Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Priyam Garg

মায়ের মৃত্যু, তীব্র অনটন, দেশের অনূর্ধ্ব ১৯ ক্যাপ্টেন যেন জীবনকে হারিয়ে দেওয়া ক্রিকেটার

ছেলে প্রিয়মকে ব্যাট হাতে প্রতিষ্ঠিত করতে নেপথ্যে লড়ে গিয়েছেন বাবা নরেশ। কখনও দুধ বিক্রি করেছেন। কখনও ট্রাকে মাল তুলেছেন। চালিয়েছেন স্কুল ভ্যানও। যে কোনও ভাবে সংসার টানতেই হত তাঁকে।

অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছেন প্রিয়ম গর্গ। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।

অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে এসেছেন প্রিয়ম গর্গ। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১৫:২২
Share: Save:

জীবন কখনও কখনও বড্ড নিষ্ঠুর। কেড়ে নেয় প্রিয়জনকে। সামনে রেখে দেয় একটার পর একটা সমস্যা। কিন্তু প্রতিকূলতার সেই সব হার্ডলস যদি একবার টপকানো যায়, তখন আবার সেই জীবনকেই মধুর লাগে। তবে এর জন্য লাগে কঠোর পরিশ্রম আর অদম্য জেদ। এক সপ্তাহও হয়নি, উনিশে পা দেওয়া প্রিয়ম গর্গের এখন হয়তো তেমনই লাগছে!

একা প্রিয়মই কেন, পুরো গর্গ পরিবারই তো পেরিয়ে এসেছে কাঁটা বিছানো পথ। রক্তাক্ত হতে হতেও ছেলের স্বপ্ন ভাঙতে দেননি বাবা নরেশ। পাঁচ সন্তানের সবচেয়ে ছোট প্রিয়মকে এগিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্যপূরণের পথে। মায়ের মৃত্যু, সংসারে আর্থিক সমস্যা, কোনও কিছু নিয়ে ভাবতে দেননি ছেলেকে। আর তাই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ছেলের ক্যাপ্টেন হওয়ার খবরে চিকচিক করে ওঠে তাঁর চোখের কোণ। আনন্দেও যে জল আসে চোখে!

গলি থেকে রাজপথ। প্রিয়মের উঠে আসার কাহিনি যেন একেবারে তাই। উত্তরপ্রদেশের মেরঠের কাছে ছোট শহর পরীক্ষিৎগড়। বাবা-মা আর পাঁচ ভাইবোনের সংসার। মায়ের মৃত্যু মারাত্মক ট্র্যাজেডি বয়ে এনেছিল সংসারে। অসহ্য পেটের যন্ত্রণা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নানা পরীক্ষা, অজস্র টেস্ট। কিন্তু যন্ত্রণা কমেনি। ২০১২ সালের ১১ মার্চ, প্রিয়মের জীবন থেকে মুছে গেলেন মা। আনন্দবাজার ডিজিটালকে বাবা নরেশ বললেন, “আচমকাই আমাদের জীবনে যেন অন্ধকার নেমে এল। সব কিছু করেও বাঁচানো যায়নি ওদের মাকে। এখনও জানি না ঠিক কী হয়েছিল। প্রিয়মের খেলাতেও তখন সমস্যা হচ্ছিল। একসময় বলল, আমি আর খেলব না। আমি বলেছিলাম, তোকে কোনও কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না। শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাক। বাড়ির কী সমস্যা, কোথায় কী কাজ, মাথায় রাখবি না একদম। কোনও টেনশন নিবি না। পিছনে ফিরে তাকাবি না। স্রেফ খেলে যা।”

আরও পড়ুন: ‘টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে পাওয়ারপ্লে-তে বল করা চ্যালেঞ্জের, সেই কারণেই উপভোগ করি’​

আরও পড়ুন: ভারত এগিয়ে, কম নই আমরাও বলছেন পোলার্ড​

প্রিয়ম তাই করেছেন। সেটা সহজ ছিল না একেবারেই। মেরঠে প্রবীণ কুমার, ভুবনেশ্বর কুমারদের কোচ সঞ্জয় রাস্তোগির কোচিংয়ে প্রথম দিন এসেছিলেন মামার সঙ্গে। বাড়ি থেকে ২০ কিমি দূরে কোচিং। তাই ব্রেকে বাড়ি ফেরা সম্ভব ছিল না। সকালবেলায় পৌঁছে দিয়ে যেতেন বাবা। সন্ধেবেলায় তিনিই সব কাজ সেরে ছেলেকে নিতে আসতেন। কখনও কখনও দিনভর জুটত চারটে মাত্র পরোটা। খিদে কী জিনিস, কষ্ট কী জিনিস, তার উপলব্ধি ওই ছোটবেলাতেই হয়ে গিয়েছিল। সে সব সঙ্গী করেই চলত নেটে ঘাম ঝরানো। প্র্যাকটিসের পরে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে যে একটু বিশ্রাম নেবে, সে উপায়ও ছিল না। বাসে চাপার টাকাই থাকত না যে! ফলে ঘণ্টা ছয়েকের প্র্যাকটিসের পর ক্লান্ত শরীরে থাকতে হত বাবার প্রতীক্ষায়। দেশের সেরা প্রতিশ্রুতিমানদের মধ্যে চিহ্নিত হওয়া, রাহুল দ্রাবিড়ের নজরে পড়া এবং এখন দেশের ক্যাপ্টেন হওয়া সবই সেই সাধনারই স্বীকৃতি।

রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে প্রিয়ম গর্গ। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।

ছেলেকে ব্যাট হাতে প্রতিষ্ঠিত করতে নেপথ্যে লড়ে গিয়েছেন নরেশ। কখনও দুধ বিক্রি করেছেন। কখনও ট্রাকে মাল তুলেছেন। চালিয়েছেন স্কুল ভ্যানও। যে কোনও ভাবে সংসার টানতেই হত তাঁকে। সাত সন্তানের মুখে জোগাতে হত অন্ন। পড়াশোনাও চালানোর ব্যবস্থাও করতে হত। আর ছিল প্রিয়মের ‘সচিন তেন্ডুলকর’ হয়ে ওঠার স্বপ্ন। স্বপ্নের সেই চারাগাছে জল দিতে হয়েছে। না হলে অকালেই শুকিয়ে যেত তা। আগামীর তারকা হারিয়ে যেত অকালে।

যেখানেই ট্রায়াল হোক না কেন, সব সময় ছেলের সঙ্গী থাকতেন নরেশ। কানপুরেই হোক বা অন্য কোথাও, ছেলেকে একা ছাড়তেন না। মুহূর্তে ফেলে আসা অতীতে ফিরে গেলেন বাবা, বললেন, “দুঃখের কথা আর কী বলব! জীবনে অনেক কিছু করতে হয়েছে। অনেক কঠিন সময় পার হতে হয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বড় করতে হয়েছে। কোনও না কোনও সমস্যা লেগেই থাকত। সাত সন্তানের মধ্যে প্রিয়ম সবচেয়ে চোট। কানপুরেই হোক বা অন্য কোথাও ট্রায়ালে আমিই নিয়ে যেতাম প্রিয়মকে। একা ছাড়তাম না।”

প্রথমে পেসার হওয়ার ইচ্ছা ছিল প্রিয়মের। কী ভাবে ব্যাটসম্যান হয়ে উঠলেন তিনি? ছোটবেলার কোচ সঞ্জয় রাস্তোগি শোনালেন সেই গল্প, “ছোটবেলায় বাচ্চাদের যেমন কোনও কিছুই ঠিকঠাক জানা থাকে না, সবেতেই আগ্রহ থাকে, প্রিয়মেরও ছিল। প্রথমে এসে বল করেছিল। তার পর ব্যাটিংয়ে আগ্রহ বাড়ল। শরীরের গড়নও ব্যাটসম্যানের মতো ছিল। আস্তে আস্তে ভিতর থেকে ব্যাটিং জোরদার হল। দু’বছরের খাটাখাটনির পর ও উত্তরপ্রদেশের অনূর্ধ্ব-১৪ দলে চলে এল।”

আরও পড়ুন: ‘অতীতকে ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না’, গাওস্করের সুরেই আক্রমণাত্মক কারসন ঘাউড়ি​

ডেডিকেশন আর ডিসিপ্লিন। এই দুই মন্ত্রেই কোচের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন ছোট্ট প্রিয়ম। দায়িত্ব নেওয়ার সহজাত গুণও চোখে পড়েছিল শুরু থেকে। কোচের কথায়, “দেখুন, ও সারাদিন পড়ে থাকত এখানে। পরিশ্রম করত। পড়াশোনাতেও খুব ভাল ছিল। একবার জিজ্ঞাসা করলাম পড়াশোনার ব্যাপারে। তা ও ৩৭-এর নামতা শুনিয়ে দিল। আমি তো অবাক। এটা তো কেউ পড়েই না। যা বলতে চাইছি তা হল, ওর মধ্যে আলাদা কিছু একটা ছিল। ক্রিকেটে যেমন সেটা হল লম্বা খেলার ক্ষমতা। খুব কম বাচ্চারই এটা থাকে। সব পর্যায়েই শুরুতে ডাবল সেঞ্চুরি করেছে। অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট, অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট, সর্বত্র। একটা নয়, দুটো করে ডাবল সেঞ্চুরি। রঞ্জি ট্রফিতে প্রথম বছরেই ডাবল সেঞ্চুরি।”

কোথায় বাকিদের থেকে আলাদা প্রিয়ম? কোচের বিশ্লেষণ, “ক্রিকেটারদের মধ্যে এমনিতে স্কিলের তফাত বেশি থাকে না। তফাত হয়ে যায় ভাবনাচিন্তায়। ১২ বছর বয়সে কেউ যদি ২০ বছর বয়সির মতো ভাবতে পারে, তা হলে সেটাই ফারাক গড়ে দেয়। সময়ের চেয়ে এগিয়ে ভাবা, এটাই আসল। শুধু ভাবা নয়, করে দেখানোটাও জরুরি। প্রিয়ম দায়িত্ব নিতে পারে। ম্যাচ শেষ করে ফিরতে হবে, এই চ্যালেঞ্জে মজা পায় ও। ম্যাচ ফিনিশ করতে হবে, এটা ওর মধ্যেই রয়েছে। যা খুব কম বাচ্চার মধ্যেই থাকে এটা।”

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১৬ ইনিংসে ৬৬.৬৯ গড়ে ৮৬৭ রান করেছেন প্রিয়ম। ছবি টুইটার থেকে নেওয়া।

প্রবীণ কুমার আর ভুবনেশ্বর কুমারের উৎসাহও সঙ্গী হয়েছিল প্রিয়মের। নেটে দুই পেসারের বিরুদ্ধে ব্যাট হাতে নেমে পড়তেন তিনি, মাত্র ১৫ বছর বয়সেই! সঞ্জয় রাস্তোগি শোনালেন তা, “প্রবীণ-ভুবিরা ওকে খুব মোটিভেট করেছে। ওরা মাঠে এসে প্রিয়মকে ডাকত, চল ব্যাট করবি। আমরা বল করছি। তারকাদের কেউ এটা বললে বাচ্চা ছেলেরা মারাত্মক উদ্দীপ্ত হয়। ওরা বলত, প্রিয়ম তুই খুব ভাল ব্যাট করছিস। আমি পরে বলতাম, তোর কেমন লাগল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাঁদের বল নিয়ে চর্চা হয়, তাঁদের বিরুদ্ধে খেলে। তা ও কিন্তু ভয় পেত না। মারার বল মারত। নিজের খেলাই খেলত। আর আমার শিক্ষা এটাই যে, বোলার দেখো না, বল দেখো। বল যেমন, তেমনই খেলো। বোলার যে-ই হোক, আলগা বল হলে সমীহ করবে না। বোলারের মুখ দেখার দরকার নেই।”

ডানহাতির ব্যাটিংয়ে রয়েছে ‘আদর্শ’ সচিনের ছোঁয়া। বিশেষ করে ব্যাকফুট পাঞ্চে। অন্তত কোচের তেমনই বিশ্বাস। তবে তাঁর ক্রিকেট কেরিয়ারের সঙ্গে মুম্বইকর নন, জড়িয়ে আছেন রাহল দ্রাবিড়। উত্তরপ্রদেশ গত বছর রঞ্জি ট্রফির আগে কর্নাটকে এক প্রতিযোগিতায় খেলতে গিয়েছিল। সেখানে এক ছোট ছেলে খুব মারছে শুনে দ্রাবিড় চলে এসেছিলেন দেখতে। সেখানে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিল প্রিয়ম। দ্রাবিড় তা দেখে উৎসাহ দেন। বলেন, পরিশ্রম করে যাও, ফল পাবে। ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সদর দফতরে বিশ্বকাপের এই দল বেছে নেওয়ার বৈঠকে আমন্ত্রিত ছিলেন দ্রাবিড়। সেখানেই প্রিয়মকে বেছে নেওয়া হয় অধিনায়ক হিসেবে। বাবার কথায়, “ছোট ছেলেদের ঠিক যে ভাবে গাইড করা উচিত, দ্রাবিড় তেমনটাই করেছেন। বুঝিয়েছেন যে, ধৈর্য যেন না হারায়, যেন ভালবেসে খেলতে থাকে।”

আরও পড়ুন: ‘ক্লাইভ লয়েড বা গ্রেগ চ্যাপেলদের সেই টেস্ট দলের সঙ্গে এক আসনে রাখতে হবে বিরাটদের’

বাড়িতে টিভি ছিল না। লুকিয়ে লুকিয়ে পাড়ার ক্লাবে বা কোথাও চলে গিয়ে সচিনের খেলা দেখতেন প্রিয়ম। রপ্ত করতেন খেলার স্টাইল। কোচ বললেন, “যে কোনও কিছু দ্রুত শেখার ক্ষমতা রয়েছে প্রিয়মের। এটা ওর দুর্দান্ত গুণ। ও কুইক লার্নার। দেখুন, পারিবারিক নানা সমস্যায় ভুগতে হয়েছে। সেই কষ্টটাকে ও শক্তি বানিয়ে নিয়েছে। আমি ওকে বলতাম, জীবনে নিজের উইকনেসকেই স্ট্রেংথ বানিয়ে ফেলতে হয়। কখনও কখনও হতাশ হয়ে পড়ত। তখন এটাই বলতাম যে, ভেঙে পড়বে না কখনও। ও কিন্তু হাজার সমস্যাতেও ভেঙে পড়েনি। প্রবীণ-ভুবিদেরও বলতাম, জীবনে সবকিছু মনের মতো হয় না। সেটা জীবনেরই অঙ্গ। তা নিয়েই এগোতে হয়। প্রিয়ম এটা বুঝেছে বলেই ১২-১৩ বছর বয়সেই লম্বা ইনিংস খেলতে শুরু করে দেয়, দায়িত্ব নিতে শিখে যায়।”

দায়িত্ব নেওয়া বাবার থেকেও শিখেছেন প্রিয়ম। ছেলের কোনও খেলা যিনি দেখতে পেতেন না। প্র্যাকটিস বা ম্যাচ বা ট্রায়াল, ছেলেকে নিয়ে গিয়েও মাথায় ভিড় করে আসত দুশ্চিন্তা। কী করে চালাবেন সংসার, সেই উদ্বেগ ছেলের ব্যাটিংয়ে মন বসাতে দিত না। আর তাই প্রিয়মের ব্যাটিং না দেখাই হয়ে উঠেছে অভ্যাস। কেন, নিজেই বললেন বাবা, “ভিক্টোরিয়া পার্ক বা অন্য কোথাও ম্যাচ থাকলে সঞ্জয় (রাস্তোগি) সাব ডাকতেন। আমি ম্যাচ শেষ হওয়ার পর যেতাম। আসলে খেলা দেখতে বসলেই টেনশন হতো সংসারের কথা ভেবে। তাই ঠিক করলাম যে ওর ম্যাচ থাকলে মাঠে যাব না, ঘরেই থাকব।” ছেলের বিশ্বকাপের ম্যাচ অবশ্য ঘরে বসেই দেখতে পাবেন তিনি। মাঠে যেতে হবে না। বাড়িতে যে এখন টিভিও এসেছে।

জীবন কতটা বদলেছে? বাবার গলায় উপচে পড়ল খুশি, “অনেক লড়াই করেছি। এখনও করে চলেছি। জীবনটা তো কষ্টেই কাটল! এখন যদিও সেই দিন আর নেই। তবে কখনও ভাবিনি প্রিয়ম এই জায়গায় পৌঁছবে। দেশের ক্যাপ্টেন হবে। কতটা খুশি, তাই বোঝাতে পারব না। বুকের ভিতরটা তো আর দেখানো সম্ভব নয়।”

জীবন যেমন কেড়ে নেয়, কিছু ফিরিয়েও দেয়। লড়াকু মন সঙ্গী হলে একসময় জয় আসবেই। প্রিয়ম গর্গ যেন নিছক ক্রিকেটার নন, এক রূপকথার নামও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy