সৌদি আরবের ক্লাব আল নাসেরে প্রথম দিন রোনাল্ডো। —ফাইল ছবি।
খেলার দুনিয়ার নতুন গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। ফুটবল, ক্রিকেট, গল্ফ, রাগবি, ফর্মুলা ওয়ান। তালিকা দৈর্ঘ্যে বাড়ছে। টাকার থলি নিয়ে ছুটছেন আরব দেশগুলির ধনকূবেররা। বিনিয়োগ করছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের সরকার। কতটা লাভ হচ্ছে খেলার? মধ্যপ্রাচ্যের ক্রীড়া সংস্কৃতি কতটা বদলাচ্ছে?
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির খেলার দুনিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় ক্রীড়া জগতের অনেকে শঙ্কিত। অনেকে আশাবাদীও। কাতারে ফুটবল বিশ্বকাপের পর থেকে ক্রীড়া জগতে আলোচনার অন্যতম বিষয় মধ্যপ্রাচ্য। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, করিম বেঞ্জেমারা সই করছেন সৌদি আরবের ক্লাবে। লিয়োনেল মেসির পিছনেও টাকার থলি নিয়ে ছুটেছে সৌদির ক্লাব আল হিলাল। আগামী দিনে বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করতে আগ্রহী সৌদি। কাতার বিশ্বকাপের সাফল্যই কি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির আগ্রহ বাড়িয়েছে?
একদমই তা নয়। ক্রীড়া জগতে শেখদের উৎসাহ হঠাৎ নয়। একটু পিছনে দিকে তাকালে বোঝা যাবে, গত দু’দশক ধরে ধীরে ধীরে এগিয়েছে মধ্যপ্রাচ্য। ২০০৪ সালে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরশাহি। পরিকল্পনা করা হয় ৫০ কোটি বর্গ ফুটের দুবাই স্পোর্টস সিটির। লক্ষ্য ছিল, বিশ্বের সব জনপ্রিয় খেলাকে এক ছাতার তলায় নিয়ে আসা। বিভিন্ন খেলার বিশ্ব নিয়ামক সংস্থার সদর দফতরকে এক জায়গা নিয়ে আসা। আমিরশাহির ডাকে প্রথম সাড়া দিয়েছিল ক্রিকেট। লন্ডনে ৯৬ বছরের ‘ভাড়া বাড়ি’ লর্ডস ছেড়ে দুবাইয়ে সদর দফতর সরিয়ে এনেছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি। ২০০৫ সাল থেকে আইসিসির সদর দফতর দুবাইয়ে। দুবাই স্পোর্টস সিটিতে রয়েছে ২৫ হাজার দর্শকাসনের ক্রিকেট স্টেডিয়াম। রয়েছে আইসিসির আধুনিক ক্রিকেট অ্যাকাডেমি। যেখানে প্রশিক্ষণ বা অনুশীলনের জন্য রয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মতো পিচ।
মুখ ফিরিয়ে থাকেনি অন্য খেলাও। স্পেনের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা গড়ে তুলেছে সকার স্কুল। রয়েছে পাঁচ হাজার আসনের রাগবি স্টেডিয়াম। রয়েছে গল্ফ স্কোর। রয়েছে ১০ হাজার আসনের ইন্ডোর স্টেডিয়াম। যেখানে টেনিস, বাস্কেটবল, সাইক্লিং, এবং আইস হকি খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। দুবাই স্পোর্টস সিটিতে রয়েছে বিভিন্ন খেলার শিক্ষার্থী, খেলোয়াড়, কোচ, রেফারি (কিছু ক্ষেত্রে আম্পায়ার) এবং কর্তাদের সব রকম আধুনিক সুযোগ সুবিধা।
আরব দেশগুলি শুধু যে নিজেদের ঘরেই ডেকেছে ক্রীড়া বিশ্বকে, তা নয়। ঘরের বাইরেও পা ফেলেছে। প্যারিস সঁ জরমঁ কিনেছেন কাতারের ব্যবসায়ী নাসের আল খেলাইফি। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির মালিক খালদুন আল মুবারক আমিরশাহির ব্যবসায়ী। নিউক্যাসেল ইউনাইটেডের মালিকানা রয়েছে সৌদির এক ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে। অ্যাস্টন ভিলার মালিক মিশরের ব্যবসায়ী নাসেফ সাওয়ারিস। শেফিল্ড ইউনাইটেডে বিনিয়োগ করেছেন সৌদির যুবরাজ আব্দুল্লাহ বিন মোসাদ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ। মধ্যপ্রাচ্যের রাজ পরিবারগুলির হাতে রয়েছে ইউরোপের সাতটি ক্লাবের মালিকানা।
খনিজ তেলের ভান্ডার আরব দেশগুলিতে ‘গৌরী সেন’-এর অভাব নেই। কোনও পরিকল্পনা রূপায়নের অর্থ সংস্থানের জন্য ভাবতে হয় না। বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিবিদদের নিয়ে এসে তাক লাগানো পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, দক্ষতায় না হলেও পরিকাঠামোর দিক থেকে ইউরোপ বা আমেরিকার উন্নত দেশগুলির সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লা দিতে পারে আরব দুনিয়া। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগিয়েও গিয়েছে তারা। আরব দেশগুলির ব্যবসায়ীরাও নিজেদের ইচ্ছা অপূর্ণ রাখেন না।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, একটি দেশ বা জাতি আর্থ-সামাজিক ভাবে কতটা উন্নত তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের ক্রীড়া সংস্কৃতি থেকে। মানব জীবনের ন্যূনতম চাহিদা খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান, পরিকাঠামো— এ সব পূরণ হলে সংশ্লিষ্ট দেশ বা জাতি উন্নত ক্রীড়া সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারে। স্বাভাবিক চাহিদা পূরণের পর সামর্থ্য থাকলে তারা বিনোদন বা ক্রীড়ায় বিনিয়োগ করে। আরব দেশগুলির রক্ষণশীল সমাজ পশ্চিমী বিনোদনের বিরোধী। আরব দেশের ধনকূবেররা তাই খেলাধূলাকেই বিনোদন হিসাবে বেছে নিয়েছেন। তাঁরা ছুটছেন প্রথম সারির ফুটবল ক্লাবগুলি কেনার জন্য। টাকার থলি নিয়ে ছুটছেন রোনাল্ডো, মেসিদের পিছনে। সব ক্ষেত্রে সাফল্য না এলেও চেষ্টায় খামতি রাখছেন না তাঁরা।
ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করেছে কাতার। ফর্মুলা ওয়ানের আসর বসছে আবু ধাবিতে। গল্ফেও শেখদের অর্থ শক্তির কাছে হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে আমেরিকার পিজিএ ট্যুর এবং ইউরোপীয় ট্যুর। সৌদির এলআইভি ট্যুরের সঙ্গে গত সপ্তাহে হঠাৎ মিশে গিয়েছে গল্ফ দুনিয়ার দুই সেরা ট্যুর। অথচ সৌদির এলআইভি ট্যুরের জন্ম মাত্র দু’বছর আগে। গল্ফের এশিয়া ট্যুরেও আরব দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ রয়েছে। স্বভাবতই আগামী দিনে এশিয়া ট্যুরের মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।
তিনটি প্রধান ট্যুর এক সঙ্গে মিশে যাওয়ায় কতটা ভাল হল গল্ফের? প্রশ্ন উঠছে। বিশ্বের প্রথম সারির গল্ফ খেলোয়াড়দের প্রায় সকলেই ক্ষুব্ধ, বিস্মিত। তাঁরা কেউ জানতেন না এমন পরিণতির কথা। ভারতের অন্যতম সেরা গল্ফ খেলোয়াড় শিবশঙ্কর প্রসাদ চৌরাসিয়াও আশা করেননি এত তাড়াতাড়ি মিশে যেতে পারে তিনটি ট্যুর। আনন্দবাজার অনলাইনকে শিবশঙ্কর বললেন, ‘‘তিনটি ট্যুরকে এক দিন হাত মেলাতেই হত। সেটা এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে ভাবিনি। ঝগড়া, লড়াই করে কত দিন চলা যায়? তাতে কি ভাল কিছু হয়? ঝগড়া কবে কার কবে লাভ হয়েছে?’’ এতে গল্ফের কি ভাল হবে? শিবশঙ্কর বলেছেন, ‘‘ভালই হবে। খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি টাকা উপার্জন করতে পারবেন। সেরা খেলোয়াড়েরা সব জায়গায় খেলতে পারবেন। একটা বিষয় অবশ্য রয়েছে। তিনটে ট্যুর মিশে যাওয়ার পর সেগুলো কী ভাবে পরিচালিত হবে, সেটা আমরা জানি না। পরিচালিত হওয়ার উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।’’
শিবশঙ্কর আশাবাদী। ভাল পারফরম্যান্স করতে পারলে সব দেশের খেলোয়াড়েরা বিশ্বের সেরাদের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাবেন। তাতে লাভ হতে পারে ভারতীয়দেরও। কেমন সেই লাভ? শিবশঙ্কর বলেছেন, ‘‘আমার বা আপনার বাড়ির ছোটদের কারও আগামী দিনে খেলোয়াড় হওয়ার ইচ্ছা থাকতে পারে। যে খেলাই হোক। গল্ফ হতে পারে, ফুটবল, ক্রিকেটও হতে পারে। ভাল পারফরম্যান্স করলে আরব দেশগুলো থেকে ডাক পেতে পারে। তাতে সেরা খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলার সুযোগ পাবে। তা ছাড়া আয় বাড়বে। পেশাদার খেলোয়াড়েরা খেলেই আয় করে। আরব দেশগুলো খেলায় প্রচুর বিনিয়োগ করছে। ভাল পুরস্কার মূল্য দিচ্ছে। সব থেকে বড় সুবিধা হল ওরা পুরস্কার মূল্যের উপর কর নেয় না। ফলে পুরো টাকাটাই পাওয়া যায়। আমরা যেখানে সেরা সুযোগ-সুবিধা পাব, সেখানেই খেলতে যাব। আমি অন্তত সমস্যা দেখছি না।’’ তাঁর আরও যুক্তি, ‘‘পৃথিবীর সেরা খেলোয়াড়েরা তো বিদেশের ক্লাবে খেলেন। তা হলে মধ্যপ্রাচ্যে নয় কেন? রোনাল্ডোর মতো পেশাদার খেলোয়াড় এসেছেন। ভাল মনে না করলে কি আসতেন?’’
ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, অ্যাথলেটিক্স, রাগবি, গল্ফ, ফর্মুলা ওয়ানের মতো খেলাগুলিতে বিপুল বিনিয়োগ করছে আরব দুনিয়া। বেছে নেওয়া হচ্ছে মূলত বিশ্বের বিভিন্ন অংশে জনপ্রিয় এবং ব্যবসায়িক লাভজনক খেলাগুলিকে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিশ্বের সর্বত্র নিজেদের উপস্থিতি, প্রভাব নিশ্চিত করা। সে জন্য নিজেদের সংস্কৃতি জলাঞ্জলি দিতে রাজি নয় তারা। গত ফুটবল বিশ্বকাপেই কাতারের রাজার নির্দেশে স্টেডিয়ামগুলিতে বিয়ার বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফিফার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক সংস্থার স্বার্থে আঘাত লাগলেও মেনে নিয়েছে ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা। কার্যত বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেওয়া হয়েছে আর্থিক ক্ষতিও।
ক্রীড়া বিশ্বে ক্রমশ লম্বা হচ্ছে আরব দুনিয়ার ছায়া। ইউরোপের কিছু দেশ বা আমেরিকার দীর্ঘ দিনের একচ্ছত্র দাপট ধাক্কা খাচ্ছে এশিয়ার সীমানায়। খেলার মাঠে চিনের মতো সাফল্য হয়তো এখনও পাচ্ছেন না আরব দেশের খেলোয়াড়েরা। এশীয় মানে কিছু ক্ষেত্রে দাপট দেখাতে শুরু করলেও বিশ্ব পর্যায় এখনও পিছিয়ে রয়েছেন তাঁরা। গত কয়েকটি অলিম্পিক্স, এশিয়ান গেমসের পদক তালিকায় চোখ রাখলেই তা বোঝা যায়। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে পদকের হিসাবে আরব দুনিয়ার সফলতম দেশ ছিল ইরান। ৩টি সোনা, ২টি রুপো এবং ২টি ব্রোঞ্জ নিয়ে তারা ছিল ২৭ নম্বরে। দ্বিতীয় সফল দেশ ইজরায়েল ২টি সোনা, ২টি ব্রোঞ্জ পেয়ে শেষ করেছিল ৩৯তম স্থানে। গত এশিয়ান গেমসেও সফলতম দেশ ছিল ইরান। ২০টি সোনা, ২০টি রুপো এবং ২২টি ব্রোঞ্জ জিতে তারা শেষ করে ছিল ষষ্ঠ স্থানে। মোট পদক সংখ্যায় অষ্টম স্থান পাওয়া ভারতের (৬৯টি) থেকে সাতটি কম ছিল। বিশ্বকাপ ফুটবলে সৌদি আরব মেসির আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমক দেখালেও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির সার্বিক ফলাফল আহামরি নয়।
মাঠের লড়াইয়ে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও খেলার দুনিয়া নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। খনিজ তেলের বিপুল লভ্যাংশ বিনিয়োগ করা হচ্ছে খেলায়। ফলাফল যাই হোক! লাভবান হচ্ছেন খেলোয়াড়েরা। লাভবান হচ্ছে ক্রীড়া নিয়ামক সংস্থাগুলি। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনীতির প্রবল মন্দার ধাক্কা সামাল দিতে খেলার মাঠ থেকে ইউরোপ, আমেরিকার একের পর এক বহুজাতিক সংস্থা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছিল। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের ধনকূবেরেরা। ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিপুল বিনিয়োগ করতে শুরু করেন তাঁরা। অর্থ সঙ্কটে থাকা ক্রীড়া নিয়ামক সংস্থাগুলিও হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলেনি।
সুযোগ কাজে লাগিয়ে আরব দেশগুলি ব্যবসার পাশাপাশি প্রভাবও বাড়িয়েছে। খেলার মাঠ রাস্তা দেখিয়েছে তাদের। বিলাস বহুল জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত শেখদের শখ এখন খেলায় বিনিয়োগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy