Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

এই মেসিকে শুধু শিল্পী বলা ভুল হবে

তারিখটা এখনও পরিষ্কার মনে আছে। ১৫ জুন ২০১৪। ব্রাজিলে বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে আর্জেন্তিনা মুখোমুখি হবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার। সত্তর হাজার মানুষের মতো আমিও টিকিট কেটেছিলাম মারাকানা স্টেডিয়ামে বসে লিওনেল মেসিকে দেখব বলে।

ফুটবল ঈশ্বরকে ভক্তের প্রণাম। বুধবার হিউস্টনে

ফুটবল ঈশ্বরকে ভক্তের প্রণাম। বুধবার হিউস্টনে

দীপেন্দু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০৯:৩৪
Share: Save:

আর্জেন্তিনা ৪ : যুক্তরাষ্ট্র ০

(লাভেজ্জি, মেসি, ইগুয়াইন-২)

তারিখটা এখনও পরিষ্কার মনে আছে। ১৫ জুন ২০১৪। ব্রাজিলে বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে আর্জেন্তিনা মুখোমুখি হবে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার। সত্তর হাজার মানুষের মতো আমিও টিকিট কেটেছিলাম মারাকানা স্টেডিয়ামে বসে লিওনেল মেসিকে দেখব বলে।

মেসিকে সামনে থেকে দেখার এতটাই লোভ ছিল যে ম্যাচ শুরুর অনেক আগেই পৌছে গিয়েছিলাম স্টেডিয়ামে। আমি আরও একটা জিনিস দেখতে চেয়েছিলাম। ম্যাচের আগে কী ভাবে ওয়ার্ম আপ করেন মেসি। দেখেছিলাম কিছুটা হাল্কা স্ট্রেচিং করলেন প্রথমে। তার পর বাকিটা বল নিয়ে। পাস দেওয়া। বলটাকে রিসিভ করা। সব কিছুই হচ্ছিল টাচের উপর। মনে হচ্ছিল, বলটাকে শাসন করার কাজটা যেন ওয়ার্ম আপ থেকেই শুরু করে দিয়েছেন ফুটবলের জাদুকর। সেই টাচ প্লে-টাই দেখেছিলাম মাঠে। অসাধারণ সব পাস। একটা দুর্দান্ত গোলও করলেন। আন্দাজ করতে পারছিলাম, মেসির গেম রিডিং কতটা ভাল। ওয়ার্ম আপের সময়ই যেন মাথায় ছকে নিয়েছিলেন কী ভাবে ম্যাচটাকে নিয়ন্ত্রণ করবেন।

সেই ম্যাচের দু’ বছর পরে আবার যেন একই মেসিকে ফিরে পেলাম। এ বার শতবর্ষের কোপা সেমিফাইনাল। প্রতিপক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বার মাঠে নয়, টিভির সামনে বসে দেখলাম মেসি-ম্যাজিক। সেই একই রকম টাচ, একই রকম পাসিং। প্রতিটা মুভের পিছনেই ছিল ক্ষুরধার ফুটবল বুদ্ধি। আর সবশেষে সেই ফ্রি-কিক। ভোর সাড়ে ছ’টায় উঠে যা দেখার পর রাতেও ঘোর কাটছে না।

কোপা আর ইউরোর মধ্যে বিশাল পার্থক্য। সত্যিই তো কোপার না আছে ইউরোর মতো কোনও গ্ল্যামার। না আছে ম্যাচগুলোর মধ্যেও কোনও উত্তেজনার মশলা। কিন্তু এই সাধারণ একটা কোপাকেও অন্য মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছেন মেসি। পানামা ম্যাচ থেকে যে বিধ্বংসী মেজাজে রয়েছেন, সেটা ক্রমশ চড়ছে। প্রতিটা ম্যাচেই আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছেন। এমন সব মুভ তৈরি করছেন যা ফুটবল বিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে মেসিকে দেখলাম, তাঁর নামের পাশে শুধু ‘শিল্পী’ শব্দটা বসানো এখন আর যথেষ্ট নয়। কিছু দিন আগে কাগজে পড়েছিলাম, মারাদোনা বলেছেন মেসির মধ্যে লিডার হওয়ার যোগ্যতা নেই। আমার কিন্তু কোপায় মেসিকে দেখার পর মনে হচ্ছে, এই মেসি যথার্থ এক জন লিডারও। যিনি নিজের ঘাড়েই গোটা দলের দায়িত্ব তুলে নিয়েছেন। এই মেসি তো ডিফেন্ডারদের দুঃস্বপ্ন। যাঁর পায়ে বল থাকা মানে তোমার যাবতীয় আশা শেষ। এই মেসি তো বিশ্বমানের স্কিমার। যিনি এমন সমস্ত পাস বাড়াচ্ছেন যা থেকে গোল না করাই কঠিন। মনে হচ্ছে, স্পেনের অন্যতম সেরা অ্যাকাডেমি লা মাসিয়ার ব্লু-প্রিন্টটা তুলে এনেছেন এই আর্জেন্তিনা দলে।

প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যে লাভেজ্জির হেড থেকে এগিয়ে যায় আর্জেন্তিনা। কিন্তু স্কোরবোর্ড তো আর দেখাচ্ছে না লাভেজ্জিকে বাড়ানো মেসির অসাধারণ লবটা। য়ুরগেন ক্লিন্সম্যানের যুক্তরাষ্ট্র মেসিকে আটকানোর জন্য যত রকম স্ট্র্যাটেজি কষার কষে এসেছিল। কিন্তু মেসির মতো প্রতিভা থাকলে কারও কিছু করার থাকে না। শিল্পের বিরুদ্ধে সিস্টেমকে হার মানতেই হয়।

মেসির ফ্রি-কিকটা দেখে অনেকের মনে হতে পারে, কী এমন বিশেষত্ব আছে? পাঁচ বারের ব্যালন ডি’অর জয়ী ফুটবলারের থেকে এ ধরনের ফ্রি-কিক তো প্রত্যাশিত। কিন্তু একটু আধটু ফুটবল খেলেছি বলে জানি ফ্রি-কিকে গোল করা কতটা কঠিন ছিল। কোনও বাঁ পায়ের ফুটবলারের পক্ষে মাঠের বাঁ দিক থেকে ইনস্টেপে বল কার্ল করানো মোটেও সহজ নয়। তার উপরে আবার ওয়াল আপনার পুরো নজরটা ঢেকে দিচ্ছে। আর আপনাকে বলটা ঢোকাতে হবে সেই পোস্টের কোন ঘেঁষে যে দিকে গোলকিপার দাঁড়িয়ে আছে। মেসি সব ক’টা কঠিন হার্ডলই খুব সহজে টপকে গেলেন একটা ইনস্টেপ কিকে। ফ্রি কিকটা যদি ম্যাচের চকোলেট কেক হয়, তবে ‘আইসিং অন দ্য কেক’ ছিল ইগুয়াইনকে বাড়ানো পাসটা। মেসির পাশে পাশে এক জন ডিফেন্ডার দৌড়চ্ছিল, তার ও পাশে ইগুয়াইন। মেসি ও দিকে না তাকিয়েই ডান দিকে পাসটা ঠেলে দিলেন। ইগুয়াইনের কাজটা ছিল শুধু গোলে বলটা ঠেলা। নিখুঁত পেরিফেরাল ভিশন।

গত কয়েক বছরে দেখছি মেসির খেলা মানে শুধু গোল নয়। যে ম্যাচে গোল করতে পারেন না, গোলের পাস দিয়ে দলকে জেতানোর চেষ্টা করেন। কোনও সময় একটা নির্দিষ্ট পজিশনে দাঁড়িয়ে থাকেন না। আর্জেন্তিনায় এ বার জেরার্দো মার্টিনো এমন ছক কষেছেন যে পুরোটাই মেসি-কেন্দ্রিক। ইগুয়াইন, রোখো, মাসচেরানো সবার পজিশনিং করা হয়েছে এমন ভাবে যাতে মেসি ফ্রি-রোলটা খেলতে পারেন। ৪-৩-৩ ফর্মেশনে উইংয়ে শুরু করলেও মেসি আসলে কিন্তু খেলছিলেন ঠিক স্ট্রাইকারের নীচে। অর্থাৎ শ্যাডো স্ট্রাইকার। ইগুয়াইন-লাভেজ্জিরা বারবার বাকি মার্কারদের টেনে নিচ্ছিলেন। যাতে মেসির জন্য জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়।

মার্টিনোর স্ট্র্যাটেজি খেটে গিয়েছে, মেসি দুরন্ত ফর্মে। এই আর্জেন্তিনাকে আটকাবে কে?

অন্য বিষয়গুলি:

Lionel Messi Copa America
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy