Advertisement
১৮ নভেম্বর ২০২৪

আমিই ব্রাজিল, পারলাম না

দলটা ব্রাজিল! তাই ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। গোল শোধ হয়ে যাবে। বহুক্ষণ পর্যন্ত সেই আশ্বাসটাই ছিল

 রাশিয়া থেকে সাম্বার দেশ বিদায় নিতেই থমকে গেল কলকাতা।

রাশিয়া থেকে সাম্বার দেশ বিদায় নিতেই থমকে গেল কলকাতা।

সোমা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জুলাই ২০১৮ ০২:১৮
Share: Save:

ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেল!

প্রতিপক্ষ যে জোরদার, তা জানতাম। প্রথম গোলটা খাওয়ার পরেও মনে হয়েছিল, সামলে নিতে পারব। দ্বিতীয় গোলটায় জোর ধাক্কা। ভাবলাম, এখনও তো সময় আছে! হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুর মেসেজ এল, দলটা ব্রাজিল! তাই ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। গোল শোধ হয়ে যাবে। বহুক্ষণ পর্যন্ত সেই আশ্বাসটাই ছিল। খেলা শেষের যখন মিনিট পাঁচেক বাকি, তত ক্ষণে ভেতরটা ফাঁকা হয়ে গেছে। একটা মেসেজ টাইপ করলাম, ‘আমরা পারলাম না…।’ টাইপ করে আবার মুছেও দিলাম। নিজেদের ব্যর্থতার কথা যাকে পাঠাতে যাচ্ছিলাম, সেই বন্ধুই দ্বিতীয় গোলের পরে মেসেজ করেছিল। সে নিজে আর্জেন্টিনার সমর্থক। তত ক্ষণে বেলজিয়ামের চেয়েও বেশি রাগ তার উপরে হচ্ছে। তাদের উপরে হচ্ছে। ওরা, ওই আর্জেন্টিনার সমর্থকেরাই তো চেয়েছিল, আমরা হেরে যাই! মুখে যা-ই বলুক, ওরা নিশ্চয়ই খুব খুশি! মনে হচ্ছিল, আর্জেন্টিনার লক্ষ লক্ষ সমর্থকই যেন বেলজিয়ামের গোলরক্ষক থিবো কুর্তোয়ার উপরে ভর করেছে। সকলে মিলে একসঙ্গে জোট বেঁধে হারিয়েছে আমাদের।

কিন্তু এই আমরা-টা কারা? দেশ জুড়ে হাজার হাজার ব্রাজিলের সমর্থক নিজেদের ব্রাজিলীয় মনে করছেন! গ্যালারিতে বসে ব্রাজিলের যে সমর্থকেরা চোখের জলে ভেসে যাচ্ছিলেন, আমাদের কষ্টও কি তার চেয়ে কম কিছু? মনে পড়ছিল অফিসের সেই সিনিয়র সহকর্মীর কথা। আগের বারের সাত গোলের স্মৃতি আমার মনে তো টাটকাই। কিন্তু বোধহয় অনেক বেশি টাটকা তাঁর মনে। শুনেছিলাম, কার্যত নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে গিয়েছিল। এ বার কী অবস্থা তাঁর? ফোনটা এল শনিবার সকালে। সহকর্মী বললেন, ‘‘বুঝলি, যত দিন বাঁচব, আর কোনও দলকে আলাদা করে সাপোর্ট করব না। বড় কষ্ট!’’

সত্যিই বড় কষ্ট। এটা তারাই জানে, যারা খেলা দেখতে দেখতে হঠাৎ নিজেরা এ ভাবে একাত্ম হয়ে যায়! একই সঙ্গে আমি ভারতের, আবার আমি ব্রাজিলেরও। আমি সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা বিরাট কোহলিকে নিয়ে যতটা গলা ফাটাই, নেমারকে নিয়ে আমার আবেগ তার চেয়ে কিছু অংশে কম নয়!

যেমন, আমার গোটা পরিবার মোহনবাগানের সমর্থক। এক সময়ে ঘরে গৌতম সরকারের ছবি বাঁধানো ছিল! মাঠে গিয়ে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলা দেখেছি বেশ কয়েক বার। এত বেশি গালিগালাজ চলে মাঠে যে, সেটা বেশি দিন চালাতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বকাপের মরসুমে সেই ‘আমিই মোহনবাগান’ আবেগটা ‘আমিই ব্রাজিল’ হয়ে উঠেছে!

সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র যেমন বললেন, ‘‘বহু বার তো শুনেছি ‘নিজের’ দল হেরে গেলে অনেকে আত্মহত্যাও করে ফেলে! এ বারের বিশ্বকাপে এমন ঘটনা কটা ঘটেছে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তামিলনাড়ুতে রাজনৈতিক সমর্থকদের মধ্যে ‘গায়ে আগুন লাগানো’ আবেগ দেখে অনেকে হাসাহাসি করেন। কিন্তু খেলাকে ঘিরে এমন হলে তখন কারও হাসি পায় না। ‘আমি’ সেখানে চোখের নিমেষে ‘আমরা’ হয়ে ওঠে। এটাই খেলার ম্যাজিক।’’

মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম অবশ্য বিশ্বজোড়া এই আবেগকে যথেষ্ট প্রশংসার চোখেই দেখছেন। তাঁর মতে, একেই তো বলে সর্বজনীনতা! তা না হলে তো নিজের
বিল্ডিং-এর টিমের বাইরে আর কাউকে সমর্থন করার কথা ভাবাই যাবে না! তিনি বলেন, ‘‘এত বিভাজনের মধ্যেও যে আমরা এটা করতে পারছি, সেটাই তো প্রশংসার। অন্য একটা দেশও সেখানে আমার হয়ে যাচ্ছে।’’ একই সঙ্গে অবশ্য ‘মাত্রাতিরিক্ত’ আবেগ নিয়ে কিছুটা আশঙ্কাও আছে তাঁর। তবে শুধুমাত্র ‘‘আমার দল হেরে গেল বলে আমি গভীর হতাশায় ডুবে গেলাম, কিংবা আত্মহত্যা করতে গেলাম, এমনটা বোধহয় ঘটে না। আমার ছেলে পরীক্ষায় ফেল করেছে, আমার চাকরি নেই, বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া, তার সঙ্গে যোগ হল ব্রাজিলের হার। আমার মনে হল, জীবনে আর কিছু রইল না।’’ মনে করেন জয়রঞ্জনবাবু।

একই বক্তব্য আর এক মনোবিদ জ্যোতির্ময় সমাজদারেরও। যুগ যুগ ধরে তো এমনটাই ঘটেছে। সে ফুটবলের ময়দান হোক, কিংবা গ্ল্যাডিয়েটরের লড়াই। আমি কোনও একটা দলকে বেছে নিচ্ছি। তার জয় মানে আমার জয়, তার হার মানে আমার হার। মেসির কান্না আমার কান্না। নেমারের চোট আমার চোট। ব্যক্তিগত জীবনের সব আবেগ, সব না পাওয়া গিয়ে জড়ো হচ্ছে সেখানে। তবে এর বাইরে একটা অন্য ছবিও আছে। জ্যোতির্ময়বাবু জানালেন, খেলাপাগল রোগীর সংখ্যা তাঁর চেম্বারে নেহাত কম নয়। বিশ্বকাপের বাজারে যে সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায়। সেটা কেমন? তিনি বলেন, ‘‘প্রিয় দল হেরে গেলে টিভি সেট ভেঙে দিয়েছেন কেউ কেউ। বিপরীত দলের সমর্থকদের নানা ভাবে হেয় করেছেন, মারধর করেছেন, এমনকি কুৎসা রটাতেও পিছপা হননি। এগুলো স্বাভাবিক নয়।’’

সত্যিই স্বাভাবিক নয়।

এই মুহূর্তে স্বাভাবিক শুধু ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যাওয়া!

যেটা আর্জেন্তিনীয়দের হয়েছিল দিন কয়েক আগে। যেটা আমাদের হচ্ছে শুক্রবার রাত থেকে...ব্রাজিল কেন পারল না?

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy