আশ্চর্য: সমুদ্রের মাঝে তানহা লো টেম্পল
মরুভূমিতে যেমন মরীচিকা ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, এখানেও ঠিক তেমনই। স্পষ্ট দেখছি, এক জায়গায় জলের রং গাঢ় নীল, ঠিক পাশের অংশটাই আবার টারকোয়েজ় ব্লু! কোথাও আবার পান্নারঙা জল। আলাদা আলাদা নয়, একই বিচে রঙের হরেক খেলা। গত তিন বছর কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়নি। তাই দু’বছরের ছানাকে নিয়ে বালি যাওয়ার পরিকল্পনা করার সময়ে অনেক দ্বন্দ্ব ছিল। বালির সমুদ্রতট সব দ্বিধা ভুলিয়ে দিল।
আমরা ছিলাম নুসা দুয়াতে। লোকেশন হিসেবে একটু প্রান্তিক হলেও এখানে সৌন্দর্যের প্রাচুর্য। বালির বড় বড় রিসর্ট এই অঞ্চলে। নুসা দুয়া সমুদ্রতট থেকে অনেকটাই উঁচুতে। পাহাড়ের খাঁজ কেটে তৈরি হোটেল থেকে লিফটে করে নামলেই সাদা বালির বিচ আর নীল জলের যুগলবন্দি। জমজমাট জায়গা পছন্দ হলে কুটা, সেমিনয়াক, জিমবারান... যে কোনও জায়গায় থাকা যেতে পারে। তুলনা করতে যাওয়া বৃথা। রিল্যাক্সেশনের পাশাপাশি বালির সৈকতে সানসেট দেখার এবং নৈশ পার্টির দুর্দান্ত বন্দোবস্ত। ওয়াটার স্পোর্টসেরও স্বর্গরাজ্য বালি।
তবে বালি মানেই বিচ নয়, তার বাইরে অনেক কিছু। বেড়ানোর প্রথম দিনটা আশপাশে ঘোরা ছাড়া কিছু রাখিনি। কারণ ৮ ঘণ্টার ফ্লাইটে (মাঝে ট্রানজ়িট ছিল) আমার দু’বছরের মেয়ে কিছুই খায়নি। তার জন্য খানিক বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন ছিল লেম্পুয়াং টেম্পল যাত্রা। সমুদ্রতট থেকে অনেকটা উপরের দিকে যেতে হয়। গাড়ি করে আড়াই ঘণ্টার পথ। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে চালক জানালেন, গাড়ি আর যাবে না। স্কুটি করে যেতে হবে লেম্পুয়াং টেম্পলে। শুনে আমার আর হাজ়ব্যান্ডের চক্ষুচড়ক! কেউ ঘুণাক্ষরেও এ সম্ভাবনার কথা বলেনি। এত দূর এসে ফিরে যাওয়া যায় না। মেয়েকে ক্যারিয়ারে বেঁধেই শুরু হল যাত্রা। সরু পথে মিনিট দশেকের চড়াই। তবে পথের সব ভয়, কষ্ট নিমেষে উধাও হয়ে যায় লেম্পুয়াং টেম্পলের সিগনেচার স্পটে পৌঁছলে। স্বর্গদ্বার কাকে বলে জানা নেই, তবে পাথরের দুই স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে অনন্তকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতাই আলাদা!
স্বর্গদ্বার: লেম্পুয়াং টেম্পল
সে দিনের চমক আরও বাকি ছিল। ফেরার সময়ে আমরা গিয়েছিলাম জিমবারান। বিচ জুড়ে সার দিয়ে কাফে-রেস্তরাঁ। বিকেলের মোলায়েম হাওয়ায় পানীয় আর স্ন্যাকস নিয়ে বসলে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায়... সুবিধে মতো বসে পড়লাম। একশো মিটারের মধ্যেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে। জিমবারানের কাছেই ডেনপাসার বিমানবন্দর। বিমান ওঠা-নামার দৃশ্য ভারী সুন্দর। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, যেন আলতো করে জল ছুঁয়েই গুটি গুটি এগিয়ে গেল প্লেনটা।
বালির সঙ্গে ধর্ম-সংস্কৃতিতে আমাদের দেশের অনেক মিল। কৃষ্ণ, গণেশ, কার্তিক, হনুমান বািলরও আরাধ্য দেবতা। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র দেব-দেবীর মূর্তি ছড়ানো। হিন্দু ধর্ম প্রাধান্য পেলেও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীরাও আছেন। রামায়ণ-মহাভারতের চরিত্রদের বীরগাথা স্থানীয়দের মুখে মুখে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম, আমাদের পুরাণের সঙ্গে অনেকটাই মিল। কুটা যাওয়ার রাস্তায় একটি বিরাট স্থাপত্য চোখে পড়ে। যুদ্ধরত দুই চরিত্র। একজন রথের উপরে বসে, আর একজন শূন্য থেকে তাকে আক্রমণ করতে উদ্যত। রথের উপরে বসে থাকা চরিত্রটি কর্ণ। আক্রমণ করছে ঘটোৎকচ। আমাদের কাছে ঘটোৎকচ পূজিত না হলেও, ইন্দোনেশিয়ায় তাকে বীরের সম্মান দেওয়া হয়।
রংমিলান্তি: কুটার সমুদ্রসৈকতে
বালিতে যেখানে-সেখানে হনুমান। উবুদ মাঙ্কি টেম্পল বালির মাস্ট ভিজ়িট স্পট। অদ্ভুত এর স্থাপত্য। পাথর কেটে তৈরি স্ট্রাকচারের সঙ্গে সবুজের সমারোহ। মাঙ্কি টেম্পল যেন জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। হনুমানরাই রাজা-প্রজা সব।
এশিয়ার সূর্যোদয়ের দেশ যদি জাপানকে বলা হয়, বালি তা হলে সূর্যাস্তের জন্য প্রসিদ্ধ। উলুওয়াতু টেম্পল গিয়েছিলাম সানসেটের ঠিক আগেই। সমুদ্র থেকে অনেক উঁচুতে পাহাড়ের কোলে তৈরি ওই মন্দির থেকে সূর্যাস্ত না দেখলে বেড়ানোটা সত্যিই অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সেখানেই একটি জায়গায় বালির প্রসিদ্ধ কেক্যাক ডান্স হয়। তবে আমরা তা দেখিনি। সেই নাচের মাঝে আমার মেয়ে নিজের অ্যাক্টিভিটি দেখাতে পারে, এমন সম্ভাবনা খুবই জোরালো ছিল কিনা!
বালির কিন্তামানি আগ্নেয়গিরি অন্যতম টুরিস্ট স্পট। ভোররাতে ট্রেক করে এখানে এসে অনেকে সানরাইজ় দেখেন। বালিতে কিছু অসাধারণ ওয়াটারফল আছে। রয়েছে অসংখ্য মন্দির। ধর্মীয় কারণে না হলেও, স্থাপত্য এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই সেগুলি দেখা যায়। তানহা লো টেম্পল সে রকমই একটি দ্রষ্টব্য। পার থেকে খানিক দূরে জলের মধ্যে এই মন্দির। পায়ে হেঁটে জল পেরিয়ে যেতে হবে। আমরা গিয়েছিলাম ভাটার সময়ে। মন্দির থেকে ভিউ অসাধারণ। ভারত মহাসাগরের নীল জলরাশি আছড়ে পড়ছে মন্দিরের গায়ে। ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে সে ছবি মনে বন্দি করে রাখার।
কোথাও গিয়ে স্থানীয় খাবার খাওয়াই দস্তুর। নাসি গোরেং, বালি নাসি— ভারতীয় জিভেও দিব্যি মানানসই। আসলে এদের প্রধান খাদ্য ভাত। বাঁশ বা কলাপাতার টুকরিতে তা পরিবেশন করে। কলা দিয়ে তৈরি এক রকমের ডেজ়ার্ট বেশ উপভোগ্য।
তবে সবচেয়ে ভাল লাগার মুহূর্ত বিচের ধারে নৈশভোজ। পারের উপরে আছড়ে পড়ছে তরঙ্গরাশি। সেই গমগমে শব্দও চার দিকের নৈঃশব্দ্য কাটাতে পারছে না। ক্যান্ডল লিট ডিনারের আদর্শ পরিবেশ। মেয়েকে মোবাইলে মগ্ন করে ওই সময়টুকু শুধু আমাদের নিজেদের।
দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy