Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

ফুটবলের বৃত্ত উপচে জীবনের জয়গান

ফুটবল মানেই মাঠের স্কোরলাইনকে ছাপিয়ে জীবন সংগ্রামে জয়লাভের এই সব চলমান রূপকথা। এক দিকে মাঠের ফুটবল। অন্য দিকে জীবন ভাঙা-গড়ার খেলা।

উত্থান: ফ্রান্সের শহরতলি থেকে উঠে আসা চমকের নাম এমবাপে। ফাইল চিত্র

উত্থান: ফ্রান্সের শহরতলি থেকে উঠে আসা চমকের নাম এমবাপে। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০৪:৫৫
Share: Save:

কিলিয়ান এমবাপে বিশ্বকাপে মোট কত গোল করলেন?

কী আসে-যায়!

পল পোগবা কি সেমিফাইনালে ম্যাচের সেরা হতে পারলেন?

কী আসে-যায়!

রোমেলু লুকাকু কি বেলজিয়ামকে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দিতে পারলেন?

কী আসে-যায়!

বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল শুরুর অনেক আগেই যে জীবনের স্কোরলাইনে জিতে গিয়েছেন এমবাপে, লুকাকুরা! মাঠের নব্বই বা একশো কুড়ি মিনিটের চেয়ে জীবনের সেই লড়াই অনেক কঠিন, আরও অনেক ঝড়ঝঞ্ঝায় ভরা।

প্যারিসের যে-অনগ্রসর এলাকায় এমবাপে বড় হয়েছেন, সেখানে ফুটবল নিছকই একটি খেলা নয়, জীবন তৈরির মাধ্যম। যদি কোনও বাচ্চার পায়ে ফুটবল না-থাকে, তা হলে ভয় হয়, তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র উঠবে না তো?

ফ্রান্সের শহরতলিকে বলা হয় ‘বঁলিউ’। অপরাধের আখড়া ধরা হয় এই জায়গাগুলিকে। চমকপ্রদ হচ্ছে, গত দু’দশক ধরে ফ্রান্সের বেশির ভাগ ফুটবল তারকা বেরিয়ে এসেছেন শহরতলির এই সব ঘুপচি থেকে। জ়িনেদিন জ়িদান থেকে থিয়েরি অঁরি। পল পোগবা থেকে এমবাপে। করিম বেঞ্জেমা থেকে প্যাত্রিস এভা। গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো জীবনকাহিনি তাঁদের প্রত্যেকের।

আরও পড়ুন: অশ্বমেধের ঘোড়া আটকে ফাইনালে ফরাসি ব্রিগেড

পোগবা বেড়ে উঠেছেন রোয়সির হিংসাপ্রবণ এলাকায়। ৮০০ কোটি টাকার উপরে ট্রান্সফার ফি-তে তাঁর ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে যাওয়াটা শুধু ফুটবল কেন, সকলের কাছেই উদাহরণ! বন্ডির অনগ্রসর এলাকা থেকে উঠে আসা এমবাপেকে দেড় হাজার কোটি টাকার উপরে লোন ফি দিয়ে রাখতে রাজি প্যারিস সাঁ জারমাঁ। বন্ডিতে এমবাপের পাড়ায় ফুটবল স্কুলগুলোকে অ্যাকাডেমি নয়, বলা উচিত জীবন তৈরির কারখানা। ফুটবল শেখানো মাস্টারদের কোচ নয়, বলা উচিত সমাজসেবী। শুধু খেলা শেখালেই যে হয় না, এমবাপের মতো মিষ্টি মুখের শিশুদের শেখাতে হয়, কী ভাবে নতুন পরিচয়ে ‘হ্যালো’ বলতে হবে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ— শেখাতে হয়, কী ভাবে সমাজের অন্ধকার জগতের হাতছানি থেকে ভুলিয়ে মন বসাতে হয় সুস্থ পৃথিবীতে।

আইফেল টাওয়ারের ঝলমলে উপস্থিতির আড়ালে একটা অন্ধকার জগৎ আছে প্যারিসের। তার শেকড় এই ‘বঁলিউগুলিতে’। তিন বছর আগের অভিশপ্ত ‘ফ্রাইডে দ্য থার্টিন্থ’ (১৩ নভেম্বর, ২০১৫)-এর জঙ্গি হানার পরে এই সব অঞ্চলে আতঙ্ক আরও বেড়ে গিয়েছে। রাতের অন্ধকারে পুলিশের জিপের হর্ন আর ভারী বুটের আওয়াজের ভয়ে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে পড়ে থাকে অসংখ্য এমবাপে, পল পোগবারা। সকাল হলে এঁরাই মাঠে ছুটবে ফুটবল নিয়ে। রাতে হানা দেয় পুলিশ। অপরাধী খুঁজতে। আর সারা দিন ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের স্পটাররা তল্লাশি চালান মাঠে-মাঠে। আগামী দিনের ফুটবল প্রতিভা খুঁজতে।

আর্সেনালে বহু বছর কাটিয়ে যাওয়া ফরাসি কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার এক বার বলেছিলেন, ‘‘পৃথিবীর দু’টো জায়গায় সব চেয়ে বেশি ফুটবল খেলা হয়। বিশ্ব ফুটবলে সব চেয়ে বেশি প্রতিভা আসে এই দু’টো জায়গা থেকে। ব্রাজিলের সাও পাওলো আর প্যারিসের বঁলিউ।’’ দারিদ্রের ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবাসনগুলোর ভিতরে ফাঁকা জায়গায় শুরু হয় এমবাপেদের ফুটবল দৌড়। নাকি বলা উচিত জীবনের দৌড়? কংক্রিটের উপরে রোজকার দাপাদাপি আর খুব ছোট জায়গার মধ্যে খেলতে হয় বলেই সম্ভবত তাঁদের পায়ে চিতাবাঘের বিদ্যুৎ-গতি। যার জোরে তাঁরা দৌড়ে শিকার করে ফেলতে পারেন লিয়োনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে।

শুধু ফ্রান্স বলেই নয়, বিশ্বকাপে খেলা অনেক দেশেই ছড়িয়ে রয়েছে আছে এমন অবিশ্বাস্য জীবনকাহিনি। ব্রাজিলের এমনই প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতেন দিয়েগো কোস্তা যে, মনে হবে সেটা সূর্যাস্তেরও ও-পারে। কোস্তা ট্রাক চালানো শেখেন অভাবের সংসারে আর্থিক অবদান রাখতে হবে বলে। এ-রকম একটা প্রেক্ষাপট থেকে ফুটবলার হিসেবে তাঁর উত্থান। ব্রাজিল ছেড়ে স্পেনের হয়ে খেলা শুরু। রাশিয়া বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে পর্তুগালের বিরুদ্ধে তাঁর জোড়া গোল শুধু স্পেনকেই লড়াইয়ে রাখছিল না, ব্রাজিলের সেই গ্রামেও বিশ্বাসের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছিল যে, সাধনা থাকলে যে-কোনও শৃঙ্গ জয়ই সম্ভব।

বেলজিয়ামের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে ব্রাজিল বিদায় নিল বিশ্বকাপ থেকে। কিন্তু হৃদয় থেকে কী করে চলে যেতে পারেন মিরান্দা? পেলে, গ্যারিঞ্চা, জ়িকো, সক্রেটিসদের দেশে জন্ম হলেও তিনি হতে চেয়েছিলেন ডিফেন্ডার, কারণ তাঁর বড় দাদা ডিফেন্সে খেলতেন। বারো ভাইবোনের অভাবের সংসারে বড় দাদার শুধু ফুটবল খেললেই চলত না, ইলেকট্রিশিয়ানের কাজও করতে হত।

বৃষ্টিভেজা এক সকালে কাজ করার সময় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে যান তিনি। মিরান্দা বড় হয়ে সেই কাহিনি শোনার পরেই শপথ নেন, দাদার অসমাপ্ত স্বপ্ন সফল করতেই হবে। এক দিন তিনি ব্রাজিলের বিখ্যাত হলুদ জার্সি পরে খেলবেন এবং খেলবেন দাদার মতো ডিফেন্ডার হিসেবেই। বিশ্বকাপের আসরে মিরান্দার হলুদ জার্সিতে খেলতে নামাটাই সেরা অনুপ্রেরণা। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি বেলজিয়ামকে ঠেকাতে পারলেন কি পারলেন না, সেই তাৎক্ষণিক ফলাফলের প্রিজমে মিরান্দার ফুটবল যাত্রাকে দেখতে যাওয়াই বিরাট ভুল।

ফ্রান্সে গলি থেকে রাজপথের সেরা উদাহরণ জ়িনেদিন জ়িদান। বাবা আলজিরীয়। সাঁ দেনির কাছে একটি আবাসন প্রকল্পে কাজ করতেন। সারা দিনের খাটুনির পরে এতটাই ক্লান্ত থাকতেন সিনিয়র জ়িদান যে, সেই বিল্ডিংয়ের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। বাস ধরে বাড়ি ফেরার পয়সাটুকুও অনেক দিন থাকত না। কে জানত, সেই চাতাল থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে এক দিন তৈরি হবে ফ্রান্সের সব চেয়ে বড় ফুটবল স্টেডিয়াম, স্তাদ দে ফঁস। আর সেখানেই ১৯৯৮ বিশ্বকাপ জিতিয়ে নায়ক হবেন পুত্র জ়িনেদিন!

বেলজিয়ামের রোমেলু লুকাকু আর এক জন। ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে রান্নাঘরে ঢুকে লুকাকু আবিষ্কার করেন, মা দুধের সঙ্গে জল মেশাচ্ছেন। ছেলেকে খাঁটি দুধ দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যটুকুও ছিল না। সেন্ট পিটার্সবার্গে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সেমিফাইনাল খেলতে নামেননি লুকাকু। নেমেছিলেন ফাইনাল খেলতে। মায়ের সেই দুধে জল মেশানোর দৃশ্যটা দেখার পর থেকে জীবনের প্রত্যেকটা দিনই তাঁর কাছে ফাইনাল! প্রত্যেকটা ম্যাচেই হয় এসপার, নয় ওসপার। হয় আমি পারব, নয়তো মায়ের কাছে থাকবে না খাঁটি দুধ! ব্রাসেলসের ঝুপড়ি থেকে ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডে বিপুল অর্থে খেলতে নামাটা টিনিটিনের অভিযানের মতোই রোমহর্ষক। স্বচ্ছন্দে নামকরণ হতে পারে ‘অ্যা়ডভেঞ্চার্স অব রোমেলু লুকাকু’।

ফুটবল মানেই মাঠের স্কোরলাইনকে ছাপিয়ে জীবন সংগ্রামে জয়লাভের এই সব চলমান রূপকথা। এক দিকে মাঠের ফুটবল। অন্য দিকে জীবন ভাঙা-গড়ার খেলা। ক্রিকেট নিয়ে সি এল আর জেমসের সেই অমর পর্যবেক্ষণ এখানেও মানিয়ে যায়— তারা কী বোঝে ফুটবলের, যারা শুধুই ফুটবল বোঝে!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy