Advertisement
১৫ জানুয়ারি ২০২৫

যেখানে হাত ধরেছে ইতিহাস ও পুরাণ

উত্তরাখণ্ডের লাখামণ্ডল। নৈসর্গিকতার সঙ্গে মিশেছে লোককথা বরফাবৃত হিমালয়ের চূড়া, পাইন গাছের সারি... ছবি তোলার অনেক রসদ রয়েছে।

মেঘের কোলে: মন্দিরচত্বর

মেঘের কোলে: মন্দিরচত্বর

ঈপ্সিতা বসু
শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২০ ০১:১৫
Share: Save:

ঘুমন্ত পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার জন্য বারণাবতে জতুগৃহ তৈরি করিয়েছিলেন দুর্যোধন। বিদুরের সহায়তায় সুড়ঙ্গপথে পালিয়ে বাঁচেন পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী। তাঁদের জীবন ফিরে পাওয়ার সেই সুড়ঙ্গপথ উত্তরাখণ্ডের লাখামণ্ডলে চোখের সামনে দেখলে যেন মহাভারতের সেই কাহিনি জীবন্ত হয়ে ওঠে। বারণাবত থেকে বারনাওয়া হয়ে আজকের লাখামণ্ডল পাহাড়-নদীর গায়ে এক মায়াচুম্বক, ইতিহাস আর পুরাণ দুই-ই যেখানে হাত ধরে রয়েছে।

শীতের এক দুপুর। আমরা দু’জনে গঢ়বাল হিমালয়ের রাস্তা ধরে চলেছি যমুনোত্রীর দিকে। মুসৌরির কিছু পর থেকেই যমুনা সঙ্গী হয়েছে। পাকদণ্ডী বেয়ে আরও খানিকক্ষণ চলার পরেই গাড়ি পৌঁছল পাহাড়ের কোলে এক অপরূপ জনপদ লাখামণ্ডলে। অনেকটা নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে যমুনা নদী, দূরে গঢ়বাল হিমালয়ের রেঞ্জ। আরও দূরে আবছায়া যমুনার উৎসস্থল যমুনোত্রী। বরফাবৃত হিমালয়ের চূড়া, পাইন গাছের সারি... ছবি তোলার অনেক রসদ রয়েছে। তাই অজান্তেই কখন যে ব্যাগের ভিতর থেকে ক্যামেরা বেরিয়ে এসেছিল, তা বুঝতে না বুঝতেই ক্লিক ক্লিক ক্লিক...

পেলাম এক স্থানীয় গাইড। তার সঙ্গী হয়ে পাহাড়ি রাস্তায় কিছুক্ষণ হাঁটার পরে পৌঁছলাম একটি বিশালাকার গহ্বরে। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, জতুগৃহ থেকে প্রাণ বাঁচাতে এই সুড়ঙ্গপথ ধরেছিলেন পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী, একই পথে আমরাও। কিন্তু সুড়ঙ্গ এতটাই গভীর ও তাতে এত বাঁক রয়েছে যে, বেশি দূর এগোনো গেল না আর। অবশ্য দুপুরের মিঠে রোদে লাখামণ্ডলের অপার্থিব নৈসর্গিক পরিবেশ ও ঝলমলে আকাশ দেখে মন বলছিল, কেন এই মুহূর্তগুলো ধরে রাখতে পারি না!

চঞ্চলা: পাহাড়ি বাঁকে যমুনা

অনেক চোখজুড়ানো জায়গাই দিনের আলো থাকতে থাকতে দেখে নিতে চেয়েছিলাম। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম এক বিশালাকার মন্দির চত্বরে। কোনও এক সময়ে এখানে অনেক মন্দির ছিল। খনন করে যা পাওয়া গিয়েছে চোখের সামনে, নামের সঙ্গে মিল পেলাম এই চত্বরেই। সেখানে বসেই গল্প বলছিলেন মন্দিরের পূজারি। স্থানীয়দের বিশ্বাস, উত্তরাখণ্ডের মোরা গ্রামে নাকি মৃত মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে। সিংহপুরা প্রদেশের রাজকুমারী ঈশ্বরা তা শুনেই রাজকুমার চন্দ্রগুপ্তের মৃতদেহ নিয়ে এসেছিলেন এখানে। রাজকুমারের দেহে নতুন প্রাণসঞ্চার হয়েছিল কি না, তা জানা নেই। কিন্তু গ্রামের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায়, রাজকুমারী তাঁর স্বামীর কল্যাণের উদ্দেশ্যে মোরা গ্রামে স্থাপন করেছিলেন শিবমন্দির। হয়তো তখন থেকেই এই অঞ্চলে শিববন্দনার শুরু। বিশাল পরিসর জুড়ে মন্দির ও পাশের এক বেদিতে বৃহদাকারের শিবলিঙ্গ চোখের সামনে দেখলে এই গল্পকেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে জাগে। শিবলিঙ্গের সামনে দু’টি মূর্তি, একটি মানব ও আর একটি দানব। স্থানীয় বাসিন্দারা আজও মনে করেন, মৃত্যুর পরে মানুষের মৃতদেহকে এই মন্দিরে এনে রাখা হত, মানব ও দানবমূর্তির মধ্যে থাকা একটি বিশেষ শিলার উপরে। মন্দিরের পূজারি পুজো করার পরে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মৃত শরীরে প্রাণসঞ্চার হত। লাখামণ্ডলের আর একটি নাম ছিল মোরা। এই নাম পুনর্জীবনের কাহিনির সঙ্গে মেলে। আসলে উত্তরাখণ্ড জুড়েই নানা ধর্মের, লৌকিক বিশ্বাসের গল্প। আর এর টানেই আমরা ছুটে আসি গঢ়বালে। আধ্যাত্মিকতা থেকে অ্যাডভেঞ্চার... লাখামণ্ডলে পুরোটাই প্রাপ্তিযোগ।

দাঁড়িয়ে আছ: সামনে মানব মূর্তি, পিছনে শিবলিঙ্গ

মন্দিরচত্বর ছাড়িয়ে একটু এগোতেই গ্রানাইট পাথরের একটি শিবলিঙ্গ চোখে পড়ল। গাইডের কথা মতো শিবলিঙ্গে জল ঢালতেই তার উপরে নিজের প্রতিচ্ছবি পরিষ্কার ফুটে উঠল। শিবলিঙ্গের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কাহিনি। প্রায় ৫০ বছর আগে কোনও এক ব্যক্তি বাড়ি বানাতে গিয়ে মাটি খুঁড়তেই সন্ধান পান এই শিবলিঙ্গের। গল্পের রেশ কাটিয়ে একটি বাঁকে ঘুরতেই শুধু চারপাশে জঙ্গুলে গন্ধ আর পাখি-পতঙ্গের ডাক সমগ্র অস্তিত্বে মিশে গেল।

যে যা-ই চান, লাখামণ্ডল যেন কল্পতরু! অনেক ট্রেকিং গন্তব্যের ডালি নিয়ে বসে আছে এই পার্বত্য উপত্যকা। সারা বছর আসা গেলেও বর্ষা এখানে বড়ই সুন্দর। হিমালয়ের ক্যানভাসে মেঘেদের আঁকিবুকি দেখেই কেটে যেতে পারে সারাটা দিন। রিমঝিম রাত, ভোর হতে পারে মেঘের কনসার্ট শুনেই। উত্তরাখণ্ডের নিসর্গ এ রকম সম্মোহনের কাজল পরিয়ে দেয় দু’চোখে। হিমালয়কে যতই দেখি না কেন, অধরাই রয়ে যায়। স্রেফ রোজকার রুটিন থেকে পালিয়ে দু’দণ্ড জিরোতেও হিমালয়ের কোলে মোরা গ্রামের হোমস্টে আদর্শ। এখানকার বাড়ির নির্মাণকৌশল চোখ টানে। অপূর্ব সব কাঠের কাজ। পাহাড়ি মানুষের সারল্য দেখে মনে হয়, কেন এমন সহজ ভাবে গোছাতে পারি না জীবনটাকে, কেন শুধু বাহুল্য দিয়ে সাজাই!

লাখামণ্ডলের জন্য সময় ছিল দু’দিন। পরবর্তী গন্তব্য যমুনোত্রী। তবে চাইলে অন্য পথে হরসিল হয়ে গঙ্গোত্রী ও গোমুখও ঘুরে নেওয়া যেতে পারে। আবার লাখামণ্ডল থেকে সফর শুরু করে ঘুরে নিতে পারেন মুসৌরি, ধনৌলটি, দেহরাদূন এবং হরিদ্বার।

উত্তরাখণ্ডের এই সফরে একই সঙ্গে সঙ্গী হতে পারে পর্বত, প্রকৃতি এবং পুরাণ।

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Tourism Uttarakhand Lakhamandal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy