জাঁতাকল: রবির সেই ‘লকড়বগ্ঘা’ প্যাচে ধরাশায়ী প্রতিপক্ষ। বুধবার টোকিয়োয়। পিটিআই
শিকারের অপেক্ষায় শত্রুকে নজরে রেখে পিছু পিছু আসতে থাকে হায়নাটি। শত্রু হয়তো তার থেকে শক্তিশালী, কিন্তু তাতে কী। হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে দাঁত বসিয়ে দেয় ওই হিংস্র প্রাণী। যে আক্রমণ থেকে নিস্তার পাওয়া কিন্তু খুব কঠিন।।
রবি কুমার দাহিয়ার থেকে অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রতিপক্ষ নুরিসলাম সানাইয়েভ। রবি একটা সময় পিছিয়ে ছিলেন ২-৯ পয়েন্টে। ওই মুহূর্তে সম্ভবত কেউ আশাই করেননি ওখান থেকে ফিরে আসতে পারেন হরিয়ানার ওই তরুণ। কিন্তু রবির আস্তিনে তখনও যে লুকোনো একটা তাস ছিল— ‘লকড়বগ্ঘা’।
হায়না যেমন করে তাঁর শিকারের পিছু নিয়ে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে আক্রমণ করে, সে ভাবেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন রবি। যে মুহূর্তে প্রতিপক্ষের গলা আটকে যায় রবির মারাত্মক জাঁতাকলে, লাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি। রবির প্রথম এবং সব চেয়ে প্রভাবশালী কোচ সতপাল সিংহ। ফোনে কথা বলার সময়ও উত্তেজনা কাটছিল না এই বর্ষীয়ান কোচের। বলছিলেন, ‘‘টিভিতে ম্যাচটা দেখছিলাম আমরা। ওই প্যাঁচটা দেখেই বুঝে যাই, শত্রু এ বার হার মানবে।’’ কেন এতটা আত্মবিশ্বাস ছিল? সতপালের জবাব, ‘‘ওটা যে ‘লকড়বগ্ঘা’ প্যাঁচ ছিল। ওই প্যাঁচের ফাঁদে আটকে গেলে বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন।’’ লকড়বগ্ঘা প্যাঁচ— অর্থাৎ, হায়নার কামড়।
সেই বছর দশেক বয়স থেকে সতপালের কাছে কুস্তিতে দীক্ষা নেওয়া শুরু রবির। প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দূরের, হরিয়ানার একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে উত্তর দিল্লির ছত্রশাল স্টেডিয়ামে এই কমনওয়েলথ এবং এশিয়ান গেমসের রুপোজয়ী কুস্তিগিরের কাছে শিখতে আসতেন খুদে রবি। নিজের হাতে অলিম্পিক্সের এই পদকজয়ীকে তৈরি করেছেন সতপাল। যে কারণে বিশ্বাস ছিল, পিছিয়ে থাকলেও ফিরে আসতে পারবেন রবি।
রবির কোচ বলছিলেন, ‘‘আপনারা বুঝবেন না, এই ভাবে পিছিয়ে থেকে ফিরে আসাটা কতটা কঠিন। তার চেয়েও বেশি কঠিন কাজ হল, প্রতিপক্ষকে মাটিতে চিৎ করে ফেলে দেওয়া। বেশির ভাগ সময় যেটা হয় না। কিন্তু রবির এই ক্ষমতাটা আছে। যেটা ওর মধ্যে তৈরি করেছি।’’
ছোটবেলায় কোচিং করানোর সময় কী রকম ছিল রবি? সতপাল বলছিলেন, ‘‘ছেলেটা খুবই শান্ত প্রকৃতির। যা বলা হত, সেটাই করত মুখ বুজে। কোনও দিন কোনও কিছুতে আপত্তি করেনি। যে ভাবে শিখিয়েছি, সে ভাবেই সব কিছু করেছে।’’
সতপালের হাতেই তৈরি হয়েছেন ভারতের কিংবদন্তি কুস্তিগির সুশীল কুমারও। বিতর্কবিদ্ধ যে সুশীল পরপর দুটো অলিম্পক্সে পদক জিতে ইতিহাস তৈরি করেছিলেন। এবং পরে সতপালের মেয়েকেই বিয়ে করেন। বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত, বর্ষীয়ান এই কোচ বলছিলেন, ‘‘রবি যখন আমার কাছে এসেছিল, তখন ওকে সুশীলের সঙ্গে ট্রেনিং করাই। কারণ জানতাম, সুশীলের মতো পালোয়ানের সঙ্গে ট্রেনিং করলে ওর দ্রুত উন্নতি হবে।’’
পিছিয়ে থেকেও যে ভাবে রবি এ দিন ফিরে এসেছেন, তা দেখে কিন্তু অবাক হচ্ছেন না সতপাল। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি তো গত চার মাস ধরে ছেলেটাকে ওই ভাবেই তৈরি করেছিলাম। চাপ নিয়ে কী ভাবে লড়তে হবে। পিছিয়ে থেকে কী ভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল
করতে হবে।’’
রবির দুটো জিনিস সতপালের খুব পছন্দের ছিল। এক, পরিশ্রম করার ক্ষমতা। দুই, কখনও নিজেকে লুকিয়ে না রাখা। ‘‘আমার মনে পড়ছে না, একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছি আর রবি বাকিদের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ও সব সময় সামনে এগিয়ে আসত,’’ বলছিলেন কোচ।
এই যে ‘‘লকড়বগ্ঘা’’ প্যাঁচে অলিম্পিক্সে পদক জয় নিশ্চিত হল, সেটাও কি আপনার আখড়ায় শিখেছেন রবি? সতপালের জবাব, ‘‘অবশ্যই। এটা একটা ভারতীয় প্যাঁচ। আমার মনে হয় না বিদেশিরা এটা জানে বলে। এটা ভারতীয় রণনীতি। আমরা মহড়ায় এই প্যাচের অনুশীলন অনেক বারই করেছি। তাই জানতাম, ওই প্যাঁচটা ঠিকমত দিতে পারলে রবিই জিতবে। আর সেটাই হল।’’ রবি জিতলেও তাঁর হাতে কামড়ে দেন প্রতিপক্ষ সানাইয়েভ। যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। পরে জানা যায়, রবি ঠিকই আছেন। কোনও সমস্যা হয়নি।
সুশীল কুমারের আবির্ভাবের পরে ভারতীয় কুস্তির ছবিটা ধীরে ধীরে বদলাতে থাকে। সতপাল মনে করেন, ভারতীয় কুস্তিগিরদের দেখে এখন ভয় পান বিদেশিরাও। বলছেন, ‘‘একটা সময় ভারতীয়রা বিদেশি কুস্তিগিরদের দেখে চাপে থাকত। কিন্তু এখন আর থাকে না। এখন উল্টোটা ঘটে।’’
এর পরেই সতপাল বলে উঠলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার সোনা জিতুক রবি। তার পরে কথা হবে। এখন সোনার প্রার্থনাই করে যাচ্ছি। আশা করছি ছেলে সোনা নিয়েই দেশে ফিরবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy