Advertisement
E-Paper

নক্ষত্রের নৈবেদ্য, জলসংক্রান্তির বারো পুকুর

বাবু নন্দরাম সেন একটি অট্টালিকা  নির্মাণ করেন শিবাবলি ব্রত পালনের জন্য। বসুমল্লিকদের চিত্রগুপ্ত পুজো দেখতে জড়ো হতেন বহু মানুষ। সিদ্ধার্থ বসুবাবু নন্দরাম সেন কলকাতায় এসে যে ব্রত চালু করেছিলেন, তা ছিল যেমন চমকপ্রদ, তেমনই অভিনব।

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২০ ০০:১১
Share
Save

পুরনো কলকাতা তখনও পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি, কিন্তু তত দিনে আসতে শুরু করেছেন বাইরের মানুষজন। তাঁরাই শুরু করেছিলেন বন কেটে বসত তৈরির কাজ। এঁদেরই এক জন নন্দরাম সেন। দক্ষিণ গাঙ্গেয় অঞ্চল থেকে শোভাবাজারে এসে উঠেছেন নন্দরাম। তবে আগে থেকেই তাঁর শোভাবাজারের জমির পাট্টা নেওয়া ছিল। কলকাতার জনবসতি তখনও তেমন করে জমে ওঠেনি।

বাবু নন্দরাম সেন কলকাতায় এসে যে ব্রত চালু করেছিলেন, তা ছিল যেমন চমকপ্রদ, তেমনই অভিনব। সেই ব্রত পালনের সময় সন্ধ্যাকাল— ‘নিত্যসেবা স্থির হয় সকল দেবের/ শিবাবলি ব্রত হয় সন্ধ্যায় পুণ্যের॥’ সেই আশ্চর্য ব্রত পালন শুধু ঘণ্টা নেড়েই শেষ হত না, তার আয়োজনের ঘটাও ছিল খুব! কেমন ছিল সেই আয়োজনের বহর? ঠাকুর চাকর রেখে রোজ রাঁধা হত পুজোর পঞ্চাশ ব্যঞ্জন ভোগ।

রোজ নতুন-নতুন থালা-বাসনের ব্যবস্থা করা হত এই সব পদ সাজিয়ে রাখার জন্যে। কিন্তু এত কাণ্ডের পর প্রশ্ন হচ্ছে, এত রকমারি রান্না খাবে কে! কখনই বা সাজিয়ে দেওয়া হবে এই থালায় সাজানো হরেক পদ বিগ্রহের সামনে? আর সেই বিগ্রহই বা কোথায়?

আছে বটে বিগ্রহ, তবে তা সাবেকি ধরনের আর পাঁচটা প্রচলিত বিগ্রহের মতো নয়। এই বিগ্রহের দর্শন পেতে অপেক্ষা করতে হবে সূর্য অস্ত যাওয়া অবধি। সন্ধের অন্ধকার না নামলে এর দর্শন পাওয়া যায় না। রাত যত গভীর হবে, ততই এই বিগ্রহের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পাবে।

এই পূজায় পূজ্য হলেন নক্ষত্র-দেবতারা। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার ভেদ করে আকাশের বুকে ফুটে ওঠা নক্ষত্রের সমারোহের উদ্দেশেই নিবেদিত হয় পুজোর উপচার, ভোগ-আরতি। উন্মুক্ত আকাশের নীচে থরে থরে নতুন থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয় ভোগ। প্রার্থনা করা হয়, অন্ধকার আকাশ থেকে নক্ষত্রমণ্ডলী নেমে আসবে পৃথিবীর বুকে, গ্রহণ করবে উজ্জ্বল থালায় রাখা এই সুস্বাদু ভোগ। অপেক্ষায় থাকত পরিবারের সবাই।

ব্রতের নিয়ম পদ্যের ছন্দে বলা হয়েছে এই ভাবে— ‘সন্ধ্যা পরে লক্ষ লক্ষ শিবা উপস্থিত/ প্রত্যেকেতে আলাহিদা খায় পরিমিত॥ সর্বরাত্রি বাটী মধ্যে থাকিত শুইয়া/ প্রাতেতে মঙ্গলধ্বনি সকলে করিয়া॥ অরণ্যে যাইত চলি দিবা আগমনে/ পুনঃ সন্ধ্যা কালে পৌঁছে খাইত সেখানে॥’ একেই বলা হত ‘শিবাবলি ব্রত’, যা আজকের কলকাতার জনজীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। সে দিন এই ব্রত পালনের জন্য একটি অট্টালিকাও নির্মাণ করেছিলেন নন্দরাম সেন।

শুধুমাত্র এই একটি ব্রতই নয়, সেই সময়ের কলকাতায় আরও একটি ব্রতের সঙ্গেও নন্দরাম সেনের নাম জড়িয়ে আছে। বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে তখন কলকাতার অবস্থা কাহিল। খর রোদের তাতে যেন সারা পৃথিবী জ্বলছে। ফুটিফাটা মাঠঘাট। এই প্রচণ্ড রোদের তেজ থেকে মুক্তি পেতে নন্দরামের বৃদ্ধা মা বললেন, ‘জলসংক্রান্তি ব্রত’ পালন করার কথা। নন্দরাম মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে তক্ষুনি ডেকে পাঠালেন পণ্ডিতদের। তাঁরা হাজির হয়ে বিধান দিলেন, দ্বাদশ কুম্ভের জল দান করাই বিধেয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠল, কিসের কুম্ভ? সোনা, রুপো, পেতল না মাটির কুম্ভ? পণ্ডিতদের অভিমত, কলসিতে করে জল দানই শ্রেষ্ঠ দান। কিন্তু এ কথা সেন মহাশয়ের মনঃপূত হল না। তিনি জানতে চাইলেন, এর চেয়ে ভাল বিধান কি হয় না! আসলে ব্রত পালন হবে, অথচ তাতে ব্যয়বহুল আড়ম্বর থাকবে না, তাতে কি মানীর মানরক্ষা হয়! বাবুর মতিগতি বুঝে পণ্ডিতমশাইরা শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বিস্তর পর্যালোচনার পর, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা বিধান দিলেন— ‘স্বর্ণকুম্ভ হৈতে শ্রেষ্ঠ যদি হে মনন/ পুষ্করিণী কিম্বা কূপ কর হে খনন॥’ অর্থাৎ, সোনার কলসিতে করে জলদানের চেয়েও উত্তম পন্থা হল কূপ বা পুষ্করিণী খনন।

এ বার সেনমশাই পড়লেন বিপদে। সময় মাত্র একটা বছর, এর মধ্যে বারোটা পুকুর কাটা হবে কেমন করে, আর এক দিনে সেই জল ঢালাই বা হবে কী করে! মহা সমস্যা। সমাধান করলেন তাঁর গুরুদেব বিশ্বনাথ তর্কবাগীশ। তাঁর নিবাস ভাটপাড়ায়। তিনি স্বপ্নাদেশ দিলেন, এগারোটা পুকুরের জল একটি পুকুরে এনে সেই পুকুরটা উৎসর্গ করলেই সব ক’টা পুকুরই উৎসর্গ করা হবে। পরে মাকে

সেই পুকুর প্রদক্ষিণ করিয়ে আনলেই ব্রত সম্পন্ন। অবশেষে এই বিধান মেনেই উদ্যাপিত হল জলসংক্রান্তি ব্রত। এখন এই ব্রত আর পালন করা হয় না।

এ প্রসঙ্গে হারিয়ে যাওয়া একটি পুজোর কথা স্মরণ করতেই হয়। সে পুজোও কিছু কম বিচিত্র ছিল না। আর সেই কারণেই তা স্মরণীয় হয়ে আছে। ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিন কলকাতার ২২ নম্বর রাধানাথ মল্লিক লেনের বসুমল্লিক পরিবারের এই পুজো দেখতে রীতিমতো জনসমাগম ঘটত। যে সে পুজো নয়, সাক্ষাৎ যমরাজের ডান হাত চিত্রগুপ্তের পুজো! মাটির তৈরি চতুর্ভুজ মূর্তি। হাতে তার গদা, অসি, কলম আর কালির দোয়াত। সামনে থাকত

তার বাহন মহিষ। পুজোর পরে ঘটা করে বির্সজন দেওয়া হত এই চিত্রগুপ্তের মূর্তি।

এই পুজো নিয়ে গানও বাঁধা হয়েছিল। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১১, ১৩ ও ১৪ পৌষ তারিখে রাজা রাধাকান্ত দেবের বাড়িতে আয়োজিত হয়েছিল ‘নিখিল ভারতবর্ষীয় কায়স্থ মহাসম্মেলন’। এই অধিবেশন উপলক্ষে অরুণকুমার ঘোষ একটি গান রচনা করেন। সেই গানে চিত্রগুপ্তের উল্লেখ পাওয়া যায়—

‘বিস্তীর্ণ ভারতভূমে/ চিত্রগুপ্ত বংশধরেরা/ আছে নানান দিকে।

কিছু ভিন্ন হলেও তবু/ মূলে তারা সবাই এক/ সন্দেহ নাই কভু॥’

আর একটি গানেও চিত্রগুপ্তের সন্ধান পাওয়া যায়। লেখক মুনীন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী। সব ক্ষেত্রেই চিত্রগুপ্তকে অভিহিত করা হয়েছে কায়স্থ কুলের আদি পুরুষ হিসেবে—

‘কায় হতে যারে সৃজিল ব্রহ্মা/ কায়স্থ হল সে ধন্য॥ শুধু নহে মসী, করে তার অসি/ ক্ষত্র বলিয়া গণ্য॥ অনাদিকালের চিত্রগুপ্ত/ পুরাণ পুরুষ তার॥ সেই জাতি আজ ঘোষিত বিশ্বে/ মহিমায় আপনার॥’

এই সব ব্রত-পার্বণ ও পুজো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক-এক করে হারিয়ে গিয়েছে আধুনিক কলকাতার ব্যস্ত নগরজীবন থেকে।

Nandaram Sen Kolkata Star Puja

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।