কঠিন সময়ে সবসময় পাশে থেকে ঋদ্ধিকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন স্ত্রী রোমি। ছবি— ঋদ্ধিমানের ফেসবুক পেজ থেকে।
কখনই নিজের উপরে আস্থা না হারানো। যে যতই এগিয়ে যাক, তা মন থেকে ছেঁটে ফেলে দেওয়া। শুধুই নিজের স্কিলে শান দিয়ে চলা। অবশ্যই বিশ্বাসে অটুট থেকে। চুম্বকে ঋদ্ধিমান সাহার টেস্ট ক্রিকেটে অসাধারণ প্রত্যাবর্তনকে এ ভাবেই চিহ্নিত করতে চাইছে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল।
গত বছরের জানুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলেছিলেন শেষ টেস্ট। তারপর বছর দেড়েকেরও বেশি থাকতে হয়েছে বাইরে। অস্ত্রোপচার, রিহ্যাব, ফিরে আসার লড়াই খুব কাছ থেকে দেখেছেন কোচ জয়ন্ত ভৌমিক। বাবা প্রশান্ত সাহা জুগিয়েছেন মানসিক জোর। আর এই কঠিন সময়ে সবসময় পাশে থেকে উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন স্ত্রী রোমি। পুণে টেস্টে ক্রিকেটমহলের উপচে পড়া প্রশংসা যখন ঋদ্ধিতে সিদ্ধিলাভের ঘোষণা করছে, তখন এঁদের মনে পড়ছে লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা।
দমবন্ধকরা একটা চাপের মধ্যে ছিলেন রোমি। পুণে টেস্টের পর তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন তিনি। ফোনে আনন্দবাজারকে সাফ বললেন, “অনেক লম্বা সময় ধরে খাটাখাটনি করেছে। ধৈর্য রেখেছে। হাল ছাড়েনি। যে পর্যায়ে ছিল, তাতে অন্য কেউ হলে হয়ত কামব্যাক করত না। এটা আমি দুশো শতাংশ নিশ্চিত।”
আরও পড়ুন: বাঁ হাতে অবিশ্বাস্য ক্যাচ ঋদ্ধির, কিরমানির কথা মনে পড়ল গাওস্করের
শিলিগুডি়তে বাড়িতে পাওয়া গেল পরিতৃপ্ত পিতাকে। যিনি টিভিতে ছেলের কিপিং নিয়ে বিরাট কোহালির মন্তব্যে উচ্ছ্বসিত। বললেন, “স্ট্রাগল পিরিয়ডে সবারই মন খারাপ থাকে। কিন্তু ও মন খারাপ করে থাকত না। এগিয়ে যেতে হবে, এই ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। জেদ ছিল, কনফিডেন্সও ছিল যে আমাকে ফিরতে হবে। পাশাপাশি, ওর কাছে একটা চ্যালেঞ্জও ছিল যে ফিট হয়ে এসেছি। এ বার আগের মতো খেলতে হবে। ও সবসময় চাইত দেশের হয়ে কিছু করতে। সেটা পেরেছে। এটাই তৃপ্তির।”
টিভির সামনেই আগাগোড়া বসেছিলেন ছেলেবেলার কোচ জয়ন্ত ভৌমিক। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে শব্দ হাতড়াতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর কথায়, “কেমন লাগছে তা কি আর ভাষায় বোঝাতে পারব? দীর্ঘদিন মাঠের বাইরে ছিল, খেলার বাইরে ছিল। এ ভাবে ফিরতে দেখে তাই আবেগ ঘিরে ধরছে।” গর্বিত কোচের মনে পড়ছে আগের কথা। যখন হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থাতেই শিলিগুড়িতে তাঁর ক্যাম্পে এসে দিনভর কাটিয়েছেন ঋদ্ধিমান। স্মৃতিচারণের ভঙ্গিতে তিনি বললেন, “অপারেশনের পর অনেকবারই শিলিগুড়ি এসেছিল। হাতে কালো ব্যান্ডেজ নিয়ে সারাদিন বসে থাকত আমার ক্যাম্পে। তারপর সুস্থ হয়ে উঠে এখানেই প্রথম ব্যাট করেছিল। আমিও চাইছিলাম ওর ব্যাটিং দেখতে। কংক্রিটে করেছিল। এটা কয়েক মাস আগের কথা। শিলিগুড়ি এলে ও তো ঘর ছাড়া আমাদের মাঠে এসেই সময় কাটাত। এখানে কচিকাঁচাদের উৎসাহ দিয়েছিল।”
ঋদ্ধির একটা কথা শিলিগুড়ির ‘ভাইদা’-র মনে স্থান করে নিয়েছে চিরকালের। ক্রিকেট-শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ময়দানের পাপালি বলেছিলেন, তাঁর কোচ জয়ন্ত ভৌমিকের কথা যেন পুরোপুরি শোনা হয়। কোচের কথায়, “ঋদ্ধি বলেছিল মাঠের মধ্যে ও মাঠের বাইরে ভাইদা যেগুলো বলে, সেগুলো যদি ১০০ শতাংশ শুনতে পারিস, তবে ঠিক একটা জায়গায় পৌঁছবি। এই কথাটা আমার কানে এসেছিল। শুনে উপলব্ধি করলাম, আমার কথা ও ঠিক কেমন ভাবে নেয়। খুব ভাল লেগেছিল।”
সাহা পরিবারে আবার ক্রমশ বিষণ্ণতা গ্রাস করছিল। টিভিতে খেলা দেখা হয়ত বন্ধ হয়নি। তবু কোথাও একটা আক্ষেপ ছিলই যে ঘরের ছেলেটাকেই দেখার কথা ছিল লাইভ কভারেজে। কিন্তু তা হচ্ছে না। উল্টে অস্ত্রোপচারের পর কবে গ্লাভস হাতে দেখা যাবে সেটাই অনিশ্চিত লাগছে। বাবার কথায়, “আমরা ভরসা হারাইনি। কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে কখনও কথা হত না ওর সঙ্গে। অপারেশন হওয়ার পর ডান হাতে সাড় ছিল না একসময়। বাঁ-হাত দিয়েই সব করতে হতো। জানতাম, ও চেষ্টা করছে ফেরার। তাই এই প্রসঙ্গে কিছু বলে চাপ বাড়াতে চাইনি।”
রোমিও ঠিক তাই করতেন। ক্রিকেটীয় ব্যাপারে আলোচনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। রিহ্যাবের জন্য অনেক দিন বাড়ির বাইরে থাকতে হয়েছিল ঋদ্ধিকে। তখন মেয়ের ব্যাপারে ফোনে কথা হত, কথা হত ঘরোয়া টুকিটাকি নিয়েও। কিন্তু ক্রিকেট নৈব নৈব চ। রোমি বললেন, “ইচ্ছা করেই বলতাম না খেলা নিয়ে। আমার কিন্তু মারাত্মক মন খারাপ হয়েছিল। হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এর আগেও যুবরাজ সিংয়ের বিয়ের সময় ও চোট পেয়ে টেস্ট খেলতে পারেনি। তখনও কষ্ট পেয়েছিলাম। এ বারও ফেরা সহজ ছিল না। অপারেশনের পরে সুস্থ হয়ে উঠতে অনেক সময় লেগেছিল। বিশেষ করে ও যে স্টেজে দাঁড়িয়ে, তাতে সময়টা চাপে ফেলে দেওয়ার মতোই।”
আরও পড়ুন: চারদিনেই শেষ পুণে টেস্ট, ইনিংস ও ১৩৭ রানে জিতল ভারত, পকেটে সিরিজও
প্রশ্ন হল, ঋষভ পন্থ যে ভাবে তিন ফরম্যাটে দলের ভরসা হয়ে উঠছিলেন, তাতে কি মানসিক চাপ সত্যিই আসেনি ঋদ্ধির উপর? জায়গা হারানোর আশঙ্কা কি কখনই ঘিরে ধরেনি ছাত্রকে? কোচ শোনালেন, “দেখুন, চোট পাওয়া কিন্তু খেলারই অঙ্গ। সবারই এটা হতে পারে। জানতাম, ও যে মানসিকতার ছেলে, তাতে একশো শতাংশেরও বেশি ফিটনেস নিয়ে ফিরবে। যে মর্যাদা নিয়ে খেলত, তা নিয়েই ফিরে আসবে, এই বিশ্বাস জোরদার ছিল। আর ঋদ্ধির মধ্যেও কোনও সংশয়, চিন্তা বা উদ্বেগ ছিল না। সবসময় পজিটিভ ছিল যে, নিজের জায়গা খেলা দিয়েই ফিরে পাবে। পারফর্ম করেই আসতে হবে।” এই মনের জোরই সবার শেখার বলে বিশ্বাস করেন তিনি। জয়ন্ত ভৌমিকের মতে, “বরাবরই মনে জোর ছিল। সঙ্কল্পবদ্ধ ছিল। ফুল স্ট্রং ছিল। কে ভাল খেলল, তা নিয়ে ভাবেনি কখনও। লড়াই করে আসতে হবে, জানতাম। আর এই পর্যায়ে লড়াই তো থাকবেই। না থাকলে তো দেশের প্রতিনিধিত্ব করাটাই সহজ হয়ে গেল। ঋদ্ধিও সেটা বিশ্বাস করত।”
রোমি ধরিয়ে দিলেন ক্রিকেটের চিরন্তন সত্য। বললেন, ‘ব্যাট-গ্লাভস না ধরলে তো কেউ মনে রাখে না। এখন আবার ধরেছে। তাই আগের কথাগুলোই আবার বলা হচ্ছে। ওকে বিশ্বের সেরা তো এই প্রথম বলা হচ্ছে, এমন নয়। আগেও বলা হয়েছে। কিন্তু চোটের জন্য নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ ও পাচ্ছিল না। সেটা পেয়েছে বলেই এত প্রশংসা। কোয়ালিটি অনুযায়ী ও যে যথেষ্ট ভাল, এটা নিয়ে কিন্তু কোথাও সংশয় ছিল না।’
শুনতে শুনতে মনে হল যাবতীয় প্রতিকূলতাও টলাতে পারেনি ঋদ্ধির মনকে। কঠিন সময়েও ‘সুপারম্যান সাহা’ হয়েই লড়ে গিয়েছিলেন। আর এত প্রশংসা সে জন্যই ঝরে পড়ছে আবারও!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy