মায়াবি: রাতের আলোয় টেস্ট ক্রিকেট। ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী ইডেন। নিজস্ব চিত্র
গোলাপি স্রোতে ভেসে যাওয়া ইডেন। ঐতিহাসিক ইডেন! মায়াবী ইডেন! হাউসফুল ইডেন। আবেগের ইডেন!
মহাযজ্ঞের আয়োজক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নীল ব্লেজ়ারের পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে গোলাপি টাই। সচিন তেন্ডুলকরের গায়েও নীল ব্লেজ়ার, কিন্তু ভিতরে পরেছেন গোলাপি জামা। ভিভিএস লক্ষ্মণের টাইয়ে গোলাপি আভা। ক্লাবহাউসের ভিতরে অন্য দুই ক্রিকেটারকে দেখা গেল, যাঁরা নিজেরাই ইতিহাস সৃষ্টিকারী। প্রথম বিশ্বকাপ উপহার দেওয়া কপিল দেব এবং ইডেনে ২০০১-এর সেই বিখ্যাত অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে হ্যাটট্রিককারী হরভজন সিংহ। দু’জনেরই গায়ে গোলাপি ব্লেজ়ার। হরভজন যে-সঞ্চালিকার সঙ্গে টিভি শো করতে চললেন, তিনি রজার বিনির পুত্র স্টুয়ার্টের স্ত্রী মায়ান্তী। তাঁর গায়েও গোলাপি পোশাক। এমনকি টিভির স্কোরে পর্যন্ত গোলাপি আভা।
স্কোরবোর্ডে সারা ক্ষণ জ্বলজ্বল করছে গোলাপি। আর ক্লাবহাউস থেকে শুরু করে গ্যালারির সর্বত্র দর্শকদের গায়েও গোলাপি। যেন ইডেন গার্ডেন্সের নাম পাল্টে কেউ করে দিয়েছে ‘পিঙ্ক গার্ডেন্স’। আর সেই থিয়েটারে বাইশ গজে দাঁড়িয়ে খেলা এক চ্যাম্পিয়নের একটি শট।
যখন নানা রহস্য নিয়ে হাজির হওয়া গোলাপি গোলকটি বশ মানল। যখন এবাদত হোসেনকে হাঁটু মুড়ে বসে কভার ড্রাইভ মারলেন বিরাট কোহালি আর ইডেনের সবুজ গালিচার উপর দিয়ে তা শিশির ভেদ করে ছুটল বাউন্ডারি দড়ির দিকে। স্বয়ং বোলার পর্যন্ত বিস্ময়, সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধায় হাততালি দিয়ে উঠলেন। রাতের ইডেনে বসে বারবার মনে হচ্ছিল, বশ্যতা শুধু বোলারই মানলেন না। ওই শট আসলে গোলাপি বলকেও বশ করে নিয়ে বলে দিল, ঠিক আছে। আমরা পারব। ক্রিকেট পারবে। টেস্ট হতেই পারে দিনরাতের আলোয়। তা ফিল হিউজকে কেড়ে নেওয়া বল তোমার রং যা-ই হোক না কেন! একটি স্ট্রেট ড্রাইভের কথাও মনে থাকবে গোলাপি ইডেনের।
শাসন: ধ্রুপদী ক্রিকেটে মন ভরালেন কোহালি। ছবি: সুদীপ্ত ভোমিক
ক্লাবহাউসের ভিতরে তখন সত্যিই চাঁদের হাট। একই বক্সে বসে খেলা দেখছেন ‘ফ্যাভ ফাইভ’। সচিন, রাহুল, লক্ষ্মণ, কুম্বলে এবং তাঁদের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ। এই মহাযজ্ঞ যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত। মাঠে বসে পুরনো স্মৃতি উস্কে দেওয়া অনুষ্ঠানও করলেন সচিন, কুম্বলে, হরভজনেরা। কিন্তু কোহালির ব্যাটিংয়ের সময় খেলায় ডুবে থাকতে দেখা গেল তাঁদেরও। চার দিকে আরও কত সব মহাতারকা। পিভি সিন্ধু, সানিয়া মির্জা, গোপীচন্দ, মিতালি রাজ, ঝুলন গোস্বামী। নতুনকে বরণ করতে এসেছেন সকলে। খেলা শুরুর আগে অভাবনীয় এক মুহূর্ত তৈরি হল।
দু’দেশেরই জাতীয় সঙ্গীত রবীন্দ্রনাথের লেখা। উপস্থিত দু’পারের বাঙালিদের কাছে কী অসম্ভব গায়ে কাঁটা দেওয়া এক সন্ধিক্ষণ! আর ইডেনে না-বেজেও সারা ক্ষণ যেন বেজে গেল রবি ঠাকুরের সেই বিখ্যাত গান— নব আনন্দে জাগো!
নতুন আনন্দে জাগানোর মূল কারিগর দু’জন। মাঠের বাইরে প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ। মাঠের মধ্যে বর্তমান ভারত অধিনায়ক। মাঠের বাইরে পরীক্ষা ছিল টেস্টের মঞ্চে লোক ফেরানোর। সৌরভ ভরা গ্যালারিতে গোলাপি তরঙ্গ তুললেন। আর মাঠের মধ্যে চ্যালেঞ্জ ছিল গোলাপি বলের ভূত তাড়ানো। যেটা বিরাটের ব্যাটের শাসনে ঘটল।
বোর্ড প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসার প্রথম রাতেই আরব সাগরের পারে বসে সৌরভ আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘এত বড় খেলোয়াড় বিরাট। ও খেলবে আর মাঠ খালি পড়ে থাকবে, এটা হতেই পারে না। আমাদের নতুন কিছু ভাবতে হবে।’’ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি নতুন ভাবনা হিসেবে দিনরাতের টেস্টকে আলোচনায় নিয়ে আসেন। এত দিন রাজি না-হওয়া কোহালিকে মানিয়ে নেন। প্রেসিডেন্ট সৌরভের পক্ষ থেকে এ যুগের মহাতারকা কোহালিকে প্রথম উপহার— হাউসফুল ইডেন।
ভারতের মাটিতে প্রথম গোলাপি বল টেস্টের উদ্বোধনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। শুক্রবার ইডেনে । ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
সেই উপহার যেন আরও তাতিয়ে তুলল কোহালিকে। এমনিতেই মাঠে তাঁর ব্যাট হাতে প্রবেশভঙ্গি ক্রিকেটে ভিভ রিচার্ডস এবং ক্রিকেটের বাইরে একমাত্র জেমস বন্ডের সঙ্গে তুলনীয়। এ দিন নিজস্ব সেই দুঃসাহসিক ভঙ্গিতেই যেন আশ্বস্ত করে গেলেন গোটা পৃথিবীকে যে, টেস্ট ক্রিকেট থাকবে। গোলাপি বলের রহস্য মিটিয়েই এগোবে দিনরাতের টেস্ট। বাংলাদেশের মতো দুর্বল দল হলে গোলাপি বলেও এর পর টেস্ট দেখতে লোকে আসবে কি না, সন্দেহ থেকেই যায়। এ দিন ১০৬ রানে অলআউট দেখে মুশফিকুরদের দেশের এক ভক্ত যেমন লিখে ফেললেন, ‘‘অনেক হইসে। এ বার গোলাপি বাস ধইরা চইলা আসো।’’
কিন্তু এটাই যদি হয় ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া? কোহালি বনাম স্মিথ? এ রকম হাউসফুল থাকারই তো সম্ভাবনা। এ রকম টিকিটের হাহাকারই হওয়ার কথা। কারা যেন বলেছিল, গোলাপি বল শুরুতে এমন সুইং করে যে, খেলাই যাবে না। এর আগে এগারোটি দিনরাতের টেস্টে বেশির ভাগ যে-কারণে কম স্কোরের খেলা হয়েছে। গোধূলি লগ্নে বল দেখাই যাবে না। উঁচু ক্যাচ ধরতে গেলে বল হারিয়ে যাচ্ছে। আরও কত কী! নানা অশনি সঙ্কেতের মধ্যে শুরু হয়েছিল গোলাপি বলের উৎক্ষেপণ পর্ব।
বাংলাদেশের ইনিংস যেন উদ্বেগ আর আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। দু’জনের মাথায় লাগল মহম্মদ শামির বল। মাথায় আঘাতজনিত নিয়মের জন্য এই টেস্ট থেকেই ছিটকে গেলেন তাঁরা আর পরিবর্ত নামাতে হল। কারও কারও মনে পড়ে যাচ্ছিল সিডনির সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা। যে-দিন মাথায় আঘাত লেগে মৃত্যু ঘটে ফিল হিউজের আর স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল ক্রিকেটই।
সেই কঠিন সময়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেছিল ভারত। কোহালি ক্রিজে আসতেই প্রথম বল বাউন্সার দিয়ে স্বাগত জানান বাঁ-হাতি মিচেল জনসন। ঘটাং করে গিয়ে লাগল হেলমেটে। স্বয়ং জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার গোটা দলের মনে হিউজের টাটকা স্মৃতি ফিরে এল। পুরো মাঠ ফের স্তব্ধ। আর দুঃসাহসিক ভঙ্গিতে কোহালি উঠে দাঁড়িয়ে জনসনকে হাত নেড়ে চলে যেতে বললেন। ফের শুরু হল খেলা এবং জনসনকে পিটিয়ে দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরি করে শুধু দলকেই বাঁচাননি কোহালি, টেনে তোলেন ক্রিকেটকেও।
অ্যাডিলেডে সে-দিন বাউন্সার নামক দস্যুকে তাড়িয়েছিলেন। যা হিউজকে কেড়ে নিয়ে গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায় ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। এ দিন ইডেনে গোলাপি বলের ভূত তাড়ালেন। কভার ড্রাইভ আর স্ট্রেট ড্রাইভ বলে দিল, নৈপুণ্যই জিতবে। তা সে-দিনের বেলায় হোক কি নৈশালোকে, কি গোধূলিতে! আশ্বস্ত করে গেল, উৎকর্ষ শুধু সাময়িক থমকে দাঁড়াতে পারে কিন্তু হারবে না অজানার কাছে। তা সে বলের রং যা-ই হোক না কেন। কোহালির খেলা দেখতে দেখতে জোহানেসবার্গে দিনের আলোয় বসে মনে হয়, ডায়াগন অ্যালির অলিভ্যান্ডার্সে তাঁর ব্যাট তৈরি হয়। যেখান থেকে হ্যারি-পটার তাঁর জাদুদণ্ড কেনেন। ইডেনে রাতের আলোতেও সে-রকমই ব্যাট হাতে জাদুকরের মতো দেখাল তাঁকে।
ইডেনের এই গোলাপি স্রোতে দাঁড়িয়ে অবশ্য পুরনো এক টি-শার্টের কথা মনে পড়ে যাবে। ‘বিগ বয়েজ় প্লে অ্যাট নাইট’ বুকে লিখে কেরি প্যাকার সিরিজে খেলতে নামা ইমরান খান। দিনরাতের ম্যাচ আয়োজন করে ক্রিকেট বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন প্যাকার। তাঁর সেই অভিনবত্বের ছোঁয়ায় রঙিন পোশাক, নৈশালোক, সাদা বল চলে আসে ওয়ান ডে ক্রিকেটে। না-হলে কপিল দেব যখন তিরাশিতে বিশ্বকাপ নিচ্ছেন লর্ডসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, তখনও তাঁর গায়ে সাদা পোশাক। বলবিন্দর সিংহ সাঁধু গ্রিনিজকে বোল্ড করেন লাল বলে।
প্যাকারের মতোই সৌরভের হাত ধরে ভারতের মাটিতে বিবর্তনের দিকে পা বাড়াল টেস্ট ক্রিকেট। গোলাপি বল নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলবে, তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে পুরনো কিছু তথ্য। যেমন টেস্ট একটা সময়ে খেলা হত অনন্ত সময় ধরে। ডন ব্র্যাডম্যানের ৫২টি টেস্টের মধ্যে অর্ধেক ছিল ‘টাইমলেস টেস্ট’। স্যর ডন এক দিনে ট্রিপল সেঞ্চুরি করার ক্ষমতা ধরতেন, সেটা অন্য কথা। ওভালের লেন হাটনের সেই বিখ্যাত ৩৬৪ এসেছিল অনন্ত কালের টেস্টে। তিনি খেলেছিলেন ৮৪৭টি বল। ভুল লেখা হয়নি। ৮৪৭-ই। ১৯৩৯ সালে ডারবানে ইংল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট চলেছিল দশ দিন ধরে। এর পরে তা থামিয়ে দিতে হয়। কারণ ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারদের জাহাজ ধরে বাড়ি ফিরতে হত। আরও আছে। এখন ছয় বলে ওভার হয় ক্রিকেটে। কিন্তু অতীতে কখনও চার বলে, কখনও পাঁচ বলে, কখনও আট বলে ওভার হয়েছে। দ্বিতীয় নতুন বল? এখন ক্যাপ্টেনরা ৮০ ওভার পরে নিতে পারেন। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন ৫৫ ওভারের পরে দ্বিতীয় নতুন বল নেওয়া যেত। যদি দেখা যায়, গোলাপি বল সত্যিই তাড়াতাড়ি পুরনো হচ্ছে, তা হলে পুরনো নিয়মে ফিরে গেলে কী অসুবিধা?
প্রশ্ন থাকবে। সংশয় থাকবে। তার মধ্যেই চলবে ক্রিকেট বিবর্তন। শুক্রবারের ইডেনে মনে করিয়ে দিয়ে গেল সৌরভের মস্তিষ্ক ও বিরাট ব্যাট!
অস্ট্রেলিয়া, কবে আসছ ইডেনে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy