গোরান পান্ডেভ। ছবি রয়টার্স
অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে গোল করে দলকে এগিয়ে দেওয়ার পরেই দু’হাত তুলে লাল গ্যালারির দিকে ছুটে গিয়েছিলেন গোরান পান্ডেভ। গ্যালারির ওই অংশের লাল জার্সি পরে থাকা সমর্থকদের উচ্ছ্বাস তখন বাঁধনহারা। ইতিহাসের সঙ্গে নাম জুড়ে যাওয়া দেশের সমর্থকরা সোল্লাসে চিৎকার করে বলছিলেন, “দেখো ইউরোপ, আমরা এসে গিয়েছি।”
উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার এক কোণে ছোট্ট শহর স্ত্রুমিকা। তারই মাঝে এক স্টেডিয়ামের চারপাশ জুড়ে শুধুই পান্ডেভের ছবি। ড্রেসিংরুম জুড়েও তিনি। হবে না-ই বা কেন, গোটা স্ত্রুমিকা এবং উত্তর ম্যাসিডোনিয়া তো রীতিমতো ভগবানের মতো পুজো করে তাঁকে। তাঁদের আদর্শও তিনি, ভরসাও তিনি। স্ত্রুমিকার প্রতিটি বার এবং কাফেতে জেনোয়ার খেলা থাকলেই সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কারণ, ওই ক্লাবেই খেলেন পান্ডেভ।
স্ত্রুমিকা থেকে অনেক প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী উঠে এসেছেন। কিন্তু পান্ডেভ যেন স্ত্রুমিকাবাসীর হৃদয়ের অন্তঃস্থলে জায়গা করে নিয়েছেন। উত্তর ম্যাসিডোনিয়া থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফুটবলার উঠে এসেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে চুটিয়ে খেলেছেন। কিন্তু দেশ হিসেবে বরাবর তলানিতে পড়ে ছিল তারা। ছোট দেশটিকে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন পান্ডেভই।
উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার বেশিরভাগ ফুটবলারই উঠে এসেছেন রাজধানী স্কোপিয়া শহর থেকে। এই শহরেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মাদার টেরেজা, তখন যা ছিল অবিভক্ত যুগোশ্লাভিয়ার অংশ। নাপোলিতে খেলা এলজিফ এলমাস, লিসি-তে খেলা বোবান নিকোলোভ বা দেশের অন্যতম সেরা ফুটবলার ডার্কো পানসেভ, প্রত্যেকেই দেশে কোনও না কোনও কাফে বা বারের মালিক। একমাত্র ব্যতিক্রম পান্ডেভ।
স্ত্রুমিকাতে ফুটবল অ্যাকাডেমি তৈরি করেছেন তিনি, যেখানে এখন ৩০০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। গত এক দশক ধরে এই কাজ করে চলেছেন পান্ডেভ। গোটা দেশজুড়ে নিজের ফুটবল অ্যাকাডেমি ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে রয়েছে তাঁর। ক্লাবের খেলার ফাঁকে সময় পেলেই বিভিন্ন ফুটবল অ্যাকাডেমিতে ঘুরে যান। এই বছরের মধ্যেই স্ত্রুমিকার অ্যাকাডেমিতে একটি হোটেল, স্পা এবং মিউজিয়াম খোলার ভাবনাচিন্তা রয়েছে। ফিফাও এই কাজে যথেষ্ট সাহায্য করছে তাঁকে।
ইতালীয় ফুটবল যাঁরা দেখেন, তাঁদের কাছে পান্ডেভ পরিচিত মুখ। দীর্ঘদিন ইন্টার মিলানে খেলেছেন। ২০১০-এ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী দলে তিনি ছিলেন। ফাইনালেও দুরন্ত খেলেন। এ ছাড়াও নাপোলি, লাজিও-র মতো ক্লাবে খেলেছেন। এখন খেলেন জেনোয়াতে। ইন্টারের সেই দলের কোচ ছিলেন জোসে মোরিনহো। তাঁর অত্যন্ত পছন্দের ফুটবলার ছিলেন পান্ডেভ।
উত্তর ম্যাসিডোনিয়াকে প্রথম বার ইউরো কাপে তোলার জন্য পান্ডেভের পাশাপাশি আর একজনের নাম নিতেই হবে। তিনি ইগর অ্যাঞ্জেলোভস্কি। জাতীয় দলের হয়ে পরপর ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়ে ২০১৪-য় অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন পান্ডেভ। পরের বছর দায়িত্ব নিয়ে প্রথমেই ইগর অবসর ভেঙে ফিরিয়ে আনেন পান্ডেভকে। ২০১৬ নাগাদ ফিফার ক্রমতালিকায় উত্তর ম্যাসিডোনিয়া ছিল ভারতেরও নীচে, ১৬২ নম্বরে। পাঁচ বছরে তারা ঠিক ১০০ ধাপ উপরে এসেছে। এর পিছনে কৃতিত্ব অবশ্যই পান্ডেভ এবং ইগরের।
দীর্ঘদিন ধরেই ম্যাসিডোনিয়া বিধ্বস্ত জাতিবিদ্বেষ এবং গৃহযুদ্ধে। এই দেশের একটা বড় অংশ জন্মসূত্রে আলবেনিয়ার, যারা ম্যাসিডোনিয়াকে বিন্দুমাত্র সমর্থন করেন না। অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচে যে কারণে বিপক্ষের মার্কো আর্নতোভিচের বিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার আলবেনিয়া-জাত ডিফেন্ডার এগজান আলিয়োস্কি। এ ছাড়া, ঘরোয়া ফুটবলে সমর্থকদের মধ্যে খুনোখুনি লেগে আছেই।
গোটা দলকে একসূত্রে বাঁধা সহজ কাজ ছিল না। সেটাই করে দেখিয়েছেন ইগর এবং পান্ডেভ। জর্জিয়াকে হারিয়ে ইউরো কাপের যোগ্যতা অর্জন করে উত্তর ম্যাসিডোনিয়া। জয়সূচক গোল ছিল পান্ডেভের। তিনিই ইউরো কাপে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে গোল করেন। প্রথম সারির প্রতিযোগিতায় যা উত্তর ম্যাসিডোনিয়ার প্রথম গোল। এত বড় প্রতিযোগিতায় খেলতে পেরে গোটা দেশের বিভেদ যেন ঘুচে গিয়েছে। আর এত কিছু সম্ভব হয়েছে ওই একজনের জন্যেই। গোরান পান্ডেভ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy