Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Swapna Barman

লকডাউনে ফিকে অলিম্পিকের স্বপ্ন, দেশকে প্রথম সোনা এনে দেওয়া স্বপ্নার সঙ্গী এখন কটূক্তি

যোগ্যতা অর্জনের রাস্তা যত কঠিনই হোক, টোকিয়ো অলিম্পিক্সে নামার জন্য সেরা চেষ্টা করার প্রতিশ্রুতি দিলেন স্বপ্না বর্মন।

তেরঙায় উজ্জ্বল স্বপ্না। ছবি: পিটিআই।

তেরঙায় উজ্জ্বল স্বপ্না। ছবি: পিটিআই।

সৌরাংশু দেবনাথ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২০ ১৪:৩৪
Share: Save:

এশিয়াডের সোনা নাকি কিনে আনা! লকডাউনের উত্তরবঙ্গে এটাই শুনতে হয়েছে দেশের অন্যতম সেরা অ্যাথলিট স্বপ্না বর্মনকে।

দু’বছর আগে এশিয়ান গেমসের হেপ্টাথলনে দাঁতের অসহ্য ব্যথা উপেক্ষা করে সোনা ছিনিয়ে এনেছিলেন জলপাইগুড়ির রাজবংশী পরিবারের এই মেয়ে। জাকার্তায় তুলে ধরেছিলেন তেরঙা। কিন্তু, পাতকাটার ঘোষপাড়ায় নিজের এলাকাতেই শুনতে হচ্ছে কটূক্তি, সহ্য করতে হচ্ছে অপমান। আর এটাই হজম হচ্ছে না। দেশের হয়ে গৌরব আনার পর এটাই কি প্রাপ্য, প্রশ্ন করছেন নিজেকেই।

আনন্দবাজার ডিজিটালকে সোনার মেয়ে বললেন, “আমাকে এখানে তো অনেকে এটাও বলেছে যে, এ সব মেডেল-ফেডেল তো কিনেও আনা যায়! ভাবা যায়!” খানিকটা হাসিই ভেসে এল। তবে তা যে যন্ত্রণার, সেটা বোঝা গেল পরের কথায়, “আমি শুধু ভাবলাম, এগুলোও নাকি কেনা যায়। এতই সোজা! আদৌও আমি কলকাতায় প্র্যাকটিস করছি কিনা, সেটা নিয়েও বলছে কেউ কেউ। আমি তাঁদের নাম জানাতে চাইছি না। কিন্তু এগুলো বলা হচ্ছে। এই কথাটা কত দূর পর্যন্ত যেতে পারো, আপনারাই ভাবুন।”

আরও পড়ুন: ‘এই ইনিংস কোহালি খেললে সবাই প্রশংসা করত’, বলছেন বাবরে মুগ্ধ নাসের হুসেন​

কিন্তু, হঠাৎ কী হল যে স্বপ্নাকে ট্র্যাকের বাইরের লড়াই লড়তে হচ্ছে? কেনই বা পাল্টে গেল তার চারপাশের আবহ? জানা গেল, তাঁর বিরুদ্ধে কাঠ মজুতের অভিযোগ উঠেছিল। বন দফতরের তরফ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নোটিসও দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, ওই মজুত কাঠের কোনও রসিদ দেখাতে পারেনি স্বপ্নার পরিবার। যা নিয়ে উত্তপ্ত হয়েছিল পরিস্থিতি। এখন যা মিটে গিয়েছে। ঠিক কী হয়েছিল? স্বপ্না বর্মন বললেন, “না, ওটা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। ছেড়ে দিন।”

তবে ছাড়তে চাইলেও কি আর ছাড়া যায়। পরের মুহূর্তেই বেরিয়ে এল যন্ত্রণা। বললেন, “আমি তো ছোটবেলায় বাড়ি ছেড়েছি। প্র্যাকটিসের জন্য বাইরেই থাকতে হত। এখন বাড়িতে লকডাউনের জন্য থাকতে বাধ্য হচ্ছি। বুঝতে পারছি অনেক কিছু। কে আমার ভাল চাইছে, কে চাইছে না, সব দেখছি। বাড়ি থেকে বের হলেই বিভিন্ন মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। আমি বাড়ি বানাচ্ছি, তাতেও সমস্যা। হয়তো সেটাই সহ্য করতে পারছেন না অনেকে। আগে সবাই উপহাস করত। আমরা খুব গরিব ছিলাম। সাফল্য পাচ্ছি, পরিস্থিতি ফিরেছে, বাড়ি করছি, যা মেনে নেওয়া মুশকিল হয়ে উঠছে। না হলে এটা কেউ বলতে পারে যে, এশিয়ান গেমসের মেডেল কিনতে পাওয়া যায়!”

স্বপ্নার বাবা রিকশা চালাতেন। তিনি স্ট্রোকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায় মা চা-বাগানে কাজ করে চালাতেন সংসার। অ্যাথলিট হয়ে ওঠার পথে পেরতে হয়েছে অজস্র বাধা। আর্থিক সমস্যা বার বার সামনে ছুড়ে দিয়েছে চ্যালেঞ্জ। তা পার করে এশিয়াডের হেপ্টাথলন ইভেন্টে প্রথম ভারতীয় হিসেবে জিতেছেন সোনা। গড়েছেন নজির।

ছাত্রীর সমস্যার পিছনে মনস্তাত্ত্বিক কারণ দেখছেন কোচ সুভাষ সরকার। বললেন, “ওকে এ ভাবে নিজের এলাকায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে, এটা খুব দুর্ভাগ্যের। এটা আসলে লোকের ঈর্ষা। চাল-চুলোহীন একটা বাড়ি থেকে উঠে এসেছে। সেখান থেকে বাড়ি করতে চলেছে, এতেই হিংসা। একটা ক্রীড়াবিদকে কী ভাবে এগিয়ে যেতে দিতে হয়, কী ভাবে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে হয়, সে সবের বালাই নেই। যত রকম ভাবে পিছনে টেনে ধরার চেষ্টা, আটকে রাখার ইচ্ছা। এতে মানসিক সমস্যা তৈরি হয়। ভাঙাচোরা মন নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সহজ নয়। তবে এ সব জীবনের অঙ্গ, সেটাই বলেছি ওকে।”

এ ভাবেই সব প্রতিকূলতা টপকে গিয়েছেন স্বপ্না। ছবি: এপি।

মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে বাড়ি ফিরেছিলেন স্বপ্না। পরিকল্পনা ছিল দিন সাতেক থেকে কলকাতায় আসার। পুরো পৃথিবীই যে বদলে যাবে আচমকা, টের পাওয়ার কথা ছিল না। করোনাভাইরাসের দাপটে গৃহবন্দি কয়েক মাসে উপলব্ধি হল যে, বদলেছে তাঁকে ঘিরে আবেগও। যেখানে একদা সংবর্ধনা সঙ্গী হত, সেই নিজের পাড়াতেও জুটছে টিপ্পনী, মোকাবিলা করতে হচ্ছে সিলেবাসের বাইরের সব সমস্যার।

সব কিছু ঝেড়ে ফেলে কলকাতা ফিরে সাইয়ে অনুশীলনে নামার ইচ্ছা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি এখনও। অগত্যা, বাড়ির উঠোনেই চলছে প্রস্ততি। যা অবশ্য অনেক গালভরা শব্দ। আসলে উঠোনে ঘণ্টা দেড়েক ফ্রি-হ্যান্ড করা ছাড়া আর সে ভাবে কিছুই হচ্ছে না। একটু যে দৌড়বেন, সেই সুযোগও নেই। জলপাইগুড়ি শহরেও কোভিডের বাড়বাড়ন্ত যথেষ্ট। ফলে, জিমে যাওয়ার পরিস্থিতিও তৈরি হয়নি এখনও।

১ অক্টোবর থেকে সারা দেশে সাই হোস্টেল চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন স্বপ্নাকে কলকাতায় এনে অনুশীলন শুরুর ইচ্ছা রয়েছে কোচের। বললেন, “ঝুঁকি আছে বলেই এখন কিছু করা যাচ্ছে না। নিজের বাড়ির উঠোনে ছোট জায়গার মধ্যে যেটুকু করা যায়, সেটুকুই করছে স্বপ্না। কলকাতায় জোর করে আগে নিয়ে এসে অনুশীলন শুরু করলে যদি হিতে বিপরীত হয়, তখন তো কোয়রান্টিনে চলে যেতে হবে। তাই ইচ্ছা থাকলেও কিছু করা যায়নি।”

আগামী বছরের মার্চ থেকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডে প্রতিযোগিতা শুরুর আশা করছেন কোচ সুভাষ সরকার। সূচিতে পর পর ফেডারেশন কাপ, আন্তঃরাজ্য প্রতিযোগিতা রয়েছে। জুনে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ হবে চিনের হ্যাংঝোউতে। ২০২২ সালে ওখানেই বসবে এশিয়াডের আসর।

আরও পড়ুন: আইপিএল টসের সময় ইলেকট্রনিক টিমলিস্ট আসছে

এশিয়াড থেকে ফেরার পর ডায়েরিতে টোকিয়ো অলিম্পিক্স স্বপ্নের কথা লিখেছিলেন সোনাজয়ী। চেয়েছিলেন টোকিয়ো অলিম্পক্সকে পাখির চোখ করতে। বছর খানেক পিছিয়ে গেলেও টোকিয়োর রাস্তা অবশ্য দুর্গমই দেখাচ্ছে। স্বপ্না বললেন, “অলিম্পিকের যোগ্যতা অর্জনের জন্য লাগবে ৬৪২০ পয়েন্ট। জানি না কী হবে। আমি চেষ্টা করব। সেরাটাই দেওয়ার চেষ্টা করব।” স্বপ্নার সেরা পয়েন্ট ৬০২৬। ফলে, উন্নতি করতে হবে অনেকটাই। কোচও বাস্তবে চোখ রাখতে চান। বললেন, “অনেকটাই বেড়েছে যোগ্যতার মান। একসময় ৫৯০০ ছিল, তার পর ৬১০০ ছিল। এখন বাড়তে বাড়তে ৬৪২০। চেষ্টা করবে স্বপ্না। আপাতত অলিম্পিকের কথা মাথা থেকে বাদ দিয়ে এগোতে চাইছি। এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ রয়েছে।”

প্রিয় ছাত্রীর কাছে কোচের প্রত্যাশা কতটা? কোভিড অতিমারি তো পথে কাঁটাই বিছিয়ে দিল। উত্তর এল, “মুশকিল হল, ওখানে কার্যত কিছুই করতে পারছে না। এতগুলো মাস বসে রয়েছে। তবে ও তো প্রশিক্ষিত অ্যাথলিট। খুব বেশি পিছিয়ে পড়ার কথা নয়। কয়েক মাস পরিশ্রম করলে ঠিক ছন্দে ফিরবে। টেকনিক তো জানাই। শুধু ফিটনেস লেভেলটা বাড়াতে হবে। মার্চে পটিয়ালায় ফেডারেশন কাপ রয়েছে। দেখি, কেমন করে।”

এক সময় পিঠের ব্যথা ভোগাচ্ছিল। অস্ত্রোপচার করতে হবে কি না, ভাবনা চলছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যথা মালুম হচ্ছে কম। বললেন, “চোটটা কোন পর্যায়ে আছে, তা বুঝতে পারছি না। এখন রিহ্যাবের ট্রেনিংটাই করছি। রিহ্যাবের ট্রেনিং করতে ভালওবাসি। কোমরের ট্রেনিংগুলো করতে সমস্যা হচ্ছে না। ব্যথা অনুভব করছি না।”

কোমরে নয়, ব্যথা আসলে অন্য। এশিয়াডের পদক নিয়ে তাচ্ছিল্য যে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না স্বপ্না!

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy