ভরসা: অনুশীলনে নেমার। রাশিয়ার সামারা এরিনায়। ছবি: রয়টার্স।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এবং লিয়োনেল মেসি, দু’জনেই বুঝিয়ে দিল ওরাও মানুষ। আর মানুষ মাত্রই ব্যর্থ হয়।
রবিবার এই কলামটা লেখার সময়ে বাকি দুনিয়ার মতো আমিও বিষণ্ণ। বিশ্বের সেরা ফুটবল যজ্ঞ থেকে এই প্রজন্মের দুই শ্রেষ্ঠ তারকা বিদায় নেওয়ায় আমিও শোকাচ্ছন্ন। জীবন কখনও কখনও খুবই নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে। সেরার সেরাও কখনও তার প্রাপ্যটা পায় না। এটাই জীবন। আমি এটা মেনে নিয়েছি। রোনাল্ডো, মেসিকেও এটা মেনে নিয়ে এগিয়ে চলতে হবে।
আজ এক জনের কথা খুব মনে পড়ছে। আমার বন্ধু সক্রেটিস। কী ভাবে ‘ডাক্তার’কে ভুলে যাব! ওই নামেই আমরা সক্রেটিসকে ডাকতাম (পেশাগত ভাবেও সক্রেটিস কিন্তু এক জন চিকিৎসকই ছিল)। সক্রেটিস আমাকে এমন একটা কথা বলেছিল, যা সারা জীবনেও ভুলব না। ও বলেছিল, ‘‘মাঝে মাঝে জীবন খুব নিষ্ঠুর হয়ে ওঠে বন্ধু। কিন্তু সেটাও তোমাকে গ্রহণ করতে হবে।’’
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আমি পেনাল্টি ফস্কেছিলাম। যদি সে দিন গোলটা করতে পারতাম! বিস্ময়কর ভাবে ওই ম্যাচে আমি টাইব্রেকারে গোল করেছিলাম, কিন্তু সক্রেটিস আর প্লাতিনির মতো ফুটবলার পারেনি। ব্যর্থতা কখনও কখনও জীবনকে এক বিন্দুতে নিয়ে আসে। প্রতিদ্বন্দ্বীকে বন্ধু বানিয়ে দেয়। আমি নিশ্চিত, এই ব্যর্থতা রোনাল্ডো আর মেসিকেও এক বিন্দুতে নিয়ে আসবে। ওদের নাম এখন থেকে একযোগেই উচ্চারিত হবে। পাশাপাশি রোনাল্ডো না মেসি, কে সেরা— বিশ্বব্যাপী এই প্রশ্নটার উত্তরও সম্ভবত পাওয়া হয়ে গেল। জীবন যে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল। ওরা দু’জনেই সম মানের, দু’জনেই মানুষ।
আমি নিশ্চিত, এর পরে এই দুই কিংবদন্তির যখন দেখা হবে, ওরা জীবনের দার্শনিক দিকটা নিয়েই আলোচনা করবে। কিন্তু আজ ওদের একা ছেড়ে দিন। ওদের সম্মান করুন। আমাদের জীবনকে সুন্দর করে তোলার জন্য ওদের ধন্যবাদ দিন।
যাই হোক, দার্শনিকতা আর রোম্যান্স ছেড়ে এ বার বাস্তবের দিকে একটু নজর দিই। যা করতে গেলে আমাকে আলাদা করে কয়েক জন ফুটবলারের কথা বলতেই হবে। যেমন, উরুগুয়ের কাভানি এবং সুয়ারেস। ফ্রান্সের তিন মূর্তি— এমবাপে, পোগবা এবং গ্রিজম্যান। এ-ও বলতে হবে, ফেভারিটরাই কিন্তু প্রথম দু’টো প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে জিতেছে। কোয়ার্টার ফাইনালে যখন এই ফ্রান্স এবং উরুগুয়ে মুখোমুখি হবে, তখন কিন্তু দারুণ একটা ম্যাচ দেখতে পাব আমরা।
এই বিশ্বকাপ থেকে ইতিমধ্যেই বিদায় নিয়েছে জার্মানি, আর্জেন্টিনা। নেদারল্যান্ডস যোগ্যতা অর্জন পর্বেই ছিটকে গিয়েছে। তাই সবার চোখ এখন ব্রাজিলের উপরেই। আগের বিশ্বকাপে শেষ চারে ওঠা দলগুলোর মধ্যে ওরাই একমাত্র টিকে আছে। ব্রাজিল এ বার যে দলের বিরুদ্ধে শেষ ষোলোর লড়াইয়ে নামছে, সেই মেক্সিকোর ডিফেন্স খুব ভাল। তবে শেষ ম্যাচে সুইডেনের কাছে ০-৩ হেরে বড় ধাক্কা খেয়েছে ওরা।
মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ম্যাচটার কথায় আসি। আমি জানি, ওরা আগের বারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে গ্রুপ পর্বে হারিয়ে এসেছে। তা-ও বলব, সামারায় মেক্সিকোকে হারাতে সমস্যায় পড়বে না ব্রাজিল। একটা কথা শুধু বলতে চাই। মেক্সিকোর গোলরক্ষক ওচোয়ার বিরুদ্ধে শুরুতেই গোল করে ওর আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা দিতে হবে। ব্রাজিলকে আগে গোল করে মেক্সিকোকে রক্ষণের খোলস থেকে বার করে আনতে হবে। তা হলেই ম্যাচটা ধরে নেবে ব্রাজিল।
একটু পরিসংখ্যান ঘাঁটছিলাম। দেখলাম, মেক্সিকোর সঙ্গে ৫০ বার দেখা হয়েছে আমাদের। জিতেছি ২৩ বার, হেরেছি ১০ বার। এ ছাড়া মেক্সিকো কখনও বিশ্বকাপের শেষ ষোলোর বেশি যেতে পারেনি। আমার মনে হয়, ছোটখাটো দু’একটা পরিবর্তন বাদে মোটামুটি আগের ম্যাচের দলই খেলাবে ব্রাজিল। মার্সেলোর জায়গায় খেলতে পারে ফিলিপে লুইস। শুনলাম, ডগলাস কোস্তা সুস্থ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু আমার মনে হয়, নেমারের সঙ্গে উপরে উইলিয়ান আর জেসুসকেই খেলাবে তিতে।
আমার একটাই চিন্তা পাগেনারকে নিয়ে। আমার দলের এই রাইট ব্যাক আক্রমণের নেশায় মাঝে মাঝেই উপরে উঠে যায়। তখন কিন্তু উইলিয়ান নীচে নেমে ওই জায়গাটা সামলাতে পারছে না। বিপক্ষের প্রতি-আক্রমণের সময়ে যা সমস্যা তৈরি করতে পারে। ওই সময়ে দেখছি, উইং থেকে প্রচুর ক্রস আসছে ব্রাজিলীয় বক্সে। যা সামলানোর কথা ভাবতে হবে তিতেকে। মেক্সিকো কিন্তু ব্রাজিলকে ওদের অর্ধে আসতে দেবে আর তার পরে প্রতি-আক্রমণে গিয়ে উইং থেকে ক্রস বাড়াবে।
ব্রাজিল খুব সম্ভবত ৪-১-২-২-১ ছকে শুরু করবে। তার পরে শুরুর দিকে গোল করতে পারলে, সেই ছক পাল্টে হয়ে যেতে পারে ৪-৩-২-১। বা ম্যাচের পরিস্থিতি দেখে ৪-৩-৩ ছকেও যেতে পারে। এই ম্যাচে ব্রাজিলীয় ফুটবলারদের মাথা খুব ঠান্ডা রেখে খেলতে হবে। থিয়াগো সিলভাকে এ ব্যাপারে নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে হবে। তা ছাড়া কোনও ভাবেই কার্ড দেখা চলবে না। তবে মেক্সিকোকে হাল্কা ভাবে নিলে চলবে না। এ বারের বিশ্বকাপ বুঝিয়ে দিচ্ছে, তথাকথিত শক্তিশালী এবং দুর্বল দেশগুলোর মাঝখানের বিভাজন রেখা ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে। ফুটবলের বড় দলগুলো ছোট দলের বিরুদ্ধে যে সুবিধেটা ভোগ করত, তা এখন সে ভাবে করতে পারছে না। এর উপরে যোগ হয়েছে ভিডিয়ো প্রযুক্তি (ভার)। যা নিয়ে আমার ব্যক্তিগত ধারণা হল, অদক্ষ রেফারিদের সাহায্য করার কাজটাই বেশি করছে ‘ভার’। কিন্তু এটাও বলতে হবে, দিনের শেষে প্রযুক্তি আমাদের সঠিক সিদ্ধান্তেই পৌঁছে দিচ্ছে।
যে ভাবে এই বিশ্বকাপটা এগোচ্ছে, তাতে আমি ব্রাজিলের সামনে রাস্তাটা বিশেষ কঠিন দেখছি না। যদিও খাতায় কলমে নক-আউট পর্বে ব্রাজিল শক্ত দিকেই পড়েছে। বিশ্বকাপ শুরুর আগেই আমি বলেছিলাম, তিতের এই দলটাকে দেখে নেওয়ার জন্য সব চেয়ে উপযুক্ত প্রতিপক্ষ হল সার্বিয়া। ব্রাজিলীয়রা সেই পরীক্ষায় উতরে গিয়েছে। এর পরে মেক্সিকোকে হারালে বেলজিয়াম বা জাপানের সামনে পড়বে। যা আমার মনে হয় ব্রাজিলের সেমিফাইনালে যাওয়ার সেরা রাস্তা। আমি নিশ্চিত, উরুগুয়ে বা ফ্রান্সের বদলে যে মেক্সিকোকে খেলতে হচ্ছে, তার জন্য খুশিই হবে ব্রাজিল।
যাও ছেলেরা, ম্যাচটা জিতে এসো। শুভেচ্ছা রইল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy