গোলাপি বল সামলাতে ব্যর্থ বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।
গোলাপি বলে কি সত্যিই ‘জুজু’ রয়েছে? এই বলে কি একটু বেশিই সুবিধা পাচ্ছেন ইশান্ত-উমেশ-শামিরা? না কি স্রেফ দক্ষতার অভাবেই ইডেন গার্ডেন্সে এ ভাবে বিপর্যস্ত হতে হচ্ছে বাংলাদেশকে?
প্রথম দিনের পিচে মাত্র ৩০ ওভারে গোটা বাংলাদেশের গুটিয়ে যাওয়া, একাধিক বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানের গায়ে-মাথায় লাগা দেখে যখন অনেকের মনে এই প্রশ্নটা উঁকি মারতে শুরু করেছে গোলাপি বলই কি আসল নায়ক? ঠিক তখনই ব্যাট করতে নামে ভারত। ‘গোলাপি জুজু’কে মাঠের বাইরে ফেলে স্বচ্ছন্দে ব্যাট করে গেলেন কোহালি-পূজারা-রাহানেরা। ঝকঝকে সেঞ্চুরি করলেন ভারত অধিনায়ক বিরাট। হাফ সেঞ্চুরি করলেন পূজারা-রাহানে।
কোহালিদের সমস্যায় ফেলতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ফের বাংলাদেশের সামনে বাঘ হয়ে দাঁড়ায় গোলাপি বল। পর পর চার উইকেট হারিয়ে যখন ধুঁকছে বাংলাদেশে, ঠিক তখনই লড়াইটা বিপক্ষ শিবিরে পাঠিয়ে দিলেন একা মুশফিকুর রহিম। লড়াকু হাফ সেঞ্চুরি তো করলেনই, পাশাপাশি যেন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, টেকনিক ঠিক থাকলে আদৌ তেমন সমস্যায় ফেলে না গোলাপি বল। ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরাও মোটামুটি একমত এই মতের সঙ্গেই।
বাংলার রনজি জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা শুরুতেই কেঁপে যায়। লিটন দাস আর নইম হাসান মাথায় আঘাত খেল। লেগ স্টাম্পের দিকে ওরা খালি সরে যাচ্ছিল। ভাল বলে তো আউটই হয়েছে। অত্যন্ত সাধারণ মানের ডেলিভারিতেও আউট হয়েছে। ক্রিকেটের বেসিক ভুলে গিয়েছিল ওরা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এটা ভাবাই যায় না।’’
দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয়েছিল ভারতীয় পেসারদের ‘দৌরাত্ম্য’। মাত্র ৩০ ওভারে ভেঙে পড়ে বাংলাদেশ। মোমিনুলদের আয়ারাম-গয়ারাম ব্যাটিং দেখে বিস্মিত অনেকেই। বাংলার রনজি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক লক্ষ্মীরতন শুক্ল দায়ী করছেন বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের মানসিকতাকে। তিনি বলেন, ‘‘একটা আন্তর্জাতিক দল ৩০ ওভারে শেষ হয়ে যাচ্ছে প্রথম ইনিংসে। তাতেই তো বোঝা যাচ্ছে ওদের ফোকাসটাই ছিল না। দ্বিতীয় ইনিংসে তো প্রথম ইনিংসের থেকে বেশি রান করল।’’
আরও পড়ুন: গোলাপি বল ও দিন-রাতের টেস্ট
সত্যিই কি ফোকাস হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ? নাকি গোলাপি বলে ইশান্ত-শামি-উমেশের আগুনে ডেলিভারিতে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল প্রতিবেশী দেশ? সে দেশের ব্যাটসম্যানদের মনে আতঙ্ক তৈরি করে দেন দুরন্ত ছন্দে থাকা মহম্মদ শামি। তাঁর বল আছড়ে পড়ে লিটন ও নইমের হেলমেটে। শামির কোচ বদরুদ্দিন সিদিক্কি বলছেন, ‘‘লাল বলের থেকে গোলাপি বলে সুইং অনেক বেশি হয়। আজকাল সুইং বল খেলায় দুর্বলতা রয়েছে ব্যাটসম্যানদের। ১৪০-১৪৫ কিমি বেগে ধেয়ে আসা বল মুভ করলে ব্যাটসম্যানের কাজ খুবই কঠিন হয়ে যায়। একটা কথা বলতেই হবে। এই ভারতীয় বোলাররা যে কোনও দেশের ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেলে দেবে। সেই সঙ্গে আরেকটা কথাও বলব, ভারতীয় বোলারদের সামলানোর মতো দক্ষতা নেই বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের। দু-একজন অবশ্য ব্যতিক্রম।’’
পরিস্থিতি রীতিমতো হাতের বাইরে চলে যাওয়া অবস্থায় মুশফিকুর দ্বিতীয় ইনিংসে একা লড়ে গেলেন। তাঁর আগে বিরাট কোহালি শতরান করে ইডেন মাতান। লক্ষ্মীরতন বলছেন, ‘‘টেকনিক, স্কিলই আসল ক্রিকেটে। গোলাপি বল সামলে কোহালি কী ভাবে তা হলে শতরান পেল?’’ প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন বাংলার প্রাক্তন অধিনায়ক।
অতীতে স্পিনাররাই ভারতকে সাফল্য এনে দিতেন। রসিকতার ছলে আগে বলা হত, বলের পালিশ তোলার জন্যই পেসারদের ব্যবহার করে ভারত। বলের পালিশ উঠে গেলে স্পিনারদের কাজ শুরু হত। কপিল দেব আসার পর এই রসিকতা বন্ধ হয়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি তার থেকেও বদলে গিয়েছে। ভারতীয় পেস-আক্রমণেই বিধ্বস্ত হচ্ছে প্রতিপক্ষ। গোলাপি বলে সেই শমি-ইশান্তরাই আগুন ঝরাচ্ছেন। শামির কোচ বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, এটা মানতে হবে যে বোলারদের কাজটা সহজ করে দিয়েছে গোলাপি বল। বলটা বেশিক্ষণ চকচকে থাকে বলে মুভমেন্টও বেশি সময় ধরে হয়। লাল বল পুরনো হলে রিভার্স সুইং পায় বোলাররা। রিভার্স সুইং করানোর দিকেই বোলাররা নজর দিত। গোলাপি বলে রিভার্স সুইং কম হয়। কারণ বলের পালিশ সহজে চটে না।’’ অর্থাৎ, বদরুদ্দিনের মতে, বল বেশি ক্ষণ নতুন থাকায় শামিদের আরও ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ইতিহাসের ইডেন গার্ডেন্স
গোলাপি বলে শামি-ইশান্তদের বোলিং দেখে রোহিত শর্মার কোচ দীনেশ লাড বলছেন, ‘‘গোলাপি বলের মুভমেন্ট অনেক বেশি। বল স্কিডও করছে।বলের পালিশ বেশিক্ষণ থাকে বলেই বল স্কিড করে।’’
একই বলে খেলছে দু’ দল। ভারতের বোলাররা বাইশ গজে আগুন ঝরাচ্ছেন। আল আমিন-আবু জায়েদরা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের বেগ দিতে পারলেন না কেন? বাংলাদেশের বোলিংয়ে রক্তাল্পতা চোখে পড়ছে দীনেশ লাডের। তিনি বলছেন, ‘‘বাংলাদেশ ভাঙা দল নিয়ে খেলতে এসেছে। ওদের দলে কোয়ালিটি পেসারই তো নেই। তা ছাড়া বিরাট কোহালির মতো বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানকে সমস্যায় ফেলতে হলে, বিশ্বমানের বোলারই দরকার। ভারতের বোলারদের মতো দক্ষতা নেই বাংলাদেশের এই বোলারদের।’’
ইডেন টেস্ট শুরুর আগে কোহালির কাছে উড়ে এসেছিল প্রশ্ন, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দিন-রাতের টেস্ট খেলবেন আপনারা? ভারত অধিনায়ক জবাব দেন, ‘‘গোলাপি বলে দিন-রাতের টেস্ট আমরা অস্ট্রেলিয়াতেও খেলতে চাই। তবে তার আগে প্রস্তুতি ম্যাচ দিতে হবে।’’ গোলাপি বলের জন্য পুরোদস্তুর প্রস্তুত হয়ে তবেই মাঠে নামতে চান কোহালি। লক্ষ্মীরতনও বলছেন, ‘‘গোলাপি বলের চরিত্র বোঝার জন্য ভাল করে প্রস্তুতি নিয়ে নামতে হবে। অবশ্য যে কোনও পরীক্ষায় নামতে হলে তো প্রস্তুতি আগে থেকেই নিতে হয়।’’
সেই প্রস্তুতিটাই ভাল করে নেয়নি বাংলাদেশ। এ নিয়ে বলতেও শুরু করেছেন বাংলাদেশের সমর্থকরা। অনেকেরই মতে, প্রস্তুতির অভাবেই পদ্মাপাড়ের ক্রিকেটের এমন চরম ভরাডুবি ইডেনে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy