যেমন নেত্রী, তেমন স্যাঙাত।
নেত্রী কখনও ‘শালা’ বলছেন, কখনও বলছেন ‘বাঁশ দিচ্ছে’, কখনও আবার তাঁর হাতের মুদ্রা সহকারে সেই বাঁশ হয়ে যাচ্ছে ‘বাম্বু’! এই মুখের লাগাম হারানোটা অবশ্য ইদানীং শুরু হয়েছে তাঁর।
তবে স্যাঙাতটিকে অশ্লীল কথা বলা ও কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করায় কার্যত স্বনামধন্য বলা চলে। তিনি লোকসভার তৃণমূল সাংসদ। আইনজীবীর পোশাক পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হয়ে মামলাও লড়েন। আবার সমান স্বাচ্ছন্দ্যেই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে ভোটের ‘থাপ্পড়’ মারার কথা বলেন। কিংবা প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বিয়ে করা-না করা নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করে জনসভা গরম করেন। লোকসভা চলাকালীন বিপক্ষ সাংসদকে তুইতোকারি করতেও ছাড়েন না।
এ সবের পরেও অবশ্য বিন্দুমাত্র অনুতাপ নেই কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আজ লোকসভায় স্পিকার সুমিত্রা মহাজন তাঁর উদ্দেশেই বলেছিলেন, “কেউ যদি মন থেকে ক্ষমা চান, তা হলে তা সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।” কিন্তু কল্যাণ সংসদের বাইরে সাফ বলেন, “আমি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ শানিয়েছি। ফলে ক্ষমা চাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। ভবিষ্যতেও প্রয়োজন হলে করব!”
তাৎপর্যপূর্ণ হল, মাত্র ক’দিন আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সাধ্বী নিরঞ্জন জ্যোতির কুকথার প্রতিবাদে সংসদ অচল করে রেখেছিল কল্যাণেরই দল। কুকথার আর এক ‘মুখ’ তাপস পাল-সহ তৃণমূল সাংসদরা সংসদ চত্বরে ধর্না দিয়েছিলেন। কিন্তু কল্যাণের মন্তব্যের জেরে এখন ফের শাসক দলের চাঁদমারিতে পড়েছে তৃণমূল শিবির। বিজেপির শীর্ষ সূত্রে বলা হচ্ছে, কল্যাণের উপরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। শ্রীরামপুরের সাংসদ ক্ষমা না চাইলে তাঁর বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব আনার হুমকি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাজীবপ্রতাপ রুডি (গত কাল যাঁকে ‘আধা মন্ত্রী’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন কল্যাণ)। এমনকী কল্যাণকে অধিবেশন কক্ষ থেকে বের করে দেওয়ার জন্য স্পিকারের কাছে আর্জি জানানো হতে পারে বলেও বিজেপি সূত্রে বলা হচ্ছে।
অথচ আজ প্রথম দিকে কল্যাণের বিরুদ্ধে এতটা খড়্গহস্ত হয়নি বিজেপি। স্পিকার ছাড়াও সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুও বিষয়টি মিটমাট করে নেওয়ার উপরেই জোর দিয়েছিলেন। জিরো আওয়ারে বেঙ্কাইয়া বলেছিলেন, “সম্প্রতি এক নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে যে ভাষায় আক্রমণ করেছেন তাতে তাঁর নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত। আমি মনে করি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে থেকেই এ বিষয়ে ক্ষমা চেয়ে বিষয়টি এখানেই মিটিয়ে ফেলুন।” স্পিকার বলেন, “কাউকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সংসদে বা সংসদের বাইরে যে যা-ই বলুক না কেন, সকলকে মাথায় রাখতে হবে আমরা গোটা দেশের প্রতিনিধি।”
এই সময়ে কল্যাণ নীরব থাকলেও তাঁর হয়ে এগিয়ে আসেন সৌগত রায়। বলেন, “নোটিস না দিয়ে কোনও সাংসদের বিরুদ্ধে এ ভাবে কিছু বলা যায় না।” সৌগতবাবুর ওই যুক্তিতেই হাতে অস্ত্র পেয়ে যায় বিজেপি। ফের উঠে আসে তাপস পাল প্রসঙ্গ। বেঙ্কাইয়া বলেন, “আমরা আদৌ কোনও প্রস্তাব আনার পক্ষে ছিলাম না। কল্যাণ নিজে ক্ষমা চাইলে প্রস্তাব আনারও প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তৃণমূলের সাংসদই নোটিস দেওয়ার কথা বলছেন। ফলে এখন আমাদেরও বিবেচনা করতে হবে, কী ধরনের প্রস্তাব কল্যাণের বিরুদ্ধে আনা যায়।” নাম না করে কল্যাণের বিরুদ্ধে সরব হন দার্জিলিঙের সাংসদ সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়াও (গত কাল তাঁকেই কল্যাণ বলেছিলেন ‘তুই বোস আগে’)। বিজেপির পাশে এসে দাঁড়ান সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিমও।
বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হওয়ায় লোকসভা মুলতুবি করে দেন স্পিকার। বেরিয়ে এসে কল্যাণকে অস্থির ভাবে এ-দিক ও-দিক পায়চারি করতে করতে ফোনে কথা বলতে দেখা যায়। তার পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন,“ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্ন নেই। ‘ভাগ মমতা ভাগ’ যদি কুকথা না হয়, তা হলে আমি কেন প্রধানমন্ত্রীকে রাজনৈতিক আক্রমণ করতে পারব না?” এমনকী প্রাক্তন অধ্যাপক সৌগতবাবুও যুক্তি দেন, “গালাগালি দেওয়া এক। আর রাজনৈতিক ভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা অন্য। তাই নিরঞ্জন ও কল্যাণকে গুলিয়ে ফেললে চলবে না!”
তৃণমূল যা-ই বলুক, কল্যাণকে এত সহজে ছাড়তে রাজি নয় বিজেপি। গত কালই কল্যাণের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি জারি করেছিল তারা। আজ লোকসভায় সেটি উত্থাপন করেন সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়া। পরে তিনি বলেন, “আগামিকাল আমি কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে প্রস্তাব আনব লোকসভায়। প্রথমে প্রস্তাবটি নিয়ে স্পিকারের কাছে যাব। তারপর স্পিকার যা নির্দেশ দেবেন, তার ভিত্তিতেই অগ্রসর হব।”
এর আগেও একাধিক বার কল্যাণের অভব্য আচরণের সাক্ষী থেকেছে লোকসভা। এমনকী ইউপিএ আমলে প্রবীণ সাংসদদের দিকে মারমুখী ভঙ্গিতে ছুটে যেতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। সেই ট্র্যাডিশন জারি রয়েছে এনডিএ জমানাতেও। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার এক শীর্ষস্থানীয় সদস্য প্রশ্ন তুললেন, “কল্যাণ এত সাহস পাচ্ছেন কোথা থেকে? উত্তর স্পষ্ট, তাঁর পিছনে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই হাত রয়েছে। যে ভাবে মমতা কুকথা বলেন এবং ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেন না (যদিও ‘শালা’ বলার পরে এবং হালফিলে ওই এক বারই ক্ষমা চাইতে দেখা গিয়েছিল মমতাকে), সেখান থেকে সাহস পেয়েই তাঁর অনুচররা একই পথে হাঁটছেন। কিন্তু বিজেপি তা বরদাস্ত করবে না।”
বিজেপি নেতৃত্বের মতে, কলকাতায় অমিত শাহের জনসভার সাফল্যের পর থেকেই হতাশ মমতা। কল্যাণের মাধ্যমে সেই হতাশারই পরিচয় দিচ্ছেন তিনি। বিজেপি চায় কল্যাণকে ব্যবহার করেই আক্রমণটা ফেরত দিতে। অর্থাৎ প্রকাশ্যে শ্রীরামপুরের সাংসদকে কোণঠাসা করা হলেও আখেরে তাদের নিশানা মমতাই। বিজেপি নেতাদের দাবি, কিছু তৃণমূল সাংসদও কল্যাণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। দলের অনেক নেতাই যে মমতার উপরে ক্ষুব্ধ, এতেই তা প্রমাণিত। কল্যাণের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ করা হবে কি না, তা বিজেপি নেতৃত্ব আলোচনা করেই ঠিক করবেন। তবে আপাতত এ নিয়ে চাপ বাড়িয়ে তৃণমূলকে যে অস্বস্তিতে ফেলা হবে, সে বিষয়ে সকলেই একমত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy