রবার্ট লেয়নডস্কি। ফাইল ছবি
রোগা লিকলিকে শরীর। সরু সরু পা। হাঁটার ধরন অদ্ভুত। মাঠের মধ্যে ছেলেটিকে নড়াচড়া করতে দেখে রীতিমতো রেগে গিয়েছিলেন ড্যানিয়েল কোলোসিনস্কি। সরাসরি কোচকে গিয়ে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, “এটা কাকে ধরে এনেছেন? এর মধ্যে তো স্ট্রাইকার হওয়ার কোনও মশলাই নেই!” কোচের কাছে উত্তর ছিল না কোনও। তিনিও দ্বিধায় ছিলেন, ছেলেটিকে আর খেলাবেন কি না, তা নিয়ে। কিন্তু ক্লাবের প্রেসিডেন্ট বলে বসেন, “যদি ও ভাল খেলতে না পারে, তার দায় আমার। আমি নিজের পকেট থেকে টাকা দেব।” কয়েক বছর যেতে না যেতেই ভুল ভেঙে যায় ড্যানিয়েলের। বুঝতে পারেন, বড্ড আগে মন্তব্য করে ফেলেছিলেন ছেলেটার সম্পর্কে।
সেই ছেলেটিই আজকের রবার্ট লেয়নডস্কি। তাঁর নাম বললে প্রথমে একটাই শব্দ মনে আসে, ‘গোলমেশিন’। সেদিনের সেই হাড় জিরজিরে, রোগা ছেলেটাই আজ গোটা বিশ্বের ত্রাস। বক্সের মধ্যে যিনি সব থেকে ভয়ঙ্কর। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, লিয়োনেল মেসিদের সঙ্গে একসঙ্গে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। অখ্যাত দেশ থেকে উঠে আসা লেয়নডস্কি আজ গোটা পোলান্ডের স্বপ্ন। সোমবার স্লোভাকিয়া ম্যাচের আগে তাই তিনিই আলোচনার কেন্দ্রে।
শোনা যায়, তাঁর পরিবারের সঙ্গে নাকি যোগ রয়েছে নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলারের। জার্মানির এক বিশেষজ্ঞ একবার ইতিহাস উল্লেখ করে দাবি করেছিলেন, হিটলারের মেয়ে পলার নাতি লেওয়ানডস্কি। তবে সেই তথ্যের স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে তা খারিজ হয়ে যায়। লেয়নডস্কি নিজেও তা কোনওদিন স্বীকার করেননি।
খেলাধুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল পারিবারিক সূত্রেই। বাবা ক্রিস্টফ ছিলেন জাতীয় জুডো চ্যাম্পিয়ন। স্থানীয় ক্লাবের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন চুটিয়ে। মা খেলতেন ভলিবল। ছোট থেকেই ফুটবলের নেশা ছিল লেয়নডস্কির। বাবার হাত ধরেই ফুটবল খেলা শুরু। ২০০৫-এ যোগ দেন ডেল্টা ফুটবল ক্লাবে। কিন্তু স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাঁর শারীরিক গঠন। রোগাসোগা চেহারা দেখলেই কোচেরা নাক সিঁটকোতেন। তবু লেগিয়া ওয়ারশর দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাবে সুযোগ পান। কিন্তু মারাত্মক চোট পান এই সময়েই। লেগিয়া তাঁর চিকিৎসার খরচ বহন করতে চায়নি। কারণ, শুরু থেকেই লেয়নডস্কির সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ভাবনা ছিল তাদের। বাধ্য হয়ে জিঞ্জ প্রুসকোতে যোগ দেন। সেখানে ড্যানিয়েলের সঙ্গে মোলাকাত। প্রথম থেকেই লেয়নডস্কিকে ভাল লাগেনি ড্যানিয়েলের। পরে বন্ধু হয়ে যান। এক সাক্ষাৎকারে ড্যানিয়েল পরে বলেন, “জানতাম ও ভাল ফুটবলার হবে। কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হবে ভাবিনি। আজ যখন ও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল খেলে, তখন আমার বুকটা গর্বে ভরে যায়। সবাইকে বলি, ওর সঙ্গে আমি খেলেছি। অ্যালবামে এখনও রবার্টের সঙ্গে আমার ছবিগুলো রয়েছে। সেগুলো কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।”
হাতে বিকল্প না থাকায় প্রুসকোর সিনিয়র দলের একটি ম্যাচে লেয়নডস্কিকে নামিয়েছিলেন কোচ। ম্যাচটি প্রুসকো ১-৪ হারলেও, একমাত্র গোলটি ছিল লেয়নডস্কিরই। স্বপ্নের উড়ানের সেই শুরু। ধীরে ধীরে প্রথম দলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন। ২০০৮-এ তাঁকে তুলে নেয় পোলান্ডের অন্যতম সফল ক্লাব লেচ পোজনান। সেখান থেকে যোগ দেন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। বাকিটা ইতিহাস।
সেই সময় ডর্টমুন্ড দলের কোচ ছিলেন য়ুর্গেন ক্লপ। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তাঁর দেখা সেরা ফুটবলার লেয়নডস্কি। ক্লপের কথায়, “নিজেকে সেরা ফুটবলার বানানোর জন্য যে কঠোর পরিশ্রম ও করেছে, তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।” লেয়নডস্কির উন্নতির পিছনে সব থেকে বেশি অবদান যদি কারও থাকে, তা হলে তিনি স্ত্রী আনা। সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবল খেললেও লেয়নডস্কির শরীর বড় চেহারার ডিফেন্ডারদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ছিল না। পেশায় পুষ্টিবিদ আনা নিজে খাদ্যতালিকা তৈরি করেন। লেয়নডস্কির নির্দিষ্ট জীবনযাত্রা তৈরি করে দেন। এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফিট ফুটবলারের মধ্যে লেয়নডস্কি একজন। চোট-আঘাতের খবর শোনাই যায় না।
স্ট্রাইকার হওয়ার একটা অন্যতম গুণ হল, ভাল ‘পেরিফেরাল ভিশন’ থাকা। অর্থাৎ, ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়ে গোল বা সতীর্থ কোথায় আছে বুঝে নেওয়া। লেয়নডস্কির এই গুণটি খুব ভাল ভাবে রয়েছে। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলার সময় ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে একটি গোল করার পর তিনি বলেছিলেন, ভগ্নাশেরও কম সময়ে কী ভাবে গোলকিপারের নড়াচড়া বুঝতে পেরে অন্যদিকে শট নিয়েছিলেন।
নিখুঁত ‘নাম্বার নাইন’ বলে ফুটবলে যদি কিছু থাকে, তাহলে লেয়নডস্কি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রতি বছর নিয়ম করে ৪০-এর উপর গোল করেছেন। ইউরো কাপ খেলতে আসার ক’দিন আগে বুন্দেশলিগায় এক মরসুমে ৪০-এর বেশি গোল করে ভেঙে দিয়েছেন গার্ড মুলারের রেকর্ড। ২০১৫-এ উল্ফসবার্গের বিরুদ্ধে ৯ মিনিটে ৫ গোল করে গিনেস বুকে নাম তুলেছেন। ২০১৩-য় রোনাল্ডো, র্যামোস সমৃদ্ধ শক্তিশালী রিয়াল মাদ্রিদকে ৪-১ হারিয়েছিল ডর্টমুন্ড। চারটি গোলই ছিল লেয়নডস্কির। কেরিয়ারে তাঁর গোলের সংখ্যা ৫০০-রও বেশি।
ঝুড়ি ঝুড়ি গোল করেও তাঁকে দীর্ঘদিন থেকে যেতে হয়েছে মেসি, রোনাল্ডোর আড়ালে। প্রতি বছর ফুটবলের সেরা পুরস্কারগুলি উঠত এই দু’জনের হাতে। আর লেয়নডস্কি শুধু মনোনীত হয়েই খুশি থাকতেন। প্রথা ভাঙল গত বছর। ফিফার বর্ষসেরা পুরস্কার ‘দ্য বেস্ট’ পেলেন।
বয়সে রোনাল্ডো বা মেসির থেকে খুব একটা কম নয়। লেয়নডস্কি ভালই জানেন, ফুটবলের সময় ফুরিয়ে আসছে তাঁরও। এবারের ইউরোই হয়তো শেষ অভিযান হতে চলেছে, যে কারণে এই প্রতিযোগিতাকে স্মরণীয় করে রাখতে চান। নিজের সেরাটা দিতে তিনি যে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy