হিমালয়ের বললেই সুনীল আকাশ, সূর্যালোকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠা শ্বেতশুভ্র পাহাড়চূড়ার রূপ ভেসে ওঠে। উদিত সূর্যালোকে কখন তা কখনও রক্তিম, কখনও তার গায়ে স্বর্ণাভ দ্যুতি। কখনও সেই পাহাড়ের আশেপাশে লেগে থাকে জমাট বাঁধা মেঘ, কখনও তাকে আবৃত করে রাখা কুয়াশা।
কোনও এক জাদুবলে সেই সাদা ধোঁয়ার চাদর সরলে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে এক বিশেষ প্রজাতির ফুল। উজ্জ্বল লাল, গোলাপি রং তার। অপূর্ব দ্যুতি। পাহাড়ি পথের পাশে চারদিক আলো করে ফুটে থাকা এক ফুলকেই সিকিমে বলে ‘গুরাস’। আর বিশ্ব চেনে ‘রডোডেনড্রন’ নামে।

হিলে থেকে ভার্সের পথে ফুটে রয়েছে এমনই সব ফুল। —নিজস্ব চিত্র।
হিমালয়ের বরফাবৃত চূড়া, নিবিড় প্রকৃতি, পাহাড়ি পথে বয়ে চলা নদী যদি কারও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়, তবে কারও ভাললাগা, ভালবাসা এই রডোডেনড্রন। বছরভর তার দেখা মেলে না। তবে শীতের প্রাবল্য কমলে, বসন্তের সূচনায় গাছ ভরে ফুলে। দার্জিলিং, সিকিম হিমালয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে তার দেখা মেলে। শুধু সেই রূপের টানেই ছুটে যাওয়া চলে পাহাড়ে।
দার্জিলিং, নেপাল, সিকিম-সহ হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ফুটে থাকা এই ফুল নিয়ে কতই না গল্প, কবিতা! শুধু ভারতীয় নয়, বিদেশের উপন্যাসেও ঠাঁই করে নিয়েছে এই রঙিন পুষ্পরাশি। উচ্চতা ভেদে তার প্রজাতির রকমফের ঘটে। হিমালয়ের এক এক অংশে এক এক রকম প্রজাতির রডোডেনড্রন মেলে। কোথাও গোলাপি, কোথাও বেগনি, কোথাও তা উজ্জ্বল কমলা।
ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে রডোডেনড্রেন ফোটা শুরু হলেও সিকিমের বিভিন্ন প্রান্ত এখনও ফুলে রঙিন। ৩৬ রকমের রডোডেনড্রেন রয়েছে এ রাজ্যে। এপ্রিলে কোথায় গেলে দু’চোখ ভরে দেখতে পাবেন রকমারি গুরাস।
হিলে-ভার্সে ট্রেক

গাছ ভরে রয়েছে উজ্জ্বল ফুলে। একেই বলে ‘গুরাস’। ছবি: সংগৃহীত।
ট্রেক করেননি কখনও? তবে হিমালয়, মেঘ-কুয়াশা, ফুটে থাকা গুরাস সব কিছু একসঙ্গে দেখতে চাইলে, উপভোগ করতে হলে হাঁটতেই হবে। পশ্চিম সিকিমের এক ছোট্ট ট্রেকিং রুট। কেউ বলেন বার্সে, কেউ ভার্সে। ভার্সে ট্রেকিং শুরু হয় হিলে থেকে। থাকা যায় হিলেতে। এ ছাড়া অনেকে থাকেন ওখড়েতেও। হিলে-ভার্সের ট্রেকিং পথের দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের মতো। ঘণ্টা তিন-চারেকেই হয়ে যায়। চাইলে আরও বেশি ক্ষণ ধরে পথের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন। এই পথে বৃষ্টি সঙ্গ দেয় যে কোনও ঋতুতেই। কুয়াশাও ঘিরে থাকে আশপাশ। তবে মেঘ-কুয়াশার বাড়াবাড়ি না থাকলে দেখা যায় ফুলের বিস্তার। এই পথে, লাল, গোলাপি আবার কিছু কিছু সাদা রডোডেনড্রনও চোখে পড়ে। যদি সম্পূর্ণ পথ না-ও হাঁটতে পারেন, কিছুটা ঘুরে একই পথে ফিরে আসাও সম্ভব।

হিলে থেকে ভার্সে যাওয়ার পথে ফুটে রয়েছে এমনই ফুল। —নিজস্ব চিত্র।
কী ভাবে যাবেন
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে হিলের দূরত্ব ১৩৬ কিলোমিটার। ভার্সের দূরত্ব ১৪৬ কিলোমিটার। পৌঁছতে সাধারণত সময় লাগার কথা তিন-চার ঘণ্টা। কিন্তু রাস্তার পরিস্থিতির উপর সময়টা নির্ভর করে পাহাড়ে।
ভার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারিতে ঢুকতে হলে অনুমতি নিয়ে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। রাতে থাকতে হলে এক রকম। আর এক দিনেই গিয়ে ফিরতে হলে আর এক রকম।
ইয়ুমথাং ভ্যালি

বরফের আচ্ছাদন সরলে সবুজ হয়ে ওঠে উপত্যকা। ফোটে ফুল। ছবি:সংগৃহীত।
উত্তর সিকিমের অন্যতম আকর্ষণ গুরুদোংমার হ্রদ এবং ইয়ুমথাং ভ্যালি। তবে রডোডেনড্রেন দেখতে হলে সেখানে যেতে হবে এপ্রিলের শেষে। উত্তর সিকিমের লাচুংয়ের কাছে রয়েছে সিংবা রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারি। এপ্রিলের শেষে লাচুং থেকে ইয়ুমথাং হয়ে জিরো পয়েন্ট যাওয়ার পথেই দেখা মেলে রকমারি ফুলের। চুবা সাগোচেন পর্বতমালা রয়েছে স্যাংচুয়ারির পূর্বে, পশ্চিমে চমজ়েমাই তোসো, লাভা পাসের বিস্তীর্ণ পাহাড়ের অংশ। এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত রকমারি রডোডেনড্রনের দেখা মেলে এখানে।
কী ভাবে যাবেন?
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে গ্যাংটক ১২০ কিলোমিটার। গ্যাংটক হয়ে গাড়িতে লাচুং আসতে হয়। শিলিগুড়িতে বাগডোগরা বিমানবন্দর এবং সিকিমের পেকিয়াং বিমানবন্দর রয়েছে। সেখান থেকে সড়ক পথে গ্যাংটক হয়ে আসা যায়। লাচুং-এ থাকার জন্য রয়েছে হোটেল এবং হোম স্টে।
সান্দাকফু

সান্দাকফু গেলেও দেখা মিলবে রডোডেনড্রনের। ছবি:সংগৃহীত।
সান্দাকফু থেকে ফালুটের পথে দেখা মেলে লাল, গোলাপি, সাদা রডোডেনড্রনের, সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের ঘন সবুজ প্রকৃতি, তারই মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে থাকা ফুলের আকর্ষণে দূর-দূরান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে বেড়াতে আসেন। সামানদেন এবং মলিতে সবচেয়ে ভাল রডোডেনড্রন দেখা যায়। এই পথে হেঁটে গেলেই ফুলের শোভা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যাবে। পথের দু’ধারে গাছ ভরে থাকে রঙিন ফুলে।
কী ভাবে যাবেন?
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখান থেকে গাড়িতে মানেভঞ্জন। দূরত্ব প্রায় ৯০ কিলোমিটার। ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে। মানেভঞ্জন থেকে ট্রেকিং শুরু হয়। তবে সান্দাকফু এখন গাড়িতেও যাওয়া যায়। সান্দাকফু থেকে ফালুট পুরো পথ ট্রেক করতে দিন ছয়-সাত সময় লাগে।