নিজের জন্য ছোটখাটো একটা পাকা বাড়ির স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন ছিল, গ্রামে একটা প্রাথমিক স্কুলেরও। এই দুই স্বপ্নই ঘটনাচক্রে মিলেমিশে গিয়েছে কার্তিক মণ্ডলের জীবনে!
কার্তিক পেশায় দিনমজুর। লোকের জমিতে মজুরি খেটে সংসার চলে। কখনও-সখনও অন্যের জমিতে হয়তো নিজের জন্য অল্পস্বল্প চাষবাস। তিল তিল করে জমিয়ে, ধারদেনা করে, একটা পাকা বাড়ি বানানোর কাজ তিনি শুরু করেন বছর আটেক আগে। এর কিছু দিন পর তাঁদের গ্রাম একটি প্রাথমিক স্কুলের অনুমোদন পায়। আট বছর পর কার্তিকের পাকা বাড়ি মোটামুটি সম্পূর্ণ। কিন্তু স্কুলবাড়ি তৈরির কাজ শুরুই হয়নি। আটকে গিয়েছে জমি-জটিলতায়। এ হেন সঙ্কটকালে এগিয়ে এসেছেন কার্তিক। নিজের নতুন বাড়িতেই স্কুল বসানোর অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। তাঁর স্বপ্নের পাকা বাড়িতেই এখন চলে গ্রামের একমাত্র প্রাইমারি স্কুল। আর তিনি সপরিবার থাকেন পাশের টিন-টালির এক কামরার ঘরে। কার্তিক কথা দিয়েছেন, যত দিন না স্কুলবাড়ি তৈরি হচ্ছে, তত দিন তাঁর ঘরবাড়িই স্কুল কর্তৃপক্ষ ব্যবহার করবেন। যদিও কার্তিক ভাল মতোই জানেন, আইনি এবং জমি জটিলতায় স্কুলবাড়ি তৈরি হওয়ার বিষয়টি আপাতত বিশ বাঁও জলে!
মালদহের গাজোলের আমতলা গ্রামের কার্তিক মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু পাশ করেননি। আর কখনও পরীক্ষাও দেননি। তাই বলে নিজের দুই ছেলেমেয়ে স্কুলের পাঠ নেবে না, এটা কার্তিক এবং তাঁর স্ত্রী কল্যাণী চাননি। কিন্তু গ্রামে তো কোনও স্কুল নেই! গ্রামের অন্যদের নিয়ে প্রশাসনের কাছে দরবার শুরু করেন— আমতলায় একটা প্রাথমিক স্কুল চাই। সেটা ২০০৭-০৮ সাল হবে। সেই স্বপ্ন ‘পূর্ণ হল’ একটা সময়ে। বছর আটত্রিশের কার্তিক বললেন, ‘‘২০১২ সালে আমতলা প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরির অনুমোদন দেয় শিক্ষা দফতর। স্কুল বাড়ি তৈরির জন্য জমিও দেওয়া হয়। কিন্তু সেই জমি আগে পাট্টা দেওয়া ছিল গ্রামেরই এক পরিবারকে। তাঁরা জমির মালিকানা নিয়ে সমস্যা তৈরি করেন। ফলে স্কুল চালু হলেও, স্কুলবাড়ি তৈরি হয়নি।’’ কার্তিক জানালেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে আমার বাড়ির গাছতলায় বসত স্কুল। বছরের পর বছর ধরে এমনটাই চলছিল। বুঝতে পারছিলাম, রোদে-জলে বাচ্চাগুলোর কষ্ট হচ্ছে। তাই বাড়িটা যখন রেডি হয়ে গেল, স্কুলকেই দিয়ে দিলাম। যদ্দিন না স্কুলবাড়ি হয়, এ বাড়িই ওদের স্কুল।’’
কার্তিকের মেয়ে নিস্তারমণি, ছেলে ভোলানাথ এই গাছতলার স্কুলেই পড়েছে। এখন তারা দু’জনেই হাতিমারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। দিনমজুরির কাজ করে সংসার ও ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াটা খুবই কষ্টের। তার মধ্যেও কার্তিক নিজের দ্বিতীয় স্বপ্নটাকে তিল তিল করে বাস্তবে গড়ে তুলছিলেন। গত মার্চে তাঁর স্বপ্নের বাড়ি তৈরি মোটামুটি ভাবে সম্পূর্ণ হয়। কার্তিক বলছেন, ‘‘দিনমজুরির কাজ করি। আয়ের তো ঠিক নেই। যদি সকাল থেকে কাজ করি, তা হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত খাটলে ৭০০ টাকা কখনও হয়। না হলে ওই দৈনিক ৩০০ বা ৪০০। তা-ও অর্ধেক দিন কাজ থাকে না। অনেক ধারদেনা করে এই বাড়িটা বানিয়েছি। চারটে ঘর আছে। মাস্টারমশাই আর দিদিভাইদের বললাম, আর গাছতলায় নয়, আমার বাড়িতেই স্কুল বসুক। মার্চ মাস থেকে তা-ই চলছে।’’
আমতলার একমাত্র প্রাইমারি স্কুলে তিন জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। প্রধানশিক্ষক নেই। ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক সঞ্জয় পাল। সঙ্গে শিউলি সরকার এবং স্বর্ণালি প্রসাদ। স্বর্ণালির কথায়, ‘‘কার্তিকবাবু এবং তাঁর স্ত্রী না-থাকলে এই স্কুল চালানোই যেত না। শিউলিদি সেই প্রথম দিন থেকেই রয়েছেন। আগে তো মাঠে স্কুল হত। তার পর থেকে কার্তিকবাবুদের উঠোনের ওই গাছতলায়। এ ভাবেই বছরের পর বছর চলেছে। মিড ডে মিলও রান্না হয় এ বাড়িতে।’’ স্বর্ণালি জানান, লকডাউনের সময় দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ ছিল। সম্পূর্ণ ভাবে খোলার আগে গত ফেব্রুয়ারিতে রাজ্য সরকার নির্দেশ দেয়, ‘পাড়ায় শিক্ষালয়’ করতে হবে, খোলা জায়গায়। তখন সরকার নির্দিষ্ট সেই জমিতে শিক্ষালয় বসানো হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সেই জমি ঘিরে ফেলেন ওই জমির ‘মালিক’। তার পর আবার সেই কার্তিকের ভিটেয়। স্বর্ণালি বলেন, ‘‘মার্চ মাসে কার্তিকবাবু এই চার ঘরের নতুন বাড়িটা আমাদের স্কুলের জন্য খুলে দিয়েছেন। আজকের দিনে ওঁদের মতো মানুষ খুবই দুর্লভ।’’
গ্রামবাসীরাও কার্তিকের এই ভূমিকায় অভিভূত। অশোক মণ্ডল নামে কার্তিকের এক প্রতিবেশী বলেন, ‘‘স্কুলের দাবি তো আমাদের দীর্ঘ দিনের। কিন্তু স্কুলবাড়িটা তৈরিই হল না। কার্তিক যে ভাবে নিজের জমি-বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে, তাতে ওর জন্য আমাদের গর্বের শেষ নেই।’’এই সব ‘প্রশস্তি’তে বিব্রত বোধ করেন কার্তিক-কল্যাণী। গোটা বিষয়টিকে তাঁরা নিজেদের ‘দায়িত্ব’ বলেই মনে করেন। কল্যাণীর কথায়, ‘‘আমরা একটা পাকা বাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু গ্রামের শিশুরা এ ভাবে কষ্ট করে পড়াশোনা করছে...
শহর থেকে মাস্টার-দিদিভাইরা এসে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় কষ্ট করে আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা দিচ্ছেন... ওদের মাঠেময়দানে রেখে আমরা পাকা বাড়িতে থাকব! তা আবার হয় নাকি! স্কুলের স্বপ্নটা তো আমাদেরও।’’
কার্তিকের খবর, তাঁর বাড়িতে স্কুল চলার খবর পৌঁছেছে জেলা প্রশাসনের কাছেও। এবং তাঁদের আশ্বাস, স্কুলবাড়ির সমস্যা এ বার মিটে যাবে। মালদহের জেলাশাসক নিতিন সিংহানিয়া আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘বিডিওকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বিএলআরওর সঙ্গে কথা বলে সরকারি জমি খোঁজ করে দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে হবে।’’ অন্য দিকে, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান বাসন্তী বর্মণ বলছেন, ‘‘বিষয়টি জানা ছিল না। শিক্ষার প্রসারে কার্তিকবাবুর এমন কাজ অতুলনীয়। তবে নতুন করে জমি চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে বলে জানতে পারলাম। দু’সপ্তাহের মধ্যেই জমি সংক্রান্ত যাবতীয় সরকারি জটিলতার সমাধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাস খানেকের মধ্যেই নতুন জমিতে বিদ্যালয় ভবন তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে বলে মনে হচ্ছে।’’ তবে এ সব কথা শুনে কার্তিক হাসছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁদের কাজ ওঁরা করছেন নিশ্চয়ই। আমি আমার কাজ করেছি। অনেক দিন ধরেই তো দেখছি-শুনছি। বাকিটা সময় বলবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy