টিভির পর্দায় খেলা দেখতে দেখতে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া থেকে বাঙালিকে ঠেকাবে কে? গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
হোক মাঠ দর্শকহীন। ময়দানে যখন পা রাখবে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান, দূর থেকে সমর্থন, টিভির পর্দায় খেলা দেখতে দেখতে বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়া থেকে বাঙালিকে ঠেকাবে কে? হেঁশেলেও বিপ্লব। ইলিশ-চিংড়ির চিরন্তন দ্বন্দ্বে। ‘বাঙাল-ঘটি ফাটাফাটি’ও থাকবেই। নানা কুসংস্কার, মজাদার টিকাটিপ্পনি? আনন্দবাজার ডিজিটাল খোঁজ নিল তারকাদের ঘরে---
মোহনবাগান গোল খাচ্ছে, মা দুঃখে বঁটিতে আঙুল কাটছেন!
ছোটবেলা পেরিয়ে বড়বেলা, পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ফুটবল নিয়ে পাগলামি এক চুলও কমেনি। বাড়ির মধ্যেই দুর্দান্ত কম্বিনেশন! একা শিবপ্রসাদ ইস্টবেঙ্গল। বাকিরা গোঁড়া মোহনবাগান। দুই পক্ষ মাঠে নামলে খেলা কি বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ত? ‘‘সে কথা আর কী বলব! এক বার মোহনবাগান পাঁচ গোল খেল। তরকারি কাটতে কাটতে দুঃখে অন্যমনস্ক মা হাতের আঙুলই ফালাফালা করে কেটে ফেললেন! যা-তা অবস্থা।’’
ফুটবল খেলার কথা উঠতেই হিয়া নস্টাল শিবপ্রসাদের। বয়স কম। পকেটে পয়সাও অল্প। কিন্তু কাছে থেকে প্রিয় খেলোয়াড়দের দেখতে হবে। কী করা যায়? কষ্ট করেই চলে যেতেন ফ্লুরিসে। এক কাপ কফি বা মিল্ক শেক হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। সেই সময়ের ইস্টবেঙ্গলের জনপ্রিয় খেলোয়াড়েরা মাঝেমধ্যে দুপুরের দিকে সেখানে আসতেন সেখানে। চা-টোস্ট-কফি খেতেন।
ডার্বি নিয়ে আবেগের যেন কোনও বয়স নেই।
‘‘ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান নিয়ে কম ঝামেলা হয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে!’’ স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে অন্যমনস্ক শিবপ্রসাদ। অনেকেই তাঁর দলেও ছিলেন। ‘‘ছেলেবেলায় ফুটবল খেলতে নামতাম লাল-হলুদ জার্সি গায়ে। পিঠে জ্বলজ্বল করত ১০ নম্বর। আমাদের সময়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন কৃশানু দে। আমরা তাঁর অন্ধ অনুরাগী।’’
দলকে জেতাতে অনেক সময়েই বিছানা ছেড়ে মাটিতে ঠায় বসে খেলা দেখেছেন পরিচালক। বিছানায় বসলেই নাকি ইস্টবেঙ্গল হারবে! শুক্রবার সেই উন্মাদনা আরও একবার ছড়িয়ে পড়বে বাড়িতে। ‘‘জিতলে ইলিশ কেনা থেকে কেউ আটকাতে পারবে না আমায়’’, জানালেন ‘লাল্টু বিশ্বাস’।
ম্যাচ হারছে প্রিয় দল, টিপ্পনি কাটছেন পড়শি...
এমনটাই নাকি হত শ্রাবন্তীর সঙ্গে। ছোটবেলায় একবার মাঠে গিয়েছিলেন। খেলা যত জমছে, উত্তেজনার পারদ নাকি ততই চড়ছে। একটা সময় ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলেন। মারামারি হবে নাকি?
তার পর থেকে আর মাঠে যাননি তিনি। বদলে মাঠ উঠে এসেছে তাঁর বাড়িতে। ছোট পর্দায়। তখনও যৌথ পরিবার। নিজেদের সংসার হয়নি কারওর। ফলে, বাড়িতেই শুরু হই-হট্টগোল। ‘‘আমরা বাংলাদেশের মানুষ। সবাই কট্টর ইস্টবেঙ্গল। দল জিতলে সে কী আনন্দ। ভাল-মন্দ খাওয়াদাওয়া। বাড়ি জুড়ে উৎসব শুরু হয়ে যেত। জেঠু-বাবা-কাকাদের মুখে তৃপ্তির হাসি।’’
স্টেডিয়ামে চোখে পড়ে এ রকম হরেক ব্যানার।
দল হারলে? গলা নিভু নিভু শ্রাবন্তীর, পড়শি টিপ্পনি কাটত! বেজার মুখে তাই-ই শুনতে হত। ‘‘এবার ঠিক ইস্টবেঙ্গল জিতবে, দেখবেন’’, ষোলআনা আত্মবিশ্বাসী ভাইচুং ভুটিয়ার অন্ধ ভক্ত।
মোহনবাগান জিতলে দর্জিপাড়ার দোকানের সিঙারা-রসগোল্লা বাঁধা
‘‘ফুটবলের কথা তুলে আমায় নস্টালজিক করে ফেললেন’’, ডার্বি নিয়ে বলতে গিয়ে সাহেব চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম কথাই এটা। কেন? ‘‘ফুটবল আর আমার বাবা ওতপ্রোত জড়িয়ে। এমনিতে আমার বাবা ভীষণ নরম মনের, ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। কোনও দিন রাগতে দেখিনি। জোরে কথাও শুনিনি। সেই বাবা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা হলেই অন্য মূর্তি ধারণ করতেন!’’
যেমন? অভিনেতার বাবা নাকি ক্ষণে ক্ষণে উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। বাড়ির সবাই মোহনবাগান সমর্থক। কিন্তু আশপাশে বা বন্ধুদের অনেকেই তো ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার! ব্যস লেগে যেত তাঁদের সঙ্গে। ‘‘বেশি লাগত পিসেমশাইয়ের সঙ্গে। তিনি ইস্টবেঙ্গল। আমার মামার বাড়ি দর্জিপাড়া। সেখানে সবাই মিলে খেলা দেখতে বসতাম। আমার বাবা ধীরে ধীরে কেমন যেন বদলে যেতেন!’’, জানালেন সাহেব।
বহু বার মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছেন অভিনেতা। ছোট বেলার একটি স্মৃতি আজও জীবন্ত তাঁর কাছে। খেলা শেষ। বাড়ি ফিরবেন। খেলায় মোহনবাগান জিতেছিল। হঠাৎ একটা জুতো এসে সপাটে তাঁর ঘাড়ে! সেই নিয়ে হুলস্থূল কাণ্ড।
পাশাপাশি ভাল স্মৃতিও আছে। সাহেবের মামার বাড়ি উত্তর কলকাতার দর্জিপাড়ায়। সেখানে দল জিতলে সেরা মিষ্টির দোকান থেকে সব্বাইকে পেট ভরে খাওয়ানো হত গরম গরম শিঙাড়া আর রসগোল্লা!
আরও পড়ুন: ডার্বির আগে অধিনায়কের নাম ঘোষণা করল এসসি ইস্টবেঙ্গল
আমি সব দলে, যে জিতবে তার থেকেই খাওয়া পাওনা
মাঠ পর্যন্ত যেতেই হয়নি কোনও দিন রুক্মিণী মৈত্রকে। বাড়িতেই খেলা নিয়ে টানটান উত্তেজনা। মা ইস্টবেঙ্গল, বাবা মোহনবাগান। অভিনেত্রী নিজে? ‘‘নির্দল, মানে সব দলের সাপোর্টার’’, চটজলদি উত্তর এল।
না, কোনও বাক-বিতণ্ডা বা হারজিত নিয়ে মনোমালিন্য হয়নি কোনও দিন মা-বাবার মধ্যে। তবে বাবার সঙ্গে মা নাকি সমানে টক্কর দিতেন। অভিনেত্রীর মা ছোট বেলায় ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল--- প্রায় সব ধরনের খেলাই খেলতেন।
‘‘একটু বড় হওয়ার পর আমিও খেলা দেখতে শুরু করি। তবে তখনও নির্দল। ভারী মজা হত বন্ধুরা এলে। হয়ত কোনও বন্ধু বাথরুমে গিয়েছে। আর পছন্দের দল গোল দিয়েছে। ব্যস, তাকে আটকেই রাখা হত বাথরুমে। আমাকেও করা হয়েছে এ রকম অনেক সময়েই’’ জানালেন ‘সুইৎজারল্যান্ড’-এর ‘রুমি’।
শেষে ভাঙলেন, কেন তিনি সবাইকে সাপোর্ট করেন। ‘‘যে দল জেতে সেই দলের সমর্থকই দেখি ভাল-মন্দ খাওয়ায়। এমন সুযোগ ছাড়ব কেন? সবার তরফ থেকেই আমার খাওয়া কেউ আটকাতে পারে না এর জন্যই’’, অকপটে জানালেন রুক্মিণী।
পাড়ায় পা দিলেই ইস্টবেঙ্গলের পতাকা, জার্সি পকেটে
‘‘কলকাতায় এসে প্রথম উঠি বাগবাজারে। পাক্কা ঘটি পাড়া। আমি নিজেও ঘটি। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার। ফলে, দলকে জিতিয়ে মাঠ থেকে ফেরার সময় পাড়ার কাছাকাছি এলেই পকেটে ঢুকিয়ে নিতাম জার্সি আর পতাকা। একটা মারও নইলে বাইরে পড়বে না!’’ হাসতে হাসতে জানালেন ‘খড়কুটো’র ‘সৌজন্য’ ওরফে কৌশিক রায়।
আরও পড়ুন: ‘এগিয়ে থাকবে ইস্টবেঙ্গল’, বলছেন ডার্বি থেকে বেঁচে ফেরা রহিম নবি
কৌশিক যে সময় থেকে ফুটবলের পোকা, তখন মাঠ দাপাচ্ছেন আইএম বিজয়ন। তার পর এলেন ভাইচুং ভুটিয়া। অভিনয় জগতে আসার পর ইস্টবেঙ্গলের সমস্ত প্রিয় খেলোয়াড়ের সঙ্গে প্রদর্শনী ম্যাচে যখন খেলেছেন, মুখোমুখি হয়েছেন, বন্ধুত্ব হয়েছে--- অদ্ভুত আবেশ, ভাল লাগা বারবার জড়িয়ে ধরেছে তাঁকে। অতীত ভিড় জমিয়েছে মনে।
‘‘বাগবাজারে বোধহয় আমাদের বাড়িই একমাত্র ছিল, যারা ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। আগে ছিলাম আমি আর বাবা। এখন দল ভারী করেছে বউ। ও বাংলাদেশের মেয়ে’’, বললেন কৌশিক। সেই সঙ্গে এ-ও বলছেন, তিনি ইস্টবেঙ্গলের ভক্ত মানেই মোহনবাগানকে একেবারেই দেখতে পারেন না, এমনটা নয়। ভাল ম্যাচ দেখতে ভালবাসেন। সেই টানেই নিয়মিত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ দেখেন।
গ্যালারিতে লাল-হলুদ ঝড়।
শুধু কি তাই! বড় হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে যখন মাঠে যেতেন তখন স্ট্যান্ডে বসতেন নিজেদের সাজানো সিরিয়াল অনুযায়ী। মানে, যে যার বাঁ দিকে বরাবর বসেছে সে তার বাঁ দিকেই বসবে। আর উঠে গেলে যদি গোল হয়ে যায়, তা হলে যে উঠত তার কপালে দুঃখ অনিবার্য।
শুক্রবার ডার্বিতে কোন দল জিতবে? ‘‘ভবিষ্যদ্বাণী করতে রাজি নই। কারণ, মোহনবাগান অনেক বেশি আইএসএল খেলেছে। ইস্টবেঙ্গল শুধুই আই লিগ খেলে এসেছে। এই প্রথম আইএসএল খেলবে। চাপ তো আছেই। তবে সমর্থনটাও সরাচ্ছি না। দল বেশ পোক্ত বলে’’ আশ্বাস অভিনেতার।
প্রযোজকের কাছে বাহানা করে হাফ ছুটি নেব
সোনালী চৌধুরীর পরিবারের সবাই মোহনবাগানের সাপোর্টার। সোনালীর স্বামী ইস্টবেঙ্গল! এ বছর তিনি, আইএসএল-এর বাংলার ধারাভাষ্যকারও।
‘‘আমি আজন্ম মোহনবাগান সাপোর্টার। এখনও মোহনবাগান ডে-তে মাঠে যাই। দল থেকে আমায় আমন্ত্রণও জানানো হয়। আমার মামা মুরারী মোহন ঘোষ মোহনবাগানের সহ সভাপতি ছিলেন। তাই ছোট থেকেই দু’দলের ম্যাচ থাকলে ‘তুক’ হত বেশি। যেমন, বেশি করে সে দিন পুজো করা। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা, আজকের দিনটা উৎরে দিও বলে’’ ফাঁস করলেন অভিনেত্রী।
স্কুল বেলায় ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার বন্ধুদের সঙ্গে কথাও বন্ধ হয়ে যেত সোনালীর। মোহনবাগান ম্যাচ হারলে। এখনও সেই উত্তেজনা রয়েই গিয়েছে। এখন কার সঙ্গে ঝগড়া লাগে তাঁর? হেসে ফেললেন সোনালী, ‘‘রিমঝিম মিত্রের সঙ্গে। ও ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টার। ও জিতলে আমি ঝগড়া করি। আমি জিতলে ও!’’
সেই ঝগড়া থেকে দু’দিন কথা বন্ধ। তার পর আবার সব ঠিকঠাক।
মোহনবাগান জিতলে রান্না ঘর ম’ম করে চিংড়ি মাছের মালাইকারির গন্ধে? ‘‘একদম’’, স্বীকার করলেন সোনালী। ‘‘আমর মতো ঘটিরা তো চিংড়ি মাছ খাওয়ার ছুতো খোঁজে। এই সুযোগ কেউ ছাড়ে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy