—প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
দিব্যেন্দু বড়ুয়া থেকে সায়ন্তন দাস। ১৯৯১ থেকে ২০২৩ সাল। ৩২ বছরে ১১ জন গ্র্যান্ড মাস্টার পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। জাতীয় স্তরে ভাল খেললেও আন্তর্জাতিক স্তরে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না তাঁদের। সেখানে পিছিয়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ। দাপট দেখাচ্ছে দক্ষিণ ভারত। বিশেষ ভাবে বললে তামিলনাড়ু। আন্তর্জাতিক স্তরে কোথায় সমস্যা হচ্ছে এ রাজ্যের দাবাড়ুদের। খোঁজ নিয়ে দেখল আনন্দবাজার অনলাইন।
সালটা ১৯৬১। ভারতের প্রথম ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হন ম্যানুয়েল অ্যারন। ১৯৮৮ সালে ভারতের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার হন বিশ্বনাথন আনন্দ। ২০০১ সালে ভারতের প্রথম মহিলা গ্র্যান্ড মাস্টারের নাম সুব্বারমন বিজয়লক্ষ্মী। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়ে সবাইকে অবাক করে দেন রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ। এই তালিকায় নতুন সংযোজন গুকেশ ডোম্মারাজু। বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ হিসাবে ক্যান্ডিডেটস দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। সুযোগ পেয়েছেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন চিনের ডিং লিরেনকে চ্যালেঞ্জ করার। এই পাঁচ জনের মধ্যে মিল কোথায়? পাঁচ জনেরই বাড়ি তামিলনাড়ুতে। শুধু এই পাঁচ জন নন, বর্তমানে ভারতে যে ৮৪ জন গ্র্যান্ড মাস্টার রয়েছেন তার মধ্যে ২৯ জনই তামিলনাড়ুর। দাবাড়ু তৈরির কারখানা হয়ে উঠছে দক্ষিণ ভারত। সেখানেই কি পিছিয়ে পড়ছে পশ্চিমবঙ্গ।
পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার দিব্যেন্দু বড়ুয়ার মতে, আন্তর্জাতিক স্তরে দাবায় এ রাজ্যের পিছিয়ে পড়ার পিছনে মোট পাঁচটি কারণ রয়েছে। তিনি বললেন, “অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, দক্ষিণ ভারতে খেলাধুলোর যে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে তা অন্য রাজ্যে নেই। সেখানে দাবা নিয়ে দীর্ঘ অনেক বছর ধরে চর্চা হচ্ছে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল জেলা থেকে খেলোয়াড় তুলে আনা হচ্ছে। আমাদের রাজ্যেও অনেক প্রতিভা আছে। তাদের বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। প্রত্যন্ত গ্রাম ও জেলায় দাবা উন্নত না হলে কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি।” তামিলনাড়ুতে দাবার জনপ্রিয়তার কথাও বলেছেন তিনি। দিব্যেন্দু বললেন, “তামিলনাড়ুতে দাবার জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। সেই পর্যায়ে আমরা এখনও যেতে পারিনি। ওখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি হয়। স্কুলে দাবা শেখানো হয়। যারা খেলে তাদের নানা রকম সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এখন কলকাতার কয়েকটা স্কুলেও দাবা খেলা চালু হয়েছে। কিন্তু সেই সংখ্যাটা খুব কম। এখানে অনেকে আছে পড়াশোনার জন্য খেলার সুযোগ পায় না। ছুটি পায় না। আমাদের রাজ্যে পড়াশোনা আগে, তার পর অন্য কিছু। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে বাবা-মায়েরা পড়াশোনা বন্ধ করে খেলাধুলো করায়। এখানে তো সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে উঠলে অনেকে খেলা ছেড়ে দেয়। যত ক্ষণ স্কুল থেকে ছাড় না দেওয়া হবে তত দিন দাবার উন্নতি হবে না। বাবা-মায়েদের মানসিকতারও পরিবর্তন করতে হবে।” প্রাক্তন দাবাড়ুদের এগিয়ে আসতে হবে বলেও মনে করেন দিব্যেন্দু। তাঁর কথায়, “দাবাড়ুরা পরের প্রজন্মকে সাহায্য না করলে হবে না। তামিলনাড়ুতে প্রাক্তন খেলোয়াড়েরা অ্যাকাডেমি খুলেছে। প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। আনন্দের অ্যাকাডেমি আছে। এখানে হয়তো আমার অ্যাকাডেমি আছে। কিন্তু ওখানে অ্যাকাডেমি অনেক বেশি।” দাবা খেলার খরচ অনেক বেশি। তাই আন্তর্জাতিক স্তরে ভাল করতে হলে স্পনসর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানেও পশ্চিমবঙ্গ পিছিয়ে বলে জানিয়েছেন দিব্যেন্দু। তিনি বলেন, “ওরা প্রচুর স্পনসর পায়। এখানে তার অভাব আছে। ইউরোপে বা অন্য দেশে মাসের পর মাস খেলতে গেলে যে পরিমান অর্থের দরকার সেটা এই রাজ্যে নেই। তাই ওখানকার খেলোয়াড়েরা বিদেশে পড়ে থাকতে পারে। বিদেশি কোচদের কাছে শিখতে পারে। তাতে ওদের সুবিধা হচ্ছে।” রাজ্য সরকারকে আরও এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি। দিব্যেন্দুর কথায়, “রাজ্য সরকারেরও সাহায্য দরকার। আমাদের সরকার ক্রীড়া খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। সেটা আরও বাড়াতে হবে। এখানে দাবাকে অত গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ধারাবাহিক ভাবে সহযোগিতা না পেলে হবে না। রাজ্যের ক্রীড়া দফতর যতটা পারে আমাদের সাহায্য করে। সেই সাহায্য আরও বাড়াতে হবে।”
তামিলনাড়ুতে দাবা সংস্থা গড়ে ওঠে ১৯৪৭ সালে। শুরুর দিকে খুব একটা প্রচার ও প্রসার না হলেও ম্যানুয়েল ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার হওয়ার পরেই বিশ্বের নজর গিয়ে পড়ে তামিলনাড়ুর উপর। ১৯৭২ সালে সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সেন্টারে একটি দাবা ক্লাব শুরু করেন ম্যানুয়েল। সেই ক্লাবে দাবার প্রসারে সাহায্য করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দাবার সরঞ্জাম থেকে শুরু করে প্রশিক্ষক আসতেন সে দেশ থেকে। ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মধ্যে দাবা নিয়ে উৎসাহ জন্মায়। ৮০-র দশক থেকে নিয়ম করে সেখানে জেলা স্তরে বড় প্রতিযোগিতা হয়। এখন তো প্রতিটি গ্রামে দাবা প্রতিযোগিতা হয়। দাবার এই প্রসারই তামিলনাড়ুকে ভারতীয় দাবার কারাখানায় পরিণত করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের আর এক গ্র্যান্ড মাস্টার নীলোৎপল দাসের মতে, দক্ষিণ ভারতের এই আধিপত্য অনেক আগে থেকেই ছিল। তিনি বললেন, “তামিলনাড়ুতে দাবার পরিকাঠামো অনেক উন্নত। নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোচেরা শেখান। সেটা এই রাজ্যে অতটা হয় না। এখানে পুরোটাই কলকাতা নির্ভর। কলকাতার বাইরে খুব একটা সুযোগ নেই। বাইরের কেউ শিখতে চাইলে কলকাতায় আসতে হবে। এখানে কিন্তু প্রতিভার অভাব নেই। তারা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে একটা পরিকাঠামোর মধ্যে রাখার ব্যবস্থা এখানে নেই।” সরকারি সাহায্যের কথা বলেছেন তিনিও। নীলোৎপল আরও বলেন, “তামিলনাড়ু সরকার থেকে যে সাহায্য ওরা পায় সেটা এখানে নেই। সেই কারণেই এখানকার দাবা পিছিয়ে আছে। যদি এখানে পরিকাঠামো ঠিক মতো তৈরি হয় তা হলে দাবাড়ু উঠে আসবে। আরও অনেক প্রতিযোগিতা করাতে হবে।”
এ রাজ্যের প্রায় সব দাবাড়ুই স্পনসরের কথা তুলে ধরেছেন। গ্র্যান্ড মাস্টার দীপ সেনগুপ্তই যেমন বললেন, “এখানে স্পনসর নেই। একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের উপরে যেতে হলে আন্তর্জাতিক স্তরের ভাল কোচের দরকার হয়। সেটার খরচ অনেক বেশি। ১৫ দিন শিখতে গেলে ৪-৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়। কী ভাবে সেই টাকা জোগাড় হবে? গুকেশ, প্রজ্ঞানন্দ, অর্জুনদের ব্যক্তিগত বিদেশি কোচ রয়েছে। তাদের সঙ্গে সারা বছর ওরা অনুশীলন করছে। তা হলে ফল তো আলাদা হবেই। গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়ার পরের ধাপে যাওয়ার জন্য যে কোচিং দরকার সেটা একমাত্র দক্ষিণ ভারতেই আছে। রমেশ, আনন্দের অ্যাকাডেমিতে বিদেশি কোচেরা শেখায়। সেটা তো বড় ফ্যাক্টর।”
২০১৮ সালে গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়া সপ্তর্ষি রায় আবার পশ্চিমবঙ্গের দাবাড়ুদের মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বললেন, “২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে গুকেশের রেটিং ছিল ২২৭৫। সেই সময় একটা প্রতিযোগিতায় ওকে হারিয়েছিলাম। তখন দীপ্তায়ন, সায়ন্তনেরা রেটিংয়ে ওর উপরে ছিল। আমাদের একটা বড় সমস্যা আছে। এখানকার দাবাড়ুরা গ্রুপ স্টাডি করে না। ওদের ওখানে সবাই মিলে গ্রুপ স্টাডি করে। এই গ্রুপ স্টাডি খুব সাহায্য করে। এখানে সবাই ভাবে আমি একা উঠব। কেউ কাউকে সাহায্য করে না। ফলে মানসিকতার একটা পার্থক্য তৈরি হয়। দক্ষতায় হয়তো বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে। ওখানকার দাবাড়ুদের স্বভাবও খুব ভাল। ওরা খুব শান্ত। সবার কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করে। সেটাও এখানে হয় না।”
কোনও রাজ্যে খেলার উন্নতি বা অবনতির নেপথ্যে সেই রাজ্যের প্রশাসনের কতটা ভূমিকা রয়েছে? প্রশাসনের বিষয়টি নিয়ে এলেন এ রাজ্যে দাবার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত অতনু লাহিড়ি। তিনি বললেন, “এখানে প্রশাসনের খালি প্রচার আছে, কিন্তু পরিকাঠামোর উন্নতি বা স্পনসর আনার ক্ষেত্রে কোনও সাহায্য করে না। প্রতিটা খেলায় কিছু প্রতিনিধি বা উপদেষ্টা নিয়োগ করা আছে। তারা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। তাদের আবার নিজস্ব অ্যাকাডেমিও আছে। তারা শুধু নিজেদের অ্যাকাডেমির উন্নতি করার চেষ্টা করে। খেলার উন্নতির কথা ভাবে না। খেলোয়াড়েরা এগিয়ে আসে না। সরকারও সাহায্য করে না। সাধারণ মানুষের সচেতনতা আছে। কিন্তু কী ভাবে এগোতে হবে সেটা জানে না। সেখানেই সমস্যা হচ্ছে।” পাশাপাশি দুই রাজ্যের খেলোয়াড়দের মানসিকতার পার্থক্যও তুলে ধরেছেন অতনু। তিনি বললেন, “ওরা অল্পে সন্তুষ্ট হয় না। এখানে একটু ভাল করলেই এত লাফালাফি হয় যে তারা নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে যায়। ওখানে সেটা হয় না। ওরা সব সময় আরও ভাল করার চেষ্টা করে।”
বর্তমানে দাবাকে পাঠ্য বিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তামিলনাড়ুতে। সেখানকার প্রতিটি স্কুলে নিয়ম মেনে করে শেখানো হয়। ফলে অনেক ছোট থেকেই দাবার প্রতি উৎসাহ তৈরি হয়। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান বলছে, শুধু মাত্র তামিলনাড়ুতে নথিভুক্ত দাবাড়ুর সংখ্যা ১২ হাজারের বেশি। নথিভুক্ত নয় এমন দাবাড়ুর সংখ্যা লাখের বেশি। প্রতি বছর শুধু তামিলনাড়ুতে ২০০-র বেশি দাবা প্রতিযোগিতা হয়। আর সেখানে প্রত্যক্ষ মদত থাকে রাজ্য সরকারের। তামিলনাড়ু সরকার খেলার দিকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দাবা অলিম্পিয়াড হয়েছে সেখানে। প্রতিযোগিতা চলাকালীন সেখানকার মানুষের উৎসাহ বুঝিয়ে দিয়েছে, চৌষট্টি খোপের খেলাকে কতটা গুরুত্ব দেয় তারা। তারই সুফল পাচ্ছে তামিলনাড়ু। উঠে আসছেন গুকেশের মতো প্রতিভারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy