আজ হাসবেন কে? ইডেনে মুখোমুখি আফ্রিদি ও কোহালি। শুক্রবার উৎপল সরকারের তোলা ছবি।
এক একটা জায়গার খাবারে এক এক রকম বৈশিষ্ট্য। বিরিয়ানি যেমন। এক এক জায়গায় এক এক রকম। লাহৌরের বিরিয়ানি আলাদা। দিল্লিরটা আলাদা। ঢাকারটা আলাদা। আমার রেটিংয়ে কলকাতার বিরিয়ানি পাবে ভদ্রস্থ নম্বর। সেটা আবার আর এক রকম। আসলে ব্যক্তিগত ভাবে আমার একটু প়ঞ্জাবি স্টাইল খাবারদাবার পছন্দ। লাহৌরি স্টাইলটা আমি মনে করি এ ধরনের খাবারে এক নম্বর। কাছাকাছি যেতে পারে দিল্লি। মাছটাছ খুব একটা খাই না— সুশি বাদ দিয়ে। কাজেই ইন্ডিয়াতে এলে কলকাতা নয়, দিল্লির কুইজিনই আমার কাছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
কিন্তু আমায় যদি বেছে নিতে বলা হয়, উপমহাদেশে তোমার প্রিয় ক্রিকেট মাঠ কোনটা? আমি প্রথম নাম তুলব কলকাতা। দ্বিতীয় কোনও শহর নয়। ক্রিকেটবিশ্বে আমার সবচেয়ে পছন্দের মাঠ এমসিজি। যেমন তার দর্শক, তেমনই স্টেডিয়াম। এর সঙ্গে আমি জুড়তে চাই লর্ডস, সিডনি, গদ্দাফি এবং অবশ্যই ইডেন গার্ডেন্স!
বহু বছর আগে আপনাদের সংস্থার সেই সময়কার নিউজ ম্যাগাজিন ‘সানডে’-র ইন্টারভিউতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কলকাতাকে এক শব্দে ব্যাখ্যা করুন।
আমি দ্রুত উত্তর দিই— ক্যারেক্টার। কলকাতার একটা ক্যারেক্টার আছে। যা ঢের ঢের সম্পদশালী শহরের নেই। এই শহরটা ইতিহাসের শহর। প্রাচুর্য যেমন দেখেছে, তেমনই দেখেছে প্রচুর ঝড়ঝাপ্টা। ইতিহাসের এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা কলকাতা শহরের দর্শককে আমার সব সময়ই মনে হয়েছে খুব স্পোর্টিং। খুব ক্রিকেট সমঝদারও।
অথচ আমি কিন্তু কলকাতা ক্রাউডের খুব একটা সাপোর্ট পাইনি। আমি যে সময় খেলেছি, তখন পাকিস্তানের হয়ে ইন্ডিয়ায় এলে সমর্থনের কোনও ব্যাপারই ছিল না। এখন শুনছি বা টিভিতেও দেখছি ছবিটা একেবারে অন্য রকম। আমাদের আমলে পাকিস্তান এখানে কোনও সাপোর্টই পেত না। ইন্ডিয়াতে আমার জীবনের শেষ ম্যাচ ইডেনে। সেই নেহরু কাপ ফাইনালে ভিভের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আমরা হারাই।
কলকাতাকে আমি স্পোর্টিং এই কারণেই বলব যে, ওরা চাইছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতুক। গোটা ম্যাচ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সাপোর্ট করল। তার পর আমরা যখন ভাল খেলতে শুরু করে ম্যাচ ছিনিয়ে নিচ্ছি, তখন ওরা আমাদের সাপোর্ট শুরু করল। দারুণ লেগেছিল এটা দেখে যে, দিনের শেষে ওরা পাসপোর্ট বিচার না করে ভাল ক্রিকেটের ভক্ত।
দুঃখের কথা এই যে, ইডেনে আমি কখনও সে ভাবে ফিট হয়ে খেলার সুযোগ পাইনি। এই শহরটায় প্রথম খেলার অভিজ্ঞতা সেই ১৯৮০-তে। সিরিজের শেষ টেস্ট ছিল ওটা। আমি নব্বই শতাংশ ফিট থেকেও মৃত উইকেটে ভারতীয়দের সমস্যায় ফেলেছিলাম। বিশ্বনাথের মাথায় আমার একটা ডেলিভারি আছড়ে পড়েছিল। ভাবলে খারাপ লাগে, টেস্টটা আমরা জিতে শেষ করিনি। আনন্দবাজারের এক সাংবাদিক এ দিনও আমাকে দিল্লিতে বললেন, আসিফকে দেওয়া কলকাতার উদাত্ত ফেয়ারওয়েল আপনার মনে পড়ে?
আমি বললাম বিশেষ মনে পড়ে না। বরং মনে আসে আসিফের প্রতি তীব্র বিরক্তি যে, ও ম্যাচটা ভুলভাল সিদ্ধান্তে একা বরবাদ করে দিয়েছিল। জেতা ম্যাচ হঠাৎ ও ডিক্লেয়ার করে দিল ভারতের রানের থেকে পিছিয়ে থাকা অবস্থায়। প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকলে অনায়াসে ওদের আবার আউট করে দিতাম। সেটা তো করতে দিলই না, উল্টে নতুন বল যখন নিল, তখন পুরনো বলে আমি, আমরা দারুণ রিভার্স সুইং করাচ্ছি। জেতা ম্যাচটা স্রেফ ক্যাপ্টেন্সির ভুলে ড্র হয়ে গেল।
আমার জীবনে দেখেছি, ক্যাপ্টেন দু’ধরনের হয়। সাহসী অথবা ভিতু-ভিতু সাবধানী মার্কা। যে সাবধানী, সে সব সময় ভাবতে থাকে হারলে আমি গেলাম। আমার ক্যাপ্টেন্সি চলে গেল। সে সেফ হয়ে যায়। অথচ ভারত-পাক ম্যাচ এমন একটা মল্লযুদ্ধের আখড়া, যেখানে সেফ হতে চাইলে তুমি গেলে!
টি-টোয়েন্টিতে এমনিতেই হিটিং বা ফিল্ডিং ছাড়া টেকনিকের বিশেষ পরীক্ষা হয় না। আর ভারত-পাক ম্যাচে তো টেকনিকের চেয়ে টেম্পারামেন্ট আর সাহস বরাবর অনেক বেশি দামি। জো ডর গয়া, উয়ো মর গয়া।
আফ্রিদি আমায় ম্যাচের আগে ছেলেদের পেপটক দিতে বলেছে। আমি সাগ্রহে সেই কাজটা করতে চাই।
আমি পাকিস্তান টিমকে এটাই বলব যে, খেলায় হারজিত আছে। কিন্তু তোমাদের যা বোলিং লাইন-আপ তাতে ভয় পাবে কেন? যাও, চড়াও হও ওদের ওপর। প্রতি মুহূর্তে চাপ দিতে থাকো। জিতে বেরোও। মহম্মদ আমের তো ভারতকে জ্বালাবে নিশ্চয়ই। দুর্ধর্ষ বল করে আমের। ও যেন ওয়াইড বা নো নিয়ে না ভাবে। ওর কাছে আমি চাই উইকেট। ওর সঙ্গে ঢ্যাঙা ইরফানও যদি প্রচণ্ড উৎপাত শুরু করে আমি অবাক হব না। ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা অবশ্যই চালাবে। তাতে ঘাবড়ে গেলে চলবে না। ওয়াহাব রিয়াজের দিকেও আমি তাকিয়ে আছি। ওর একটা ভাল স্পেল অনেক কিছু বদলে দিতে পারে।
এমনিতে ম্যাচের আগে কুড়ি মিনিটের পেপটকে কী আর হয়? কারও স্কিল তো তাতে ভাল হবে না! যে খারাপ ফিল্ডার সে খারাপই থাকবে। কিন্তু যেটা হয় তা হল, ভাবনার দিকপরিবর্তন। আফ্রিদিকে আমি বলতে চাই, ওই টেস্টের আসিফের মতো ক্যাপ্টেন্সি কোরো না। যাও সাহসী হয়ে জয়ের জন্য অপেক্ষা করো। জীবনে বাজি জেতার জন্য ক্লান্তিহীন পরিশ্রম আর ঝুঁকি নিতে হয়। বিশ্রামের কোনও অবকাশই নেই। সমাধি চূড়ান্তই বিশ্রাম, সেখানে কেউ তো বিরক্ত করতে আসবে না। কিন্তু তার আগে, হে পাকিস্তান! পুরুষকার দেখাও!
কারও কারও মনে হচ্ছে ভারত খুব চাপে থাকবে। একে পাকিস্তান। তার ওপর এই ম্যাচটা ওদের কাছে নক আউটের মতো। হারলেই এক রকম বিদায়। কিন্তু আমার কথা হল, এটাই তো ধোনিইজমের জায়গা। ধোনিকে আমার লিডার হিসেবে অসম্ভব আকর্ষণীয় লাগে কারণ ছেলেটার মধ্যে ভয়ডর নেই। আর চাপের মুখে শান্ত থাকতে পারে। ইন্ডিয়া-পাক ক্রিকেটে নার্ভের ওপর এমন অত্যাচার চলে যে, চাপের মুখে শান্ত থাকতে পারাটা দারুণ গুণ।
ধোনির এটা আছে। কোহালিরও। ওরা দু’জন ইন্ডিয়ান টিমে একটা খুব ভাল কম্বিনেশন তৈরি করেছে। ইন্ডিয়ান ছেলেগুলো এমনিতেই আইপিএল খেলে খেলে আরও চাপ নেওয়াটা সিস্টেমে নিয়ে ফেলেছে। আমাদের দেশে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কার্যত বন্ধ করে দিতে হল, তখন ভারত চুটিয়ে আইপিএল খেলতে লাগল। আইপিএল মানে তো শুধু বিশ্বসেরাদের সঙ্গে গা শোঁকাশুঁকি নয়, নিয়মিত প্রেশারের মধ্যে পড়া। আইপিএল আগুন থেকে কোহালিরা যেন আরও শুদ্ধ হয়ে বেরিয়েছে। আর তাই ওরা গত সাত-আট বছর ধরে ইন্দো-পাকে এমন ধারাবাহিক জেতে।
ভিভ এক বার বলেছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান উইকেট পাওয়ার পর ম্যাকগ্রার উন্মাদনা দেখে ওর আবার ব্যাটটা হাতে তুলতে ইচ্ছে করে। আমার সেটা নিয়মিত ভাবে হয়নি। জানতাম যখন খেলা ছেড়েছি, আমার নতুন জীবন। কিন্তু বড় মঞ্চে পাকিস্তান বিপন্ন হচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে দেখলে রক্ত গরম হয়ে যায়। এখন ক্রিকেট থেকে এত দূর চলে গিয়েছি যে, অর্ধেক খেলা দেখাই হয় না। এই যে কলকাতা আসছি শনিবার দুপুরে, সেটা মোটামুটি ছুটির মেজাজে। ফিরে গিয়েই আবার আমার পরিচিত জীবন। কিন্তু আমিও এই ক্রিকেট সন্ন্যাসের মধ্যে ইন্দো-পাক ম্যাচ না দেখে পারি না। এখনও টিভিতে এই খেলাটা হলে রোম খাড়া হয়ে যায়।
কলকাতায় এখন সৌরভ যে প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়েই এই ম্যাচটা দারুণ ভাবে করছে তাতে আমি খুব খুশি। শুধু ভাল ক্যাপ্টেনই নয়, শিক্ষিত ছেলে। লোকে বলে টি-টোয়েন্টি হিটিংয়ের খেলা। যে বেশি মারবে সেই জিতবে— এর মধ্যে শিক্ষা কোথায়?
আমি একমত নই। ধারাবাহিক চলতে হলে শিক্ষাটা খুব জরুরি। বিশেষ করে খারাপ সময়ে একটা শিক্ষিত মন নিজের জন্য ঠিকঠাক মশাল জ্বালিয়ে দেয়— কোন পথে যাব। জীবনে তো প্রচুর হারও আছে। সেখান থেকে বেঁচে ফিরতে হলে শিক্ষিত মন খুব বড় সম্পদ। যে সব রাস্তার সন্ধান সে পায়, টিমের বাকিরা সব সময় পায় না। তাই সৌরভের ক্রিকেট প্রশাসনে আসা আমার কাছে একটা স্বাভাবিক উত্তরণ। হয়তো অনিবার্যই ছিল। খেলা ছাড়ার পর মোটা হয়ে আর টিভির সামনে বকবক না করে একটা নতুন চ্যালেঞ্জ মন্দ কী!
দিল্লিতে নেমে শুনলাম, সৌরভ নাকি ম্যাচের বাইরেও আরও একটা বড় ম্যাচের আয়োজন করেছে। যেখানে অনেকের সঙ্গে বহু বছর বাদে দেখা হবে। সচিন! শেষ দেখা বোধহয় যখন ও পাকিস্তানে এসেছিল। সে বার আমার ক্যানসার হাসপাতালেও ও গিয়েছিল। হোয়াট আ ক্রিকেটার! গ্রেট ইন্ডিয়ান, যে ভারতকে বিশ্ব দরবারে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে।
অমিতাভ জাতীয় সঙ্গীত গাইবে শুনলাম। ওর সঙ্গে সেই নাইনটিজের পর আর দেখা হয়নি। অমিতাভ এসেছিল লাহৌরে আমার হাসপাতালের জন্য ফান্ড তুলতে। সঙ্গে ছিল মিক জ্যাগার। ভাবতে পারেন কী অসামান্য স্টারকাস্ট! এখনকার অমিতাভ সম্পর্কে নেটেই যেটুকু খবর পাওয়া। প্রত্যক্ষ যোগাযোগ বহু বছর নেই। অমিতাভও কী অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। গ্রেট ইন্ডিয়ান স্টার। আমার জীবনটা রসকষহীন নন-ফিকশনের। ফিল্মের মতো ফিকশনের সেখানে কোনও স্থান নেই। অমিতাভের এখনকার ছবি কিছুই দেখিনি। ফিল্ম দেখাই হয় না। তবু এত বছর পর ওর সঙ্গে দেখা হলে দারুণ লাগবে।
আর আমার বন্ধুও থাকবে শুনলাম। ওকেও সংবর্ধনা দেওয়া হবে। যার প্রতি আমার দুর্বলতা যাওয়ার নয়। সুনীল গাওস্কর! লোকটা যখন ব্যাট করত, মুগ্ধ হয়ে ভাবতাম একেই কি কম্পিউটার ইন মোশন বলে? প্রত্যেকটা জিনিস ওর মাথায় থাকত। কোনটা ছাড়বে, কোনটা খেলবে! আমাদের যাবতীয় প্ল্যানিং হতো ওকে নিয়ে। অন্য টিমগুলোরও একই স্ট্র্যাটেজি থাকত— ‘এই মালটাকে ঘোড়া থেকে ফ্যাল, বাকি ইন্ডিয়া কোনও ব্যাপার না।’ কী ক্রিকেটটাই না খেলত! সুনীল, আমি ক্রিকেট থেকে এত দূরে চলে গিয়েও তোমাকে-ভিভকে ভুলতে পারিনি।
আমি জানি কোহালি দারুণ। হয়তো আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ওর রাজত্ব আরও বিস্তৃত হবে। কিন্তু আমার পুরনো সংগ্রামী শত্রুদের কিছুতেই ভুলতে পারি না। সে একটা সময় ছিল বটে।
নতুন সময়ের নতুন দিন শনিবার। অবশ্যই চাই পাকিস্তানের জয়। কিন্তু সবচেয়ে আগে চাই দুর্দান্ত ভয়ডরহীন ক্রিকেট! সে যে টিমই জিতুক!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy