উত্থান-পতনে ভরা বর্ণময় কিরিয়সের জীবন ছবি রয়টার্স
বছর তিনেক আগের কথা। মেক্সিকোর আকাপুলকো ওপেনে খেলছিলেন নিক কিরিয়স। মিনিট কয়েক পরেই প্রথম রাউন্ডের খেলা। ব্যালকনিতে ঘোরাফেরা করতে করতেই নিজেকে শেষ করার ভাবনা মাথায় আসে কিরিয়সের। নীচের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিলেন, এ বার তা হলে ঝাঁপ দেওয়া যাক? শেষ করে দেওয়া যাক সব কিছু? এত কষ্ট, এত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় তো খুবই সহজ। কিরিয়স সে দিন মনের কথা শোনেননি। আর শোনেননি বলেই তিনি উইম্বলডনের ফাইনাল খেলে ফেললেন। মদ, সিগারেটের বদলে তাঁর জীবনে এখন শুধুই টেনিস।
ফেলে আসা সেই দিনগুলির কথা এখনও ভুলতে পারেন না কিরিয়স। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “ওই দিন নিজেকে প্রচণ্ড একা লাগছিল। মনে হচ্ছিল আমার কোথাও কেউ নেই। সত্যি ভাবছিলাম, এ বার সব শেষ করে দেওয়া যাক। রোজ রাতে প্রচুর মদ খাচ্ছিলাম। একা একাই। পর দিন সকালে উঠে মাথা ঝিমঝিম করছে। সেই নিয়েই ম্যাচ খেলতে যাচ্ছি। আবার রাতে ফিরে মদ খাচ্ছি।” সেই প্রতিযোগিতাতেই পর পর আলেকজান্ডার জেরেভ, রাফায়েল নাদালকে হারিয়ে ট্রফি জিতে নিয়েছিলেন। তার পরেও জোটে গঞ্জনা। ফাইনালে তিনটি ম্যাচ পয়েন্ট বাঁচিয়ে নাদালকে হারালেও, কিরিয়সের আচরণ মোটেও পছন্দ হয়নি স্প্যানিশ তারকার। ম্যাচের পর স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, “ওর প্রচুর প্রতিভা। হয়তো কোনও দিন গ্র্যান্ড স্ল্যাম পাবে এবং অনেক কিছু অর্জন করবে। কিন্তু দর্শক, বিপক্ষ, এমনকি নিজের প্রতিও ওর কোনও শ্রদ্ধা নেই।”
আসলে কিরিয়স এমনই। বিতর্ক এবং তাঁর নাম সমার্থক। কিরিয়সকে নিয়ে এক সময় অনেক আশা ছিল অস্ট্রেলিয়ার। প্রতি বারই আশাহত করেছেন তিনি। যখনই মনে হয়েছে এ বার তাঁর চূড়োয় ওঠার সময়, কোনও না কোনও বিতর্ক তাঁকে পিছু টেনে নামিয়েছে নীচে। সহজ ম্যাচ অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা করে হেরে বসেছেন। ম্যাচ নিজের নিয়ন্ত্রণে না থাকলে এমন সব কাজ করেছেন, যাতে বিরক্ত হয়েছেন দর্শকরা। উড়ে এসেছে ব্যঙ্গাত্মক শিস। বড় মঞ্চে ম্যাচ জিততে যে ধরনের মানসিকতা বা শারীরিক সক্ষমতা দরকার, কোনও দিনই তাঁর ধারেকাছে যাওয়ার চেষ্টা করেননি কিরিয়স। পাত্তাই দেননি। নিজের প্রতিভা অসীম, কোনও দিন তা মেলে ধরার চেষ্টা করেননি।
উচ্চতার কারণে ছোটবেলায় বাস্কেটবলই তাঁর প্রিয় খেলা ছিল। ১৪ বছর বয়সে টেনিসের প্রেমে পড়া। উচ্চতার জন্যেই জোরালো সার্ভ এবং কোর্ট কভারেজ বাকিদের থেকে অনেক বেশি। কোনও দিন নিজের শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেননি। তবু তাঁর প্রতিভাকে অস্বীকার করতে পারেননি, পারেন না কেউই। মাঝেমধ্যেই বিখ্যাত খেলোয়াড়দের হারিয়ে চমকে দিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া মাত্রই পরের ম্যাচে অখ্যাত কারওর কাছে হেরে গিয়েছেন। যাঁরা তাঁর অনুরাগী বা খেলার খবর রাখেন, তাঁরা এ সব ঘটনার সঙ্গে এত দিনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। জীবনে যত অর্থ পুরস্কারমূল্য হিসাবে পেয়েছেন, তার অর্ধেকই বোধহয় জরিমানা দিতে খরচ হয়ে গিয়েছে। কখনও প্রতিপক্ষকে গালি দিচ্ছেন, কখনও আম্পায়ারের সঙ্গে ঝগড়া করছেন, কখনও দর্শকদের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন, কখনও ম্যাচে পিছিয়ে পড়ে ইচ্ছাকৃত ভাবে হেরে যাচ্ছেন, কখনও বোতল নিয়ে স্বমেহন করার মতো অশ্লীল আচরণ করছেন — তালিকা থামার নয়।
তবে সবচেয়ে বেশি ভয় ছিল তাঁর আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে। মাঠে বিতর্কে জড়িয়ে পড়া এক জিনিস, আর আত্মবিশ্বাস কমে গিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলার প্রবণতা আর এক জিনিস। এক বার তিনি বলেছিলেন, “আমি জীবনকে এক সময় ঘৃণা করতাম। পরিবার, বন্ধুদের দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। সব সময় মনে হত নিজেকে শেষ করে দিই।” এই উইম্বলডনে খেলতে এসেই এক বার আকণ্ঠ মদ্যপান করে রাতে বাবার ঘরে গিয়েছিলেন। বাবা তাঁকে দেখেই বলে ওঠেন, “তোমাকে এ বার এ সব বন্ধ করতেই হবে নিক।” ধাক্কা লেগেছিল শুনে। “বাবার ওই কথা শুনেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এ বার ঘুরে দাঁড়াতে হবে।” বলেছিলেন কিরিয়স।
নিজেই জানিয়েছেন, কোনও দিন পরিবারকে পাত্তা দেননি। অথচ বার বার তাঁর বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছে পরিবারই। মাত্র ২৩-২৪ বছর বয়সে মানসিক সমস্যা শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কাউকে দুঃখের কথা বলতে পারতেন না। পকেটে লক্ষ লক্ষ ডলার ছিল। কোথাও ঘুরতে যেতে পারতেন না। কিছু করতে ইচ্ছে করত না। ভাই বা মায়ের সঙ্গে কথা বলতে কখনও ইচ্ছে করেনি। মনের কথা খুলে বললে হয়তো শান্তি পেতেন। কিন্তু সারাজীবন চুপ থেকে গিয়েছেন। নিজের যন্ত্রণা চেপে রেখেছেন বুকের মধ্যেই। পরে বুঝতে পেরেছেন, সেই সিদ্ধান্ত বিরাট ভুল ছিল। অনেক আগেই মন খুলে সবার সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন ছিল।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের পর একটি ছবি পোস্ট করেন কিরিয়স। হাতে র্যাকেট, কানে হেডফোন। সঙ্গে লেখেন, ‘তিন বছর আগের অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের একটা ছবি। অনেকেই ভাববেন আমি খুব ভাল আছি এবং জীবন উপভোগ করছি। আসলে তখন আমার জীবনের অন্যতম কালো অধ্যায় যাচ্ছিল। খুঁটিয়ে দেখলে আমার ডান হাতে কতগুলো চিহ্ন দেখতে পাবেন। ওগুলো নিজের উপর অত্যাচারের চিহ্ন। তখন আমার আত্মহত্যার কথা মনে হত। লাখো লোকের সামনে খেলা তো দূর, বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছে করত না। এ রকম হয়েছিল কারণ, নিজে কোনও দিন দুঃখের কথা কাউকে বলিনি। কাছের লোকদের বিশ্বাস করিনি। নিজে ভাল থাকার একটুও চেষ্টা করিনি। যদি আপনারও এ রকম হয়, তা হলে দ্বিধা না করে কাছের লোকেদের মনের কথা খুলে বলুন। ভাববেন না যে আপনি একা। আমি আছি, কথা বলুন। আমি গর্বিত এটা ভেবে যে নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছি।”
কিরিয়সের মা নিল আদতে মালয়েশিয়ার। তবে অস্ট্রেলিয়ায় এসে তাঁকে বর্ণবিদ্বেষের সামনে পড়তে হয়েছিল। ছোট ছেলে কিরিয়সকেও মানুষ করেছেন কঠোর মানসিকতা নিয়েই। ঠাকুমা জুলিয়ানা ফস্টারকে খুব ভালবাসতেন কিরিয়স। সারাক্ষণ জুলিয়ানা সঙ্গে থাকতেন, অনুশীলনে নিয়ে যেতেন, ভুল করলে হালকা বকুনি দিতেন, এমনকি কিরিয়স সিগারেট খেলে তা বাবা-মার থেকে লুকিয়েও রাখতেন। ২০১৫ সালে জুলিয়ানা মারা যাওয়ার পরে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছিলেন কিরিয়স। ভেবেছিলেন তাঁর জীবন থেকে টেনিসকেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সেই ধাক্কা সামলাতে অনেক সময় লেগেছিল কিরিয়সের।
যে জোকোভিচের বিরুদ্ধে খেললেন রবিবার, তাঁকেও অতীতে কম রাগাননি। এক বার ম্যাচ চলাকালীন প্রচণ্ড জোরে জোরে চিৎকার করছিলেন কিরিয়স। জোকোভিচ প্রথমে ঘাবড়ে যান, পরে প্রচণ্ড রেগে যান। ম্যাচও হেরে বসেন। কিরিয়স বলেছেন, “মনে হয় আমাকে দেখে জোকোভিচের কোনও জন্তু মনে হয়েছিল। ওর মনঃসংযোগ ব্যাহত করার জন্যেই ও রকম করছিলাম। তবে ওকে পাল্টা দিতে দেখিনি কোনও সময়।”
এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেনেও বিতর্কে জড়িয়েছেন তৃতীয় রাউন্ডে স্টেফানোস চিচিপাসের বিরুদ্ধে খেলার সময়ে। তবে সেই ম্যাচে বিতর্কের পর উইম্বলডনে ‘অন্য’ কিরিয়সকে দেখা গিয়েছে। এখন তিনি ম্যাচ জিতলে বারে গিয়ে অকারণে মদ্যপান করেন না। রাত জেগে ভিডিয়ো গেমে বুঁদ থাকেন না। দীর্ঘ দিন ধরে যে উচ্চতায় পৌঁছনোর চেষ্টা করছেন, সেই লক্ষ্যের দিকেই এখন ধাওয়া করছেন কিরিয়স। উইম্বলডনের ফাইনাল নিঃসন্দেহে তাঁকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy