Advertisement
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Paris Olympics 2024

লাঞ্ছনার জবাব দিয়ে সোনার মুখে বিনেশ

সব কিছুর জবাব কুস্তির ম্যাটেই দিয়ে দিলেন বিনেশ ফোগত। তা-ও আবার অলিম্পিক্সের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চে!

প্রথম বার অলিম্পিক্সের ফাইনালে ওঠার পরে বিনেশ ফোগত। মঙ্গলবার।

প্রথম বার অলিম্পিক্সের ফাইনালে ওঠার পরে বিনেশ ফোগত। মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই।

সুমিত ঘোষ
প্যারিস শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৪ ০৮:২৩
Share: Save:

যন্তর মন্তর থেকে চ্যাংদোলা করে বার করে দেওয়া।

হরিদ্বারের গঙ্গায় সব পদক ভাসিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।

সংস্থার প্রভাবশালী প্রধানের বিরুদ্ধে সরব হয়ে চল্লিশ দিন ধরে ধর্নায় বসা।

আন্দোলনে নামার জন্য সর্বস্ব হারানোর ঝুঁকি।

সব কিছুর জবাব কুস্তির ম্যাটেই দিয়ে দিলেন বিনেশ ফোগত। তা-ও আবার অলিম্পিক্সের মতো সর্বোচ্চ মঞ্চে! আজ পর্যন্ত ভারতের কোনও কুস্তিগির যা করে দেখাতে পারেনি, যা ক’দিন আগে কেন কয়েক ঘণ্টা আগেও কেউ ভাবতে পারেনি, তা-ই করে দেখালেন তিনি। সারা বিশ্বকে চমকে দিয়ে প্যারিসে কুস্তির ৫০ কেজি বিভাগে ফাইনালে পৌঁছে গেলেন বিনেশ। দাঁড়ান, ভুল লেখা হয়নি। ফাইনালেই পৌঁছেছেন বিনেশ।

কী ভাবে ব্যাখ্যা করা হবে একে? সমস্ত গা জোয়ারি, সব আক্রমণকে উড়িয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নেওয়া তাঁর এই প্রাপ্তিকে? একটাই তুলনা মাথায় আসছে। জোয়ান অব আর্ক। জার্মানদের হাত থেকে নিজের দেশকে মুক্ত করতে যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। অনমনীয় জেদ আর ভয়ডরহীন মনোভাবে টগবগিয়ে ছুটে চলেছিল। বিনেশও যেন ভারতীয় খেলার জোয়ান অব আর্ক। অত্যাচারী শাসকদের বাহুবলের সামনে নতিস্বীকার করতে না চাওয়া এক যোদ্ধার নাম। গত ১৮ মাসের যন্ত্রণা যেন উগরে দিচ্ছিলেন কুস্তির ম্যাটে।

যদি মনে হয়, বিনেশের সঙ্গে তুলনা করা বাড়াবাড়ি, তা হলে পুরনো সেই ছবিটা বার করে আবার দেখুন। দেশের হয়ে পদক জেতা অ্যাথলিটদের কী ভাবে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলি‌শ! জোয়ান অব আর্ক-কে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। মেয়ে হয়ে আবার যুদ্ধ করবে কেন? ছেলেদের মতো পোশাক-আশাক পরে ঘোড়া ছোটাবে কেন? ঢং দেখানো বিচারসভায় জোয়ান অব আর্কের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধই খুঁজে পাওয়া যায়নি। একমাত্র অভিযোগ ওঠে, মেয়ে হয়েও তিনি ছেলেদের মতো পোশাক পরেছেন কেন? এই ‘অপরাধেই’ তাঁকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। বিনেশ ফোগত এমন এক গ্রাম থেকে উঠে এসেছেন, যেখানে একই ভাবে মেয়েদের খেলাধুলোয় অংশ ছিল অমার্জনীয় অপরাধ। ফোগত পরিবারই প্রথম বিদ্রোহ ঘোষণা করে তাদের মেয়েদের কুস্তির আখড়ায় পাঠায়। আজ, সোনার সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলা বিনেশের সামনে শুধু কুস্তি সংস্থার কর্তারা নন, শুধু যন্তর মন্তরে গায়ে হাত তোলা পুলিশবাহিনী নয়, রক্ষণশীল সেই গ্রামেরও লজ্জায় মাথা নত করার দিন। জোয়ান অব আর্ক দেখলেও শিউরে উঠবেন যে, আমার মৃত্যুদণ্ডের এত বছর পরেও এ ভাবে ওরা মেয়েদের আক্রমণ করে?

আইফেল টাওয়ারের পাশে হচ্ছে প্যারিস অলিম্পিক্সের কুস্তি ইভেন্ট। বিনেশ যখন তাঁর চেয়ে র‌্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা প্রতিযোগীদের একের পর এক হারিয়ে জোয়ান অব আর্কের মতোই ঘোড়া ছোটাচ্ছেন, মনে হচ্ছিল, ভারতীয় খেলাধুলোয় আইফেল টাওয়ারের মতোই সেরা মিনার হয়ে থাকবেন তিনি। ভারতের অলিম্পিক্স ইতিহাসে আজ পর্যন্ত মাত্র দু’জন ব্যক্তিগত ইভেন্টে সোনা জেতার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। শুটিংয়ে অভিনব বিন্দ্রা এবং জ্যাভলিনে নীরজ চোপড়া। মঙ্গলবারই নীরজ দুরন্ত ভঙ্গিতে প্রথম থ্রো-তেই ফাইনালের জন্য যোগ্যতা অর্জন করে ফেললেন। টানা দুটি অলিম্পিক্সে সোনা জেতার বিরল কীর্তির জন্য তিনি ঝাঁপাবেন বৃহস্পতিবার। কেউ ভাবেইনি এর মধ্যে আর এক জন সোনা জয়ের উজ্জ্বল আকাশ তৈরি করতে পারেন। বিনেশ সেই অসাধ্য সাধন করে দেখালেন। ফাইনালে সোনার লড়াইয়ে তিনি নামবেন বুধবারই। প্রতিপক্ষ আমেরিকার সারা হিলডেব্রান্ট।

কুস্তিতে একই দিনে একাধিক লড়াইয়ে অংশ নিতে হয় প্রতিযোগীদের। তা মাথায় রাখলে বিনেশের এ দিনের কীর্তিকে আইফেল টাওয়ারের মতোই সুউচ্চ দেখাবে। একই দিনে তিন জন প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করে দিলেন তিনি। নাকি লেখা উচিত তিন জন প্রতিযোগী আসলে নিমিত্ত মাত্র। বিনেশ এঁদের বিরুদ্ধে লড়ছিলেনই না। তাঁর আসল যুদ্ধ তো কুস্তির ব্রিজভূষণদের বিরুদ্ধে। আজ্ঞাবহ হয়ে যে পুলিশ কর্তারা তাঁদের বলপূর্বক যন্তর মন্তর থেকে তুলে দিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য। কিউবার ইয়ুসনেলিস গুজ়মান লোপেজ়কে তিনি সেমিফাইনালে হারালেন ৫-০। কিন্তু এ দিন তাঁর সেরা প্যাঁচ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইউ সুসাকিকে হারানো। জীবনে মাত্র তিনটি লড়াইয়ে হেরেছেন সুসাকি। তিনি নিজেও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন হেরে যাওয়ার পরে। যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, বিনেশ তাঁকে হারিয়ে দিল। আসলে বিনেশ তো একা নন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা, সব অত্যাচারের জবাব দিতে চাওয়া এক পালোয়ানের মুখে পড়েছিলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। আজ ঘোড়া ছুটিয়ে সব কিছুকেই উড়িয়ে দিতে এসেছিলেন বিনেশ। বিশ্বচ্যাম্পিয়নও রেহাই পেলেন না। বিনেশ একালড়ছিলেন না। লড়ছিলেন বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিক সকলের হয়ে। সেই কারণেই বারবার চোয়াল শক্ত করা মুখটা ধরা পড়ছিল। ওই হুঙ্কারগুলোও নিশ্চয়ই যতটা না প্রতিপক্ষের জন্য, তার চেয়েও বেশি ব্রিজভূষণদের উদ্দেশে। রিয়ো অলিম্পিক্সে মারাত্মক চোট প্রায় কুস্তিজীবনই শেষ করে দিচ্ছিল তাঁর। কে ভেবেছিল, সেখান থেকে ফিরে এসে এমন সোনার অভিযানউপহার দেবেন?

ফোগত পরিবার মানেই কুস্তির পরিবার। বাবা রাজপাল ফোগত, দুই বোন গীতা ও ববিতা সকলে ভারতীয় কুস্তিতে উল্লেখযোগ্য নাম। ‘দঙ্গল’ সিনেমাটি তৈরি হয় ফোগত পরিবারকে নিয়েই। অথচ কুস্তির এত আলোকিত এক পরিবারের সব চেয়ে কৃতি মেয়ের উপরেই নেমে এল কত অন্যায়, অত্যাচার।

এক-এক সময় মনে হচ্ছে, কদর্য সেই গা-জোয়ারির প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় একটাই। যন্তর মন্তরের পাশে বিনেশ ফোগতের মূর্তি বসাও। শুধু প্যারিস কেন, ভারতের অলিম্পিক্স ইতিহাসে তাঁর চেয়ে রোমহর্ষক কাহিনি আর কারও নেই। আর সে তিনি সোনা জিতুন বা না জিতুন।

অন্য বিষয়গুলি:

Paris Olympics 2024 Vinesh Phogat Wrestler
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy