রাজকীয়: রামেসিস ও নেফারতারির মূর্তি
আবু সিম্বল মন্দিরে ‘সান ফেস্টিভ্যাল’ পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। সেখান থেকে ঘুরে এসে লিখছেন পারমিতা ভদ্র পাইন
ভূগোলের পাতায় লেখা থাকত, ‘পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী’। সেই নীলনদ, মিশরের নীলনদ! তার বুকে ভাসছে আমাদের বিলাসবহুল ক্রুজ়। তিন রাতের আশ্রয়। মিশরের এক একটা শহর ঘুরে ফিরে এসেছি ক্রুজ়ে, তার উষ্ণ আতিথেয়তার ছায়ায়। এখনও সে সব দিনের কথা ভাবলে শিহরন জাগে। সোনালি স্মৃতি ফিরে ফিরে যায় ফ্যারাও-মমির দেশে।
লুক্সার, ভ্যালি অব দ্য কিংস, এসনা, এডফু ঘুরে পৌঁছলাম আসোয়ানে। সুন্দর ছিমছাম শহর। এখান থেকে যাব প্রায় ২৮০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ সুদান সীমান্তে সাহারা মরুভূমির মধ্য দিয়ে আবু সিম্বল মন্দির দর্শনে। ক্রুজ় থেকে বাসে উঠলাম রাত বারোটা নাগাদ। ব্রেকফাস্ট প্যাকেটও তখনই দিয়ে দেওয়া হল। এই রাস্তায় সন্ত্রাসবাদী হামলার ভয় রয়েছে, আগেই জানিয়েছিলেন ইজিপশিয়ান গাইড। এ রাস্তায় কোনও বাস একা যায় না। তাই সারি সারি টুরিস্ট বাস একসঙ্গে চলছে। সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে কনভয় চলছে অন্ধকারের বুক চিরে মরুভূমির মধ্য দিয়ে। বাসযাত্রীদের মনে আনন্দ থাকলেও, মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই! অজানা আশঙ্কায় সকলেই চুপচাপ। বাস ছুটে চলেছে তীব্র বেগে। মাঝেমধ্যে চেকপোস্টে বাস থামিয়ে স্নিফার ডগ নিয়ে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের এক অমাবস্যার রাত্রি। আকাশে চাঁদ না থাকলেও, পশরা সাজিয়ে বসেছে তারাপুঞ্জ। অবাক হয়ে দেখছিলাম, নক্ষত্রপতন। মনে হচ্ছে, আকাশে দীপাবলির বাজি ফাটছে। মনে পড়ল, ক’দিন আগেই তো কলকাতায় কালীপুজো হয়ে গেল! তখন আমি অবশ্য কায়রোর পথেঘাটে। আসলে দীপাবলির দিন ছাদে উঠে অন্ধকার আকাশে আলোর খেলা দেখতে খুব ভাল লাগে আমার। মনে হল, কলকাতার অভাব এই ভাবে পূর্ণ করে দিল মিশর।
সাড়ে চারটে নাগাদ পৌঁছলাম আবু সিম্বল। বাস থেকে নামতেই দেখলাম পর্যটকদের লম্বা লাইন মন্দির দর্শনের জন্য। আজ এখানে ‘সান ফেস্টিভ্যাল’। বৃহদাকার মন্দিরের ঠিক সামনেই লেক নাসের। লেক নাসের আসলে নীলনদের জলে পুষ্ট বিরাট এক হ্রদ। অপরূপ লেক নাসেরের সুনীল জলরাশির দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না! শুনলাম, সুগভীর প্রশান্ত এই হ্রদে রয়েছে বড় বড় কুমির।
স্থাপত্য আর ভাস্কর্যের যুগপৎ দর্শন মেলে পাহাড় কেটে তৈরি করা এই মন্দিরে। দু’টি মন্দিরের একটি ফ্যারাও দ্বিতীয় রামেসিস আর অন্যটি রানি নেফারতারির উদ্দেশে নির্মিত। ষাটের দশকে আসোয়ান হাই ড্যাম নামে সুবিশাল এক বাঁধ আর লেক নাসের নামে কৃত্রিম এক জলাধার নির্মাণের উদ্যোগ নেন মিশরের প্রেসিডেন্ট নাসের। জলাধারের জলস্তর বেড়ে গিয়ে মন্দিরের ক্ষতি হতে পারে, এই আশঙ্কায় মন্দির অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইউনেস্কোর এই ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট সরানোর কাজ শুরু হয় পঞ্চাশটি দেশের সহযোগিতায়। সম্পূর্ণ মন্দিরটি ২০-৩০ টন ওজনের বিশাল পাথরের ব্লক কেটে কেটে নতুন জায়গায় প্রতিস্থাপন করা হয়। হিসেব কষে নিখুঁত ভাবে সূর্যের কক্ষপথের সঙ্গে মন্দিরের অবস্থানকে আগের মতো করে মিলিয়ে দেওয়া হয়। এই অসাধারণ কাজটি শেষ করতে চার বছর সময় লেগেছিল।
মূল মন্দিরের গর্ভগৃহে পাথরের বেদিতে পরপর চারটি মূর্তি। ফ্যারাও রামেসিসের সঙ্গে তিন দেবতা আমুন, রা এবং টা। টা হলেন অন্ধকার জগতের দেবতা। এই মন্দির এমন ভাবে বানানো, যে বছরের দু’টি সুনির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি আর ২২ অক্টোবর (রামেসিসের জন্মদিন, রাজ্যাভিষেকের দিন যথাক্রমে) ভোরের সূর্যের প্রথম আলো মন্দিরের মূল ফটকের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে রামেসিস, আমুন ও রা-কে আলোকিত করে। এই দু’দিন মিশরে ‘সান ফেস্টিভ্যাল’ হিসেবে পালিত হয়। দেশ-বিদেশ থেকে বহু মানুষ এর আকর্ষণেই ভিড় করেন।
সুশৃঙ্খল ভাবে লাইন দিয়ে এগোনোর পরে মূল ফটকের কাছাকাছি আসতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। সূর্য তখন উঠি উঠি। ভিড়ের চোটে আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম আরও সামনে এগোনোর। চারদিকে বড় বড় পাথর। একটু অসাবধান হলেই পড়ে যাওয়ার ভয়। ভাবলাম, এই অপূর্ব দৃশ্য দেখা আর কপালে নেই বোধহয়। তবু সর্বশক্তি দিয়ে শেষ চেষ্টা করলাম, একটা পাথর ডিঙিয়ে উঁচুতে ওঠার। এমন সময়ে দু’টি শক্ত হাত আমাকে অনায়াসে টেনে উঠিয়ে নিয়ে কেউ একজন বলল ‘রিল্যাক্স’। আলাপ হল সেই শক্ত হাতের কৃষ্ণাঙ্গী মেয়েটির সঙ্গে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা। ডাক্তারি পড়ছে। মিশর ভ্রমণে সে-ও আমারই মতো একা। ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এগোতে থাকলাম মূল ফটকের দিকে। হঠাৎ দেখলাম, সকলে চিৎকার করে উঠল, ‘লুক, সানরাইস, সানরাইস...’
পিছনে তাকিয়ে দেখি, এক অপার্থিব দৃশ্য। লেক নাসেরের ঘন নীল জল থেকে এক বিশাল কমলা রঙের বল ধীরে ধীরে প্রকাশিত হচ্ছে। এক মুহূর্ত চারদিক চুপ। ভুলে গিয়েছি ফোটো তোলার কথা। হঠাৎ ক্লিক ক্লিক শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরল। চকিতে ঘুরে মন্দিরের গর্ভগৃহে তাকিয়ে দেখি, প্রথম সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে ফ্যারাও রামেসিসের মুখ। ক্ষণিকের এই রূপ আবার দেখা যাবে রাজার জন্মদিন ২২ ফেব্রুয়ারিতে। এর পর ধীরে ধীরে বাকি মন্দিরগুলি দেখলাম। দ্বিতীয় মন্দিরটি রানি নেফারতারি ও সৌন্দর্য-ভালবাসার দেবী হাথরকে উৎসর্গ করা। রাজার মন্দিরের তুলনায় আকারে ছোট হলেও, এই মন্দিরের স্থাপত্যও পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট আকর্ষক।
আবু সিম্বলের অনন্য মন্দির, অপরূপ লেক নাসেরের সুনীল জলরাশি মন ভরিয়ে দিল। বাসস্ট্যান্ডের কাছের দোকান থেকে কিছু স্মারক কিনে চললাম আসোয়ান বাঁধ দেখতে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy