নোভাক জোকোভিচ, রজার ফেডেরার, রাফায়েল নাদাল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
প্রথমে মঙ্গলবার, তার পর বুধবার। প্রথমে নোভাক জোকোভিচ, তার পর রাফায়েল নাদাল। উইম্বলডনের কোয়ার্টার ফাইনালে পর পর দু’দিন পিছিয়ে পড়েও দু’জনে পাঁচ সেটের লড়াইয়ে হারিয়ে দিলেন হাঁটুর বয়সি দুই প্রতিপক্ষকে। ৩৫ বছরের জোকোভিচ হারালেন তাঁর থেকে ১৫ বছরের ছোট জানিক সিনারকে। ৩৬-এর নাদাল হারালেন ২৪-এর টেলর ফ্রিৎজকে। ২০০৩ সালে রজার ফেডেরারের প্রথম উইম্বলডন (তাঁর প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম) জেতা থেকে ধরলে যে ৭৫টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম এখনও পর্যন্ত হয়েছে, তার মধ্যে ৬২টি জিতেছেন রজার, রাফা, জোকার। এর সঙ্গে অ্যান্ডি মারের তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ধরলে সংখ্যাটা হবে ৬৫। অর্থাৎ প্রায় ৮৭ শতাংশ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন এই চার জন। জিতেছেন নয়, জিতে চলেছেন। ফেডেরার যখন ২০০৩ সালে উইম্বলডন জেতেন, তখন তাঁর বয়স ২২। নাদাল প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতেন ১৯ বছর বয়সে, জোকোভিচ ২১-এ। ফেডেরার শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন ৩৭ বছর বয়সে। ৩৬-এর নাদাল এই বছর প্রথম দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যামই জিতে নিয়েছেন। জোকোভিচ গত বছর তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। এখনও গ্র্যান্ড স্ল্যামের সেমিফাইনাল মানেই এই তিন জনের খেলা নিশ্চিত।
২০১৯ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেন ফাইনালে ডোমিনিক থিম যখন একটি সেট জেতেন, তখন রোলাঁ গারোর বড় পর্দায় ভেসে উঠেছিল— এখন যাঁদের বয়স তিরিশের নিচে, থিম তাঁদের মধ্যে এক মাত্র, যিনি গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে একটি সেট জিততে পেরেছেন। এর পর এখনও পর্যন্ত এই তালিকায় যুক্ত হতে পেরেছেন আর মাত্র চার জন— স্টেফানোস চিচিপাস, মাত্তেয়ো বেরেত্তিনি, ডানিল মেদভেদেভ এবং আলেকজান্ডার জেরেভ। এর সারমর্ম, গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্ব টেনিসের তাজ যাঁদের হাতে, তাঁরাই এখনও রাজত্ব করছেন। এই কু়ড়ি বছরে অনেক তরুণ খেলোয়াড় এসেছেন, গিয়েছেন। কিন্তু কেউই জোকার, রাফাদের এখনও চ্যালেঞ্জ জানানোর জায়গাতেও পৌঁছতে পারেননি।
ফেডেরার-নাদাল-জোকোভিচ যুগের আগে তিরিশের কোঠায় পড়তে না পড়তে অবসর নিয়ে ফেলাটাই অলিখিত রীতি ছিল। আন্দ্রে আগাসি যখন ২৮ বছর বয়সে দ্বিতীয় বার ঝড় তুলেছিলেন, তখন ‘বুড়ো হাড়ে ভেল্কি’ বলে টেনিস মহল বাড়তি উল্লসিত হয়েছিল। কিন্তু রজার-রাফার যুগে এটাই এখন স্বাভাবিক। র্যাঙ্কিংয়ে নেমে গিয়েও ফের শীর্ষে এসেছেন, মঙ্গল-বুধবারের মতো খাদের কিনারা থেকে বার বার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁরা পারেন। এই তিন জনই পারেন। কিন্তু কী করে? টেনিস যেখানে এখন অনেক বেশি শরীর-সর্বস্ব, খেলোয়াড়দের গড় উচ্চতা যেখানে বেড়েছে, সার্ভিসের গতি বেড়েছে, খেলোয়াড়রা যেখানে অনেক শক্তিশালী হয়েছেন, সেখানে কী করে সেই নাদাল-জোকোভিচ-ফেডেরাররাই দু’দশক ধরে রাজত্ব করে যাচ্ছেন?
সবার আগে উঠে আসছে বিজ্ঞানের কথা। স্পোর্টস মেডিসিন এতটাই উন্নতি করেছে, গোটা ক্রীড়াবিশ্বের ছবিটাই বদলে গিয়েছে। ১০-১৫ বছর আগে খেলোয়াড়রা যেখানে এক জন ডাক্তার বা ফিজিয়ো নিয়ে খেলতে যেতেন, সেখানে এখন নাদালদের সঙ্গে চিকিৎসক, ট্রেনার, ফিজিয়োদের একটা গোটা দল থাকে। এঁরা নাদালদের দ্রুত তৈরি করে দিচ্ছেন। ঠিক এই কারণে একের পর এক গুরুতর চোটও নাদালের উপর থাবা বসাতে পারেনি। তাঁকে দেখে অবাক জন ম্যাকেনরো। নাদাল ফরাসি ওপেন জেতার পর ম্যাকেনরো বলেছিলেন, ‘‘নাদাল নিজেই বলেছে, পায়ের পাতার ব্যথা কমানোর জন্য ইঞ্জেকশন নিয়ে খেলতে হচ্ছিল ওকে। জানি না কী ভাবে ও এত বড় চোট নিয়েও চালিয়ে যাচ্ছিল আর ম্যাচ জিতছিল! অবিশ্বাস্য! রাফা যা করছে, অভাবনীয়!’’ নাদালের জায়গায় থাকলে তিনি যে পারতেন না, সেটাও বলে দিয়েছিলেন ম্যাকেনরো, ‘‘যদি ওর জায়গায় থাকতাম, যদি ৩৬ বছর বয়সি হতাম, নিশ্চিত করে বলতে পারতাম না, আর কত দিন খেলতাম। রাফা হয়তো আরও কয়েক বছর খেলে যেতে পারবে।’’
দীর্ঘ দিন ধরে কলকাতার সাইয়ে চিকিৎসক হিসেবে থাকা লায়লা দাস আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘সবার আগে দরকার সাধনা, শৃঙ্খলা। ওষুধ, প্রযুক্তি পরে। ফেডেরার, নাদালদের যা বয়স, তাতে খেলার ধার কমতে বাধ্য। তবু এঁরা অপ্রতিরোধ্য কারণ, সারা বছর নিজেদের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে রাখেন। আধুনিক প্রজন্ম হয়তো ততটা শৃঙ্খলাপরায়ণ নয়। নতুনদের হয়তো প্রতিভা আছে। কিন্তু শুধু প্রতিভা দিয়ে সব হয় না। এঁরা মানসিক ভাবে হয়তো ফেডেরারদের জায়গায় নেই।’’ কলকাতায় যে সানফিস্ট ওপেন টেনিস হত, সেখানেও তিন বছর চিকিৎসক ছিলেন লায়লা। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘‘তখন মার্টিনা হিঙ্গিস অবসর ভেঙে খেলতে এসেছিলেন। ওঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সাফল্যের শীর্ষে থেকেও মাত্র ২৩ বছর বয়সে কেন অবসর নিয়েছিলেন। হিঙ্গিস বলেছিলেন, এত কড়াকড়ি ওঁর পছন্দ নয়। বলেছিলেন, বন্ধুরা যেখানে চকোলেট, বার্গার, পিৎজা খাচ্ছে, নাইট ক্লাব থেকে শুরু করে ডিস্কো থেক-পাবে যাচ্ছে, সেখানে উনি এ সবের কথা ভাবতেও পারেন না। এই শৃঙ্খলার জীবন তাঁর পছন্দ নয়। তিনি ঘোড়ায় চড়তে ভালবাসতেন। কিন্তু চোটের ভয়ে মা ঘোড়ায় চড়তে দিতেন না। কমবয়সিদের মধ্যে সেই একাগ্রতা, শৃঙ্খলা থাকে না। নাদালদের পরবর্তী প্রজন্মেরও হয়তো এটাই সমস্যা। তা ছাড়া ওষুধ-প্রযুক্তির উন্নতি তো আছেই।’’
প্রাক্তন ডেভিসকাপার জয়দীপ মুখোপাধ্যায় বার বার একটি বিষয় তুলে ধরেন। সেটি হল টেনিস ক্যালেন্ডার। দক্ষতা, ফিটনেস তো আছেই, জয়দীপ মনে করেন, আধুনিক টেনিসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হল, নিখুঁত পরিকল্পনা করে সারা বছরের সূচি ঠিক করা। ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচরা এখন আর সব জায়গায় খেলে বেড়ান না। ২০১৯ সালে ফেডেরার যেমন ফরাসি ওপেনের আগে শুধু মাদ্রিদে ক্লে-কোর্টে খেলেছিলেন। উইম্বলডনের আগে নাদালও ঘাসের কোর্টে হাতে গোনা কয়েকটি ম্যাচ খেলেছিলেন। নাদাল-জোকোভিচরা এটা করতে পারেন। কিন্তু বাকিদের কাছে বাছাই করা প্রতিযোগিতায় খেলা বিলাসিতা। টেনিসের বিপুল খরচ মেটাতে তাঁদের দরকার পুরস্কারের টাকা, উন্নতি করতে দরকার র্যাঙ্কিং পয়েন্ট। ফলে শরীর না দিলেও তাঁদের সারা বছর খেলে বেড়াতে হয়। কেউ কেউ হয়তো প্রতিযোগিতা কী করে বাছাই করতে হয়, সেটাই রপ্ত করে উঠতে পারেন না। ঠিক এই জায়গায় বিপুল অভিজ্ঞতা কাজে লাগাচ্ছেন ফেডেরাররা।
কোর্টের ভিতরেও এই ১৫-২০ বছরের অভিজ্ঞতাটা দারুণ ভাবে কাজে লাগাচ্ছেন জোকোভিচরা। সিনারের বিরুদ্ধে জোকোভিচ কী করে জিতলেন, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জয়দীপ এই অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘অভিজ্ঞতার জোরে পাঁচ সেটের লড়াইয়ে শেষ হাসি হাসল জোকোভিচই। ওর অভিজ্ঞতাই এই পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়াতে বড় ভূমিকা নিল। তাই তৃতীয় সেটে শুরু থেকেই সিনারকে পাল্টা চাপ দিতে শুরু করল সার্ভিস রিটার্নে। বেসলাইনের পাশাপাশি নেটেও বেশি করে আসতে শুরু করল। ড্রপ শটের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়ে সিনারকে ওর অস্ত্রেই ঘায়েল করে পয়েন্ট তুলে নিল।’’
বছর কয়েক আগেও ফেডেরার-নাদালদের নিয়ে প্রশ্ন উঠত, তাঁরা কবে অবসর নেবেন? অবশ্যই অদূর ভবিষ্যতে তাঁরা অবসর নেবেন। কিন্তু ‘কবে’ এই প্রশ্ন এখন আর ওঠে না। তাঁরাও যেমন টেনিস উপভোগ করছেন, বিশ্ব টেনিসও তাঁদের শেষ কয়েকটা বছর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চাইছে।
পরবর্তী প্রজন্মও বুঝে গিয়েছে, সিনিয়র ত্রয়ী যত দিন থাকবেন, তাঁদের পক্ষে ধারাবাহিক ভাবে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। মুখে না বললেও এটুকু বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে, ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচ অবসর নিলে পরবর্তী প্রজন্ম স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। এর সব থেকে বড় প্রমাণ, গত বছরের মায়ামি ওপেন। তিন জনের কেউই খেলেননি। চ্যাম্পিয়ন হওয়া হুবার্ট হারকাজ প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে বাড়তি উৎসাহিত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘বিগ থ্রি নেই। মনে হয়, আমাদের প্রজন্মের সবাই এখানে জান লড়িয়ে খেলবে।’’ কিন্তু তা হয়নি। ঠিক যে তিন জনকে তখন ফেডেরারদের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে ভাবা হয়েছিল, বা এখনও হয়, সেই মেদভেদেভ, চিচিপাস এবং জেরেভের কেউ সেমিফাইনালেই যেতে পারেননি। তৎকালীন ৩৭ নম্বর হারকাজ ৩১ নম্বর সিনারকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। শীর্ষ বাছাই মেদভেদেভ চতুর্থ রাউন্ডে হেরে গিয়েছিলেন রবার্তো বাউতিস্তা অগের কাছে। চিচিপাসের দৌড়ও শেষ হয়ে গিয়েছিল চতুর্থ রাউন্ডে। হারকাজের কাছে হারার পর চিচিপাস স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কী সুযোগ হাতছাড়া করেছেন। বলেছিলেন, ‘‘ভেবেছিলাম সেরা সুযোগটা আমারই রয়েছে। নিজেকে চেনানোর জন্য এর থেকে বড় মঞ্চ আর পেতাম না।’’ সব থেকে খারাপ হাল ছিল জেরেভের। তাঁকে হারতে হয়েছিল ৮৩ নম্বরে থাকা এমিল রুসুভুয়োরির কাছে।
যাঁদের হাতে বিশ্ব টেনিসের ভবিষ্যৎ, তাঁরা ফেডেরার-নাদাল-জোকোভিচের না থাকারও সুবিধে নিতে পারেননি। তাই গত বছরের মায়ামিই বুঝিয়ে দিয়েছিল, ২০-২২ বছরের বাচ্চারা দুই দশক ধরে ‘বিগ থ্রি’-কে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তার ধারে-কাছে পৌঁছতে পারেননি। এ বারের উইম্বলডনে এগিয়ে থেকেও জোকোভিচকে হারাতে না পারা সিনার তখন বলেছিলেন, ‘‘পরবর্তী প্রজন্ম এখনও তৈরি নয়। ওদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক ভাবে জেতার ক্ষমতা এখনও আমাদের তৈরি হয়নি। হয়তো এক দিন সেই সময়টা আসবে। কিন্তু কবে আসবে, আমরা কেউই জানি না। হয়তো দু’বছর, হয়তো বা পাঁচ।’’ ২৪ বছরের আন্দ্রে রুবলেভ অবশ্য আশাবাদী। তাঁর মতে, ‘‘টেনিসের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কারণ, নতুন প্রজন্ম আসছে। আগের প্রজন্মের থেকে এই প্রজন্ম আলাদা। এদের খেলায় সেই জৌলুস আছে।’’
জৌলুস হয়তো আছে, কিন্তু ট্রফি?
কেন দানা ফোটাতে পারছে না আধুনিক প্রজন্ম, তার একটা ব্যাখ্যা দিলেন ফিটনেস ট্রেনার চিন্ময় রায়। ২০০৫ সলে গ্রেগ চ্যাপেল যখন ভারতীয় দলের কোচ হন তখন সহকারী ট্রেনার ছিলেন চিন্ময়। বললেন, ‘‘ওদের ফিটনেসের ভিতটাই খুব মজবুত। সব কিছুর জন্য আলাদা বিশেষজ্ঞ আছে ওঁদের। সেটা তো একটা তফাত গড়ে দিচ্ছেই। তবে মূল তফাত হল, দক্ষতা। সহজ ব্যাপার, এই প্রজন্মের খেলোয়াড়দের সেই দক্ষতা নেই। এটা মেনে নেওয়াই ভাল। মানসিকতাও একটা ব্যাপার। নাদাল তো ওই রকম চোট নিয়েও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত খেলার চেষ্টা করলেন। এই প্রজন্ম অনেক আগেই হয়তো হাল ছেড়ে দিত।’’
সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পিছনে চিন্ময়ের একটা ব্যাখ্যা আছে। বললেন, ‘‘নাদাল, ফেডেরাররা তাঁদের গোটা কেরিয়ার জুড়ে সাফল্যের মধ্যে রয়েছেন। ফলে মারাত্মক চোট পেয়েও তাঁরা খেলার জন্য নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারছেন। শুনলাম ফ্রেঞ্চ ওপেনে নাদাল না কি একের পর এক ইঞ্জেকশন নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন। যতই ইঞ্জেকশন নিন, ব্যথা কি তাতে পুরো কমে! কিন্তু পর পর ম্যাচ জেতার আনন্দ নাদালকে ওই অসহ্য যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছিল। এখনকার খেলোয়াড়দের সেই সাফল্য নেই বলে তাড়াতাড়ি হতাশ হয়ে পড়ছেন, যন্ত্রণা ফুটে উঠছে চোখে-মুখে।’’
সাফল্য না পেয়ে হাল ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ও। প্রাক্তন এই ফুটবলারের বক্তব্য, ‘‘এখনকার প্রজন্ম দ্রুত সাফল্য চায়। না পেলে সঙ্গে সঙ্গে হাল ছেড়ে দেয়। কারণ, অধিকাংশই খুব অর্থমনস্ক। দ্রুত টাকা দরকার। একটা সময়ের পর টাকাটাই সব হয়ে যায় এঁদের কাছে। টাকা হয়ে গেলে মাথা ঘুরে যাওয়ার ব্যাপারও রয়েছে। এটা সব খেলায় রয়েছে। সেই কারণে ফুটবলে আর দ্বিতীয় মেসি, রোনাল্ডো আমরা পেলাম না। ফেডেরার-নাদালরা কখনও টাকার জন্য খেলেননি। বড় বড় চোট নিয়েও খেলে গিয়েছে। এঁরা ট্রফিকে সম্মান করেন, মানুষের ভালবাসাকে সম্মান করেন। এঁরা জন্মেছেন খেলার জন্য, টাকার জন্য নয়। আমরা ত্রিমুকুটের জন্য খেলতাম। অথচ এখনকার মতো এত টাকা আমরা পেতাম না।’’
এই প্রসঙ্গেই প্রসূন বললেন, খেলা থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘সাফল্য না পেলেই এখন সবাই হয় খেলা ছেড়ে দিচ্ছে, না হলে অন্য খেলায় চলে যাচ্ছে। ঠিক এই কারণেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের একই অবস্থা। অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলও ধুঁকছে। মনে হয় টেনিসের আধুনিক প্রজন্ম তৎক্ষণাৎ সাফল্য না পেয়ে হয় খেলাধুলোই ছেড়ে দিচ্ছে, না হলে অন্য খেলায় চলে যাচ্ছে। আগেই বললাম, টাকাটাও একটা বিষয়। ডেভিড বেকহ্যাম বলেছিলেন, ওঁর কাছে ক্রিকেটার হওয়ারও সুযোগ ছিল। কিন্তু উনি টাকা এবং যশের টানে ফুটবল বেছে নিয়েছেন। আর এ বিষয়ে তো কোনও সন্দেহ নেই যে, টেনিস অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। ফেডেরার, নাদালদের পর্যায়ে পৌছতে না পারলে সেই খরচ চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব।’’
টেনিসে নতুন প্রজন্ম আসছে না, সেটা মানতে চাইছেন না প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত প্রশাসকরা। সল্টলেকে বেঙ্গল টেনিস অ্যাসোসিয়েশনের সিওও সুজয় ঘোষ বললেন, ‘‘বিশ্ব টেনিসে নতুন মুখ তো প্রায় প্রতি বছর আমরা পাচ্ছি। এখানেও ছোটরা টেনিসে আসছে না, তা নয়। এখন সংখ্যাটা কিছুটা কমেছে শুধু কোভিডের জন্য। কোভিডের আগে আমাদের অ্যাকাডেমিতে ৬২৪ জন খুদে প্রশিক্ষণ নিত। এখন সেই সংখ্যাটা ২৫০। কিন্তু ২০০-র বেশি বাচ্চা ওয়েটিং লিস্টে রয়েছে। তা-ও অন্য রাজ্যের তুলনায় আমাদের রাজ্যে সংখ্যাটা অনেক কম। আমরা চাইলেও এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়াতে পারব না। কারণ, সেই পরিকাঠামো নেই। আর্থিক কারণে আমাদের পক্ষে পরিকাঠামো তৈরি করা সম্ভব নয়। অন্য রাজ্যে একেক জনকে মাসে ছ’হাজার টাকার মতো ফি দিতে হয়। আমরা একেক জনের থেকে আড়াই হাজার টাকা করে নিই। আমাদের কর্মীই ৫২ জন। তাঁদের বেতন আছে। আর্থিক সমস্যায় খুব বেশি এগোনো সম্ভব নয়। ফলে বাচ্চারা আসছে না, সেটা বলব না। বরং নানা কারণে সংখ্যাটা বাড়ানো যাচ্ছে না। আর একটা বিষয় আছে। এখন যারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, তাদের হয়তো এক শতাংশও কাঙ্ক্ষিত মানের নয়। এরা আসছে শুধু নিজেকে ফিট রাখার জন্য। পড়াশোনার ফাঁকে স্রেফ অন্য কিছু করার জন্য। মনে হয় সারা বিশ্বজুড়ে এটাই ছবি।’’
নিজেরা কী করে বছরের পর বছর রাজত্ব করছেন, তার হয়তো ব্যাখ্যা নেই ‘বিগ থ্রি’-র কাছে। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে কী ভাবছেন, সেটা পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন খোদ জোকোভিচ। সেটা জানার আগে আগে একটু ফ্লাশব্যাকে যাওয়া প্রয়োজন। পাঁচ বছর আগে ২০১৭ সালে নতুন একটি প্রতিযোগিতা নিয়ে রোম মাস্টার্সের সাংবাদিক সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল জোকোভিচকে। কুড়ি বছর ধরে ফেডেরার, নাদাল, জোকোভিচের দাপটে বিশ্ব টেনিসের নিয়ামক সংস্থা এটিপি-ও খেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তারা প্রমাণ করতে চেয়েছিল, বিগ থ্রি-র বাইরেও টেনিসের একটা ভবিষ্যৎ আছে, যা না কি যথেষ্ট উজ্জ্বল। তারা পরবর্তী প্রজন্মের একটা গালভরা নামও দিয়েছিল, ‘নেক্সট জেন’। তাদের কথা ভেবেই সেই প্রতিযোগিতা ‘নেক্সট জেন এটিপি ফাইনালস’ আয়োজেত হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতা নিয়ে জোকোভিচ বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘যেখানে যাচ্ছি, ‘নেক্সট জেন’, ‘নেক্সট জেন’ শুনছি।’’ পাঁচ বছর পরে সেই রোম মাস্টার্সেই তাঁর থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট চার জনকে হারিয়ে জোকোভিচ বলেন, ‘‘রজা, রাফা আর আমিই তো নেক্সট জেনের নতুন সংজ্ঞা লিখছি। আমরাই নেক্সট জেন।’’ এ রকম গলাবাজি করতেই পারেন জোকাররা। তাঁদের প্রজন্ম সেই যোগ্যতা অর্জন করেছে। এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ধরলে ফেডেরার, জোকোভিচ, নাদাল, মারে মিলিয়ে টানা ৯২১ সপ্তাহ, অর্থাৎ প্রায় ১৮ বছর র্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ স্থান দখল করে বসেছিলেন। ১৮ বছরে শুধু নেক্সট জেন কেন, তিন-চারটি প্রজন্মের খেলা হয়ে যেত। হুয়ান মার্টিন দেল পোত্রো, গ্রিগর দিমিত্রভ, মারিন সিলিচ, কেই নিশিকোরিদের সাড়া জাগিয়েও হারিয়ে যাওয়া তার প্রমাণ।
এ বার মেদেভেদেভ, চিচিপাস, আলকারাজরা কি পারবেন ‘বিগ থ্রি’-র জায়গা নিতে? সময় বলবে। ‘নেক্সট জেন’ শুনে ক্লান্ত জোকোভিচ তত দিনে হয়তো বুঝে যাবেন, পরের প্রজন্ম আসবে, কিন্তু তাঁদের ছাপিয়ে যেতে হয়তো পারবে না। প্রশ্ন থাকবে, এই প্রজন্মকে কি শুধুই ‘পরবর্তী’, ‘নতুন’, ‘আলাদা’ বলতে হবে, ‘উন্নত’ কি বলা যাবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy