Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪

নির্জনতায় থমকে সময়

শান্তিনিকেতনের ভিড় এখানে নেই। কিন্তু দুবরাজপুরে আছে বীরভূমের মেঠো পথ, এলোমেলো হাওয়া আর দু’দণ্ড শান্তি সেটা ছিল অক্টোবরের এক দুপুর। বৃষ্টি হবেই— এমন পূর্বাভাস মাথায় নিয়ে প্রায় ৪২ কিমি পথ পাড়ি দিলাম। রাস্তাটা অবশ্যই চেনা ছিল না। কিন্তু আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে ভয়ই বা কী!

পাথুরে: মামা ভাগ্নে পাহাড়ের পথে

পাথুরে: মামা ভাগ্নে পাহাড়ের পথে

ঋষিকা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৯ ০০:৩২
Share: Save:

কলকাতায় বড় হওয়ার সুবাদে বোলপুর-শান্তিনিকেতন যাওয়া হয় বারবার। কিন্তু কিছুটা পর্যটকদের ভিড় এড়ানোর জন্য এ বার খুঁজছিলাম এমন জায়গা, যেখানে শান্তিনিকেতনের কাছে থেকেও বীরভূমকে চেনা যায় অন্য রকম ভাবে। তাই খোঁজ করেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছে, যার বাড়ি দুবরাজপুর। তারই উৎসাহে দু’দিনের বোলপুর-শান্তিনিকেতন সফরে গিয়েছিলাম দুবরাজপুরে। শান্তিনিকেতনে না থেকেও ইচ্ছে হলে থাকা যায় ছোট্ট গ্রাম মির্জাপুরে। আমরাও তাই করেছিলাম। মির্জাপুরে মপেড স্কুটার বেশ সহজলভ্য। তাতে চেপেই রওনা হওয়া গেল দুবরাজপুরে বন্ধু ইন্তাজ়ের বাড়ির দিকে।

সেটা ছিল অক্টোবরের এক দুপুর। বৃষ্টি হবেই— এমন পূর্বাভাস মাথায় নিয়ে প্রায় ৪২ কিমি পথ পাড়ি দিলাম। রাস্তাটা অবশ্যই চেনা ছিল না। কিন্তু আজকাল ইন্টারনেটের দৌলতে ভয়ই বা কী! আগে থেকেই জানতাম যে, প্রথমে আসবে ইলামবাজার। সে পথের দু’পাশ সবুজ গাছে ঘেরা। যত দূর চোখ যায়, তত দূর যেন শ্যামল সমুদ্র। সে রাস্তায় আকাশ উঁকি মারে গাছের ফাঁকে ফাঁকে। বীরভূমের বন বিভাগ বড় যত্নের সঙ্গে ইলামবাজারের এই জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণ করছে। লোকমুখে শুনলাম, এই বোলপুর-কবি জয়দেব রোডে সূর্যাস্ত দেখতে যান অনেকেই।

ইলামবাজার পৌঁছে রাস্তার ধারের দোকান থেকে চা খেয়ে ফের পথ চলা। অন্তত আরও এক ঘণ্টা যেতে হবে। স্কুটারে চেপে টানা পথ চলার আনন্দ তো ছিলই, সঙ্গে অবশ্য সাবধানীও হতে হয়েছে। উল্টো দিক থেকে ইট, সিমেন্ট, বালি বোঝাই বিশাল লরিরা হানা দিচ্ছিল বোলপুরের দিকে। আর আমরা এগিয়ে চলেছিলাম সেই সভ্যতার বিপরীতে। এক সময়ে পাকা রাস্তা থেকেই নেমে পড়লাম লাল মাটির পথে। ইন্তাজ়ের বাড়ি যখন পৌঁছলাম, সূর্য প্রায় মাঝগগনে। ওর মায়ের আতিথেয়তা ভোলার নয়। সুস্বাদু বিরিয়ানি খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম। এ বার পথপ্রদর্শক বন্ধুই।

সমাহিত: পাহাড়ের নীচে মন্দিরে

ফের লাল মাটির পথ ধরে এগোনো। চলতে চলতে থমকে গেলাম এক সুবিশাল লাল তোরণের সামনে। বিশাল ফটক খুলে স্বাগত জানাচ্ছে হেতমপুর রাজবাড়ি। বাংলার এক প্রত্যন্ত প্রান্তে পথের মাঝে হঠাৎই এই সুবিশাল স্থাপত্য দেখে চমকে উঠতে হয় বইকি! ফটকের উপরে এলোমেলো আগাছা। তোরণের উপরে পাথরের তৈরি ছোট ছোট পরি। বনেদিয়ানার আভিজাত্য ফুটে উঠছে কোনায় কোনায়। তোরণেই উঁকি দিচ্ছে ফলক। বোঝা গেল, চক্রবর্তী পরিবার এই রাজবাড়ি তৈরি করেছিল। বন্ধুর মুখে শুনলাম, সে সব অবশ্য বহু পুরনো কথা, প্রায় সপ্তদশ শতকের। ভিতরে ঢুকতেই দেখা মিলল কয়েকটি গাড়ির। ধুলো পড়ে যাওয়া সে সব গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে মলিন এক পার্কিং লটে। আর একটু এগোতেই জ্বলজ্বল করে উঠল সুবিশাল রাজবাড়ির মূল অংশ। গথিক আদলে তৈরি সেই রাজবাড়ি দু’ভাগে ভাগ করা আছে। এক দিকে এখন বিএড কলেজ চলে, অন্য দিকে বসে স্কুল। ভিতরে অবহেলায় পড়ে আছে একটি সুপ্রাচীন রথ। ইংরেজ আমলে তৈরি কাঠের পাল্কিটিরও অবস্থা একই। হলুদ রং করা রাজবাড়ি বাইরে থেকে দেখে মনে হয় ভালই রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়। কিন্তু ভিতরে ঢুকতেই বোঝা গেল, এটির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে আর বাকি নেই বেশি দিন।

খানিক মনখারাপ নিয়েই রাজবাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু মামা ভাগ্নে পাহাড়ের কাছে পৌঁছতেই সব মনখারাপ যে কোথায় মিলিয়ে গেল! বড় বড় গ্রানাইট পাথর একটির উপরে আর একটি বসে তৈরি হয়েছে এই পাহাড়। নীচে হালকা জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে পাহাড়ের উপরে ওঠা তেমন কষ্টকর নয়। পাহাড়ের উপরে ও নীচে রয়েছে দু’টি মন্দির। উপরে উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়। আমাদের বাংলার প্রত্যন্ত সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য রতন, তা তো জানা ছিল না আগে!

পাহাড় থেকে নেমে এগোলাম এক বাঁধের ধারে। ওখানকার ভাষায় এটি নীল নির্জন জলাধার। সারাদিন নৌকা ভাড়া নিয়ে সেই জলাধারে ভেসে থাকা যায়। বক্রেশ্বর নদীর উপরে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। নীল নির্জন জলাধার তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জল সরবরাহ করে। সেখানে দু’দণ্ড বিশ্রামের আশায় বসলাম। জলের ধারে কতশত পাখির ডাক। কী ভাবে যে সময় বয়ে গেল! সূর্য তখন পাটে বসেছে। কালো জলে গহীন অন্ধকার বাসা বাঁধছে ধীরে ধীরে। উঠে পড়লাম। ফেরার পথে একটি মাজার দেখা, রাস্তার ধারে চা-শিঙাড়া খাওয়া হল ঠিকই, কিন্তু মনটা যে পড়েই রইল ওই নির্জন বাঁকে।

অন্য বিষয়গুলি:

Travel Tourism Dubrajpur Birbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy