হতাশ: শেষ আটে হার দীপিকার। চার নম্বর অলিম্পিক্স থেকেও খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে তাঁকে। ছবি: পিটিআই।
অঙ্কিতা ভকতদের পরে দীপিকা কুমারী। আশা তৈরি করেও ফের শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে ভারতীয় তিরন্দাজি দলকে।
অঙ্কিতারা মিক্সড ইভেন্টে সেমিফাইনালে পৌঁছে ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে হেরে যান আমেরিকার কাছে। দীপিকা ব্যক্তিগত ইভেন্টে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে দারুণ শুরু করেছিলেন। মনে হয়েছিল, এই অলিম্পিক্সের অন্যতম সেরা অঘটন ঘটাতে চলেছেন তিনি। কিন্তু তিরন্দাজির পুরনো রোগ তাড়া করল এ দিনও। কয়েকটা দশের চাঁদমারির পরে এমন কয়েকটা কম স্কোর করলেন দীপিকা যে, সব আশা ওখানেই শেষ হয়ে গেল। তত ক্ষণে মেয়েদের ব্যক্তিগত ইভেন্টে হেরে গিয়েছেন ভজন কউর।
ইনভ্যালিড্স বা ফরাসি ভাষায় অঁভ্যালিডস অন্যতম সেরা দর্শনীয় স্থান প্যারিসের। নেপোলিয়নের কবর এখানে। ফ্রান্সের সামরিক বাহিনী এবং সৈনিকদের নানা স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। জাদুঘর আছে। বয়স্ক, আহত সৈন্যদের জন্য এখানে বানানো হয়েছিল হাসপাতাল, আবাসন। কাছেই স্যেন নদী। হাঁটা পথে আইফেল টাওয়ার। স্যেন নদীবক্ষে ক্রুজ় পৃথিবী বিখ্যাত। মাত্র আধ ঘণ্টায় দু’পারে দাঁড়িয়ে থাকা নানা ঐতিহাসিক মিনার দেখে নেওয়া সম্ভব। শনিবার বলে নদীর ক্রুজ়ে তো বটেই, পুরো এলাকা জুড়েই যেন আরও ভিড়। দেখা গেল, তিরন্দাজি নিয়ে আগ্রহ দারুণ। গ্যালারি হাউসফুল। যাঁরা ভিতরে ঢুকতে পারেননি, বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখছেন। এমন দর্শনীয়, ঐতিহাসিক নদীর পারে, নেপোলিয়নের কবরের পাশেই আপাতত সমাধিস্থ থাকল ২০২৪ অলিম্পিক্সে ভারতের তিরন্দাজি অভিযান।
গতকাল অঙ্কিতা ভকতের কাঁদো কাঁদো চোখমুখ দেখা গিয়েছিল মিক্সড জ়োনে। এ দিন সেখানে একই রকম বিষণ্ণতা সঙ্গী হল দীপিকার। চার-চারটি অলিম্পিক্স হয়ে গেল তাঁর। একটিও পদক নেই। পরিসংখ্যান কখনওই হয়তো বলবে না, কত কাছে তিনি এসে পড়েছিলেন। কয়েকটা তির যদি ঠিক মারতে পারতেন, তা হলে এমনকি অপ্রতিরোধ্য কোরিয়াকে পর্যন্ত হারানোর মতো ইতিহাস গড়ে ফেলতে পারতেন। জার্মানির মিশেল ক্রোপেনকে তিনি হারান প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে। ক্রোপেন গত কালই মিক্সড ইভেন্টে রুপোজয়ী জার্মানি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাঁকে হারানোটা নিঃসন্দেহে কৃতিত্বের। রুপোজয়ীর বিরুদ্ধে ৬-৪ জিতে দীপিকা যখন কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছলেন, কেউ ভাবেননি আর এগোবেন। প্রতিপক্ষ যে দক্ষিণ কোরিয়ার নাম সুইহিয়োন। উনিশ বছরের হলেও তবু তো কোরিয়ার। বিশেষ করে, তাদের মেয়েদের আধিপত্য বিশ্বের খেলাধুলোর ইতিহাসে কার্যত নজিরবিহীন। ১৯৮৮-তে তিরন্দাজির টিম ইভেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মেয়েরা আজ পর্যন্ত সব সোনা জিতেছে। ১৯৮৪-তে চালু হয় ব্যক্তিগত ইভেন্ট। একবার ছাড়া কোরিয়ার মেয়েরা প্রত্যেক বার সোনাজয়ী। কোরীয় পুরুষদের দাপট তুলনামূলক ভাবে কম। ব্যক্তিগত ইভেন্টে দু’টি সোনা রয়েছে। তবে টিম ইভেন্ট জিতেছে সাতটি। তাদের মেয়েরা একচ্ছত্র ভাবে তির-ধনুক হাতে রাজ করে যাচ্ছে। প্যারিস অলিম্পিক্সেও শুধুই তাঁদের জয়জয়কার।
দীপিকা শনিবার সেই বিরল কীর্তির দরজা প্রায় খুলে ফেলেছিলেন। কোরীয় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার সুযোগ ছিল। তার পরে নিজেই ঠাস করে নিজের মুখের উপরে সদর দুয়ার বন্ধ করে দিলেন। সুইহিয়ন নামের বিরুদ্ধে প্রথম সেট ২৮-২৬ জিতে ২-০ এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ইনভ্যালিড্সের তিরন্দাজি স্টেডিয়ামে তখন কী আবহ! প্রচুর ভারতীয় সমর্থক এসেছিলেন। সম্ভবত জায়গাটা জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট বলেই অনেকে স্যেন নদী বা আইফেল টাওয়ার ঘুরতে এসে দীপিকাদের ম্যাচও দেখে গেলেন। ঘন ঘন গ্যালারি থেকে ‘ভারত মাতা কী জয়’ ধ্বনি উঠছিল। চেঁচিয়ে অনেকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ‘কাম অন দীপিকা’। বাংলার বধূ দারুণ শুরু করেছেন দেখে দর্শকদের চিৎকার আরও বেড়ে গেল।
কিন্তু এত ভাল একটা শুরু করার পরেই ঝুপ করে একটা বাজে তির বেরোল তাঁর ধনুক থেকে। মাত্র ছয় স্কোর করলেন। দ্বিতীয় সেট হারার পরে তবু তিনি ফিরে এসেছিলেন তৃতীয় সেটে। ২৯-২৮ জিতে এগিয়ে যান ৪-২। পরের সেটে আবার সেই এক রোগ তাড়া করল। দু’টো দশ স্কোরের পর একটা সাত মারলেন। সেই সুযোগ নিয়ে ম্যাচে ফিরলেন কোরিয়ার মেয়ে। পরের সেটে আর কোনও ভুলচুক করেননি নাম। দু’টো সাত স্কোরই শেষ করে দিয়ে গেল দীপিকার স্বপ্ন। কোরিয়ার খারাপ শট মানে দশের জায়গায় হয়তো নয় স্কোর হবে। খুব খারাপ হলে আট। কিন্তু ভারতের খারাপ স্কোর মানে সাত, ছয়। এতটা কম স্কোর হলে পরে যতই দশ মারো, মেরামত করা কঠিন। বারবার এই রোগ দীপিকাদের তাড়া করল প্যারিসে। টিম ও মিক্সড ইভেন্টেও অবিশ্বাস্য এমন কয়েকটি অল্প স্কোরই তাঁদের অভিযান শেষ করে দেয়।
‘‘আমি নিজের দোষেই হেরে গেলাম। খুব খারাপ কয়েকটা স্কোর হল। সেটাই সব শেষ করে দিল,’’ ম্যাচের পরে মিক্সড জ়োনে দাঁড়িয়ে যখন বলছিলেন ভারতীয় তিরন্দাজির সেরা মুখ, মনে হল আর এক জন ক্রীড়াবিদের নাম বোধ হয় খোদাই হয়ে থাকল ট্র্যাজিক চরিত্রদের তালিকায়। যাঁরা সব কিছু উজাড় করে দিয়েছেন, সব পেয়েছেন কিন্তু সেরা প্রাপ্তি মুখ ঘুরিয়েই থেকেছে। বহু কিংবদন্তি যেমন ফুটবল বা ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতেননি, তেমনই তাঁরও অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে দাঁড়ানো হল না। অথচ তিরন্দাজির বিশ্বকাপ জিতেছেন। র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বসেরা হয়েছেন। ফরাসি সেনাদের জন্য বানানো বিশেষ জায়গাতেই কি তাঁর যুদ্ধ থেমে গেল? তিরিশ বছর বয়স তাঁর। আর কি কখনও অলিম্পিক্সে ফিরতে পারবেন? দীপিকা অবশ্য বলে গেলেন, খেলা চালিয়ে যেতে চান। টিম ইভেন্টে ব্যর্থ হওয়ার পরে সমাজমাধ্যমে এত মারাত্মক ভাবে ট্রোল্ড হয়েছেন। কী ভাবে সে সব সামলাচ্ছেন? দীপিকা বললেন, ‘‘খেলার সময় ও সব মাথায় থাকে না। তখন শুধু লক্ষ্য দেখি আর তির ছুড়ি।’’ আবহাওয়া রং পাল্টাচ্ছিল বারবার। কখনও রোদ, কখনও মেঘলা। কখনও হাওয়া দিল বেশ জোরে, যা তিরন্দাজদের সব চেয়ে বড় শত্রু। দীপিকা কিন্তু কোনও অজুহাতের রাস্তায় গেলেন না। সব কষ্ট, যন্ত্রণা ভিতরে নিয়েও বারবার বলে গেলেন, আমি পারিনি।
তিরন্দাজিতে কোরিয়ার একচ্ছত্র রাজ নিয়ে নানা গল্প আছে। কেউ বলে ‘কিমচি আঙুল’ প্রধান কারণ। চপস্টিক খাওয়ার জন্য যে আঙুল তৈরি হয়ে যায়। খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ৬৬৮-তে নাকি গোগুরইয়ো বলে কোরিয়ার একটি জায়গায় এক রাজা ছিলেন। তিনি নাকি খুব ভাল তির-ধনুক চালাতেন। সেখান থেকে এই পরম্পরা চালু হয়েছে, এমন গল্পও বাজারে ছড়িয়েছে। কিন্তু এ সব নয়, আসল কথা হচ্ছে কোরিয়ার বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং এবং আপসহীন নির্বাচনী প্রক্রিয়া। কোনও স্বজনপোষণের ব্যাপার নেই। পরিবেশ অনুযায়ী তির ছোড়ার সময় কী ভাবে অবস্থানের পরিবর্তন করব। কখন হাত তুলব। কখন তির ছুড়ব। সব কিছু বায়োমেকানিক্যাল প্রক্রিয়া মেনে শেখানো হয় তাঁদের।
দীপিকা যাঁর কাছে হারলেন তিনি সোনা জিততে পারেননি। তার মানে এই নয় যে, কোরিয়া হার মেনেছে। যিনি সোনা জিতলেন, তিনিও কোরিয়ার। লিম সিহিয়ন। এই নিয়ে চলতি অলিম্পিক্সে তৃতীয় সোনা। দীপিকাকে হারানো নাম সুহহিয়ন জিতলেন রুপো। ব্রোঞ্জটাও তারা নিয়ে যেতে পারত। প্রবল জনসমর্থনের মধ্যে ফ্রান্সের লিজ়া বারবেলিন কোরীয় প্রতিপক্ষকে হারিয়ে বাকি বিশ্বের হয়ে মুখ রক্ষা করলেন। না হলে পোডিয়ামে তিন জনের তিন জনই দাঁড়াত কোরিয়ার। আর ভারত? এক কোরীয় কোচকে আনা হয়েছিল, তিনি প্যারিসেই আসেননি। প্রথম অবস্থায় পাঠানো হবে না বলা হয়। তার পরে ছাড়পত্র দিলেও তিনি রেগেমেগে বলেন, যাব না। বিদেশি কোচ যদি অলিম্পিক্সেই না আসেন, তাঁকে আনলাম কী জন্য?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy