Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Uttarakhand

বৈষ্ণো দেবীর পথে...

এ যেন এক অন্য বৈষ্ণো দেবী। অতিমারির মাঝেই প্রায় পর্যটকহীন রাস্তায় একাকী সফরের অভিজ্ঞতা।

দুর্গমগিরি: বৈষ্ণো দেবীর মন্দির।

দুর্গমগিরি: বৈষ্ণো দেবীর মন্দির।

ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪৫
Share: Save:

বাঙালি মানেই আড্ডাবাজ, ভোজনরসিক আর ভ্রমণবিলাসী। এই তিনটি গুণই আমার মধ্যেও বিদ্যমান। কিন্তু ২০২০ যে ভাবে শুরু হয়েছিল, তাতে ওই বছর বেড়ানোর আশা ত্যাগ করেছিলাম। ধরে নিয়েছিলাম, বছরটা চার দেওয়ালে বন্দি হয়েই থাকতে হবে। কিন্তু ২৮ নভেম্বর সকাল থেকেই মনটা নেচে উঠল বেড়াতে যাওয়ার জন্য। কোথায়? বৈষ্ণো দেবী দর্শন।

অভিনয় পেশা হওয়ায় টানা শুটিং চলে। ডেলি সোপের শুটিং থেকে বিরতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব ঠিক করলাম। নেট সার্চ করে দেখলাম ফ্লাইটের টিকিট নেই, একমাত্র রাস্তা রেলপথ। এক বন্ধুকে বললাম, সেই রাতেই আমাকে যে ভাবে হোক একটা ট্রেনের টিকিট জোগাড় করে দিতে। কপালজোরে বুকিংও হয়ে গেল। ৩৬ ঘণ্টার যাত্রা— কী করে সময় কাটবে, ভাবছিলাম! আবার অতিমারির কারণে মনের মধ্যে দুশ্চিন্তাও কাজ করছে। সবকিছুকে সঙ্গী করেই রাত বারোটায় ট্রেনে উঠলাম। প্রথম রাতটা ঘুমিয়ে কাটালেও, পরের দিনটা ট্রেনে আর সময় কাটতেই চায় না। মজার ব্যাপার, যে সব স্টেশনে দু’মিনিট ট্রেন দাঁড়াত, সেখানে দেখলাম ৩০ মিনিট ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারলাম, অধিকাংশ ট্রেন বন্ধ হওয়ায় প্রায় সব ট্রেন নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে বলে এই নয়া নিয়ম।

জম্মু পৌঁছে ট্রেন থেকে নামতেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। মুখ্য সড়কে এসে সরকারি বাসের দেখা মিলল। কিন্তু লোকভর্তি না হলে ছাড়বে না শোনায় দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল। স্টেশনে তো গুটিকয়েক লোককেই নামতে দেখেছিলাম। কিন্তু পরোপকারী সেই সরকারি বাসচালকের সহায়তায় এক ট্যাক্সিতে সওয়ার হলাম।

 রাতজাগা: আলো ঝলমলে কাটরা।

রাতজাগা: আলো ঝলমলে কাটরা।

কাটরা পৌঁছে হোটেলে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে অনলাইনে টিকিট কেটে ছুটলাম বৈষ্ণো দেবী দর্শনে। হোটেল থেকে চক পৌঁছতে সময় লাগল মিনিট চারেক। রাস্তার দু’ধারে দোকানপাট খোলা থাকলেও লোক নেই। অথচ অন্য সময়ে এখানে জনারণ্য, হাঁটার জায়গাটুকু মিলত না। চক থেকে অটোয় নামলাম ভবনের গেটে। সেখান থেকে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তা শুরু হয়েছে। খানিকটা এগিয়ে যে দোকান থেকে লাঠি কিনলাম, ঠিক তার পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে বানগঙ্গা যাওয়ার সিঁড়ি। ১৬ কিলোমিটার হেঁটে ওঠা, রাস্তার দু’ধারে অগুনতি দোকান, রেস্তরাঁ, মাসাজ পার্লার। কিন্তু অধিকাংশই বন্ধ। আবার কোনও দোকানের ভাঙা ছাদ দেখে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, এ বছর পর্যটকের অভাবে ৮০ শতাংশ দোকান বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে।

অসাধারণ সুন্দর বাঁধানো পাহাড়ি রাস্তা, তাতে অসংখ্য বসার জায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মনে পড়ল, গত বার যখন বৈষ্ণো দেবী এসেছিলাম, বসার জায়গা ভর্তি থাকায় রেলিংয়ের গায়ে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। পানীয় জলের বন্দোবস্ত রয়েছে প্রতি ১০০ মিটার অন্তর, গরম জলও পাওয়া যায়। হাঁটতে-হাঁটতে ততক্ষণে সন্ধে, উপর থেকে তাকিয়ে দেখি নীচের কাটরা শহর আলোয় সেজে উঠেছে। সাদা-লালচে আলোয় যেন হাজার-হাজার মণিমাণিক্য ছড়িয়ে রয়েছে। দেড় ঘণ্টা হাঁটার পরে পৌঁছলাম আধ কুঁয়ারি। এখান থেকে ব্যাটারিচালিত গাড়ি মন্দিরের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।

হঠাৎ উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, মায়ের মন্দিরের মাথায় ঝলমল করছে গুরুপূর্ণিমার চাঁদ। চট করে ছবি তুলে আবার হাঁটা শুরু করলাম। এখান থেকে পায়ে হাঁটা ও ঘোড়ায় চড়ে যাওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণ আলাদা। যে ক’জন স্থানীয় মানুষ ছিলেন, তাঁরাও আলাদা হয়ে গেলেন। গা ছমছমে নির্জন রাস্তা ধরে আমি একাই চললাম মাতারানির দর্শন করতে। ঠিক পৌনে ন’টায় পৌঁছলাম মন্দিরের দরজায়। তার আগে প্রসাদ কাউন্টার থেকে কিনে নিয়েছিলাম এক ব্যাগ প্রসাদ, যাতে ছিল নারকেল, লাল চেলি, মুড়ি, নকুলদানার প্যাকেট। জুতো খুলে প্যাঁচানো করিডোর দিয়ে পৌঁছে গেলাম ভিতরের গুহায়।

লক্ষ্মী, সরস্বতী আর মহাকালীর পিণ্ডরূপ হল বৈষ্ণো দেবী। মন্দিরের ভিতরে যেখানে অন্যান্য সময়ে এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর উপায় থাকে না, সেখানে এ বার আমি একা! দশ মিনিট মায়ের সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল, পর্যটকহীন রাস্তায় খাবারের অভাবে বাঁদরগুলির কষ্ট। তাই মায়ের কাছে আমার প্রার্থনা ছিল, ওই অসহায় জীবদের খাবার জুগিয়ে দেওয়ার জন্য।

তরঙ্গায়িত: দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের পর পাহাড়।

তরঙ্গায়িত: দিগন্তবিস্তৃত পাহাড়ের পর পাহাড়।

দর্শনের পরে ঘোড়া নিয়ে সরু অন্ধকার পাথুরে রাস্তা ধরে চললাম ভৈরোনাথের উদ্দেশে। গত বার যখন এসেছিলাম, এখানে তখন ঘোড়াওয়ালা দর হাঁকিয়েছিল ৪০০০ টাকা। এ বার ১৪০০ টাকায় রাজি হয়ে গেল কাটরা শহর অবধি পৌঁছে দিতে। কথায় বলে, মাতারানির দর্শন সম্পূর্ণ হয় ভৈরোনাথকে দর্শন করার পরেই। কোনও মূর্তি নেই সেখানে, একটি গহ্বরে কয়েকটি ত্রিশূল পোঁতা। দর্শন করে এ বার নামার পালা।

রাত এগারোটা বাজে তখন, ঘোড়ায় চড়ে নামছি। হঠাৎ দেখি, একটি ছেলে চলেছে আমার সঙ্গে। সে বাংলায় বলল, ‘‘আমিও দর্শন করে ফিরছি, চলুন ভয় নেই।’’ রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ এলাম আধ কুঁয়ারি। ঘোড়া থেকে নেমে চা খেতে গিয়ে দেখি, ছেলেটি আর সঙ্গে নেই। শুনেছি, মাতারানি অনেক রূপ ধরে সাহায্য করতে আসেন ভক্তকে, এ-ও কি তেমনই?

অন্য বিষয়গুলি:

Uttarakhand
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy