কিংবদন্তি: ক্রিকেটেও জেতাতে পারতেন অলরাউন্ডার। ফাইল চিত্র
আগে যখন বিদেশি দল ভারতে আসত, ওরা প্রস্তুতি ম্যাচ খেলত। রঞ্জি ট্রফি জয়ী দলের সঙ্গে বা আঞ্চলিক দলের সঙ্গে খেলা দেওয়া হত তাদের। ১৯৬৬-তে যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ এল, ওরা বিশ্বের এক নম্বর দল। আর ভারতের সব চেয়ে দুই দুর্বল আঞ্চলিক টিম হল মধ্যাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল। তাই আমাদের ক্রিকেট বোর্ড সিদ্ধান্ত নিল, দু’টো আঞ্চলিক টিমকে এক করে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে খেলার জন্য যৌথ একাদশ গড়া হবে।
হনুমন্ত সিংহ ছিল আমাদের ক্যাপ্টেন। সব মিলিয়ে সম্ভবত ছ’জন ছিলাম পূর্বাঞ্চল থেকে। আমি (অতীতে বিহারের অধিনায়ক), রমেশ সাক্সেনা, অম্বর রায়, সুব্রত গুহ,দেবু মুখোপাধ্যায় ও তরুণ চুনী গোস্বামী। যাকে তত দিনে সকলে চিনে গিয়েছে দেশের সর্বকালের অন্যতম সেরা এক ফুটবলার হিসেবে। যখন ইনদওরে পৌঁছলাম, দেখলাম ইংরেজি সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়েছে ‘উইকেস্ট অপোজিশন টু ফেস মাইটি ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ (মহাশক্তিধর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সামনে দুর্বলতম প্রতিপক্ষ)।
ইনদওরে পৌঁছে দেখলাম সবুজে ভরে গিয়েছে বাইশ গজ। এখনও মনে আছে, তখন বড়দিন ও নিউ ইয়ারের আবহ। কলকাতায় দারুণ নিউ ইয়ার পার্টি হত। সেই কারণে নতুন বছরের সময়টা ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিম সব সময় কলকাতায় কাটাতে চাইত। সেই ক্যারিবিয়ান টিমে সবই তো ছিল পার্টি-ওস্তাদ। রাতভর নাচগান, পান করায় ডুবে থাকত। আর পরের দিন মাঠে এসে এমন পারফর্ম করত যে, কে বলবে, সারা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে এসেছে। গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই, ক্লাইভ লয়েড, ডেরেক মারে, ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ— দুনিয়া কাঁপানো সব নাম ছিল সেই ক্যারিবিয়ান দলে। সোবার্স আর কনরাড হান্ট প্রস্তুতি ম্যাচটা খেলেনি।
আরও পড়ুন: প্রয়াত চুনী, স্তব্ধ ভাইচুংরা
ইনদওরে খুব ম্যাড়ম্যাড়ে হোটেলে থাকা নিয়ে খুব অভিযোগ করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারেরা। বার বার বলছিল, এটা আবার কী ধরনের হোটেল! কোনও নিউ ইয়ার পার্টি নেই, হুল্লোড় নেই!’’ কয়েক জনকে সকালে ‘গুড মর্নিং’ বলেও জবাব বা প্রতিক্রিয়া পাইনি। ওরা ওয়েস হল, চার্লি গ্রিফিথ আর লেস্টার কিং— তিন জন সেরা পেসারকে খেলিয়ে দিল। আর আমাদের সম্বল সুব্রত গুহ। তার সঙ্গে সহায়তা দেওয়ার জন্য দুই স্পিনার মহম্মদ সিদ্দিকি আর চাঁদু জোশী। আর তেমন কোনও মিডিয়াম পেসারও ছিল না। আমাদের অধিনায়ক হনুমন্ত সিংহ স্টেট ব্যাঙ্কে খেলার দিন থেকে চুনীকে চিনত। বেশি জোর না থাকলেও ওর হাতে যে ভাল ইনসুইং আছে, সেটা জানত হনুমন্ত। মাঝেমধ্যে লেগকাটারও দিতে পারত। টসে জিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথমে ব্যাট করল। মাঠ ভর্তি দর্শক। কিন্তু সুব্রত আর চুনীর বল এমনই সুইং করতে শুরু করল যে, ক্যারিবিয়ান মহারথীরাও ব্যাকফুটে। ১৩৬ রানেই প্রথম ইনিংস শেষ হয়ে গেল ওদের। চুনীর প্রথম দু’তিনটে বল খেলার পরে রোহন কানহাইয়ের মতো ব্যাটসম্যান পর্যন্ত বলে উঠেছিল, ‘‘কী ভয়ঙ্কর সুইং করছে রে বাবা। খেলাই তো যাচ্ছে না।’’ আম্পায়ারের কাছে নতুন করে গার্ডও চাইল কানহাই।
উইকেটকিপার হিসেবে আমি চুনীর বলে সামনে এসে দাঁড়াতাম। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, চুনীর মিডিয়াম পেস সুইং ও সিম বোলিংয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে বিশ্বসেরা দলের সব ব্যাটসম্যানেরা। কানহাই মাত্র ৪ রান করতে পেরেছিল। চুনীই ওকে তুলল। গালিতে ক্যাচ উঠল। ১৩৬ রানে শেষ প্রতিপক্ষ! সুব্রত নিল চার উইকেট, চুনী ৪৭ রানে পাঁচ উইকেট।
আমাদের ব্যাটিংয়ের সময়েও রুখে দাঁড়াল সুব্রত আর চুনীর জুটি। ৪৪ রান যোগ করেছিল ওরা। চুনী পাঁচ উইকেট নেওয়ার পরে ২৫ রানও করল। আমাদের ২৮৩-৯ স্কোরে ডিক্লেয়ার করে দিল হনুমন্ত। ১৪৭ রানে এগিয়ে গেলাম আমরা। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাট করতে এসে ফের সুব্রত-চুনীর সুইংয়ের সামনে ধরাশায়ী। শেষের দিকে হল আর লেস্টার কিং মিলে এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে রান তুলতে থাকল। এ বার দেখলাম ফিল্ডার চুনীর কামাল। সুব্রত গুহের বল স্ক্যোয়ার লেগের দিকে তুলে মেরেছিল ওয়েস হল। মিড-অন থেকে স্প্রিন্ট টানা শুরু করে চুনী। খুব উঁচু হয়েছিল বলটা। কাছাকাছি পৌঁছে এক হাত বাড়িয়ে অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতা আর অনুমান ক্ষমতায় ক্যাচ লুফে নিল চুনী। সুব্রত নিল সাত উইকেট, চুনীর ঝুলিতে তিন শিকার। ১০৩ রানে ওদের শেষ করে দিয়ে আমরা ম্যাচ জিতলাম ইনিংস ও ৪৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এত রেগে গিয়েছিল সেই হারের অপমানে যে, পরের টেস্টে ইনিংসে হারাল ভারতকে। কোনও ভারতীয় ব্যাটসম্যান ৪০ রান পেরোয়নি।
কিন্তু সে যাই প্রতিশোধ নিক ওরা, সারা জীবনের মতো ভারতীয় ক্রিকেটের রূপকথায় ঢুকে থাকল সুব্রত-চুনীর অসাধারণ পারফরম্যান্স এবং আমাদের অভাবনীয় জয়। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদের হারিয়ে আমরা খুব পার্টি করেছিলাম, এটাও মনে আছে। আরও একটা কথা মনে পড়ছে। চুনী মাঠের মধ্যে নিজেকে নিজে উদ্বুদ্ধ করত। বলত ‘কাম অন চুনী, তুমি এটা পারবে। তুমি চ্যাম্পিয়ন।’’ খালি মাথায় হল, গ্রিফিথদের মতো ফাস্ট বোলারদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়াত এ ভাবে নিজেকে চাগিয়ে। দুর্দান্ত ফুটবলার, সীমিত দক্ষতা নিয়েও নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া ক্রিকেটার।
এমন ‘অলরাউন্ডার’ ভারতীয় খেলাধুলোর ইতিহাসে সত্যিই বিরল!
(লেখক প্রাক্তন ক্রিকেটার। পূর্বাঞ্চলীয় দলে চুনী গোস্বামীর সঙ্গে খেলেছেন। পরে মোহালিতে দীর্ঘদিন কিউরেটরের ভূমিকা পালন করেছেন।)
আরও পড়ুন: জিতলাম আমরা, নায়ক তবু তিনিই
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy