বলছে কলকাতা পুলিশ প্রশাসন? কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) রাজীব মিশ্রের দাবি, “যে সব ঘটনা ঘটছে, সব ক্ষেত্রেই আইনমতো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” কিন্তু পুলিশের ভাবমূর্তি? এ বার যুগ্ম কমিশনার বলেন, “এ সব নিয়ে আর একটা কথাও বলব না।”

অন্য বিষয়গুলি:

police tmc politics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy