৩৬ রানেই শেষ: অ্যাডিলেডে শনিবার বিরাট কোহালি। রয়টার্স।
অনেকে ভাবতে পারেন, আমি বোধ হয় শাপমোচনের আনন্দে আছি। কারণ, ছেচল্লিশ বছর আগে লর্ডসের সেই অভিশপ্ত ৪২ অলআউটের দলের খলনায়কদের মধ্যে আমিও যে ছিলাম!
কিন্তু শাপমুক্তির সুখানুভূতি একেবারেই নেই। আমি বরং ভীষণই হতাশ যে, বিদেশের মাঠে একটা নিশ্চিত ভাবে জেতা টেস্ট ম্যাচ নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে ভারতীয় দল তুলে দিয়ে এল অস্ট্রেলিয়ার হাতে। খেলায় হার-জিত আছে। খারাপ দিন যেতে পারে। সর্বনিম্ন রানের নজিরের তালিকায় যদি চোখ বোলান, দেখতে পাবেন সব দেশই কোনও না কোনও সময়ে এ রকম অল্প রানে অলআউট হয়েছে। যেটা মেনে নেওয়া যায় না, তা হল কোনও রকম তাগিদ না-দেখানো। শনিবারের অ্যাডিলেড-বিপর্যয়ে ইচ্ছাশক্তিটাই দেখিনি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে।
আমাদের সেই সময়ের দলের সঙ্গে এখনকার ছেলেদের কোনও তুলনা চলে? কত রকম সুযোগ সুবিধা পায় এখন ওরা। আমাদের দলে কোচ পর্যন্ত থাকত না। ম্যানেজার থাকতেন কোনও প্রাক্তন ক্রিকেটার। তিনিই সব কিছু সামলাতেন। এখন দেখি দলে যত জন ক্রিকেটার, প্রায় তত জন কোচ ঘুরছে। সব বিভাগেরই বিশেষজ্ঞ রয়েছে। ভিডিয়ো বিশ্লেষক থেকে ডাক্তার, ফিজিয়ো, ট্রেনার কিছু বাদ নেই। তাতেও টেকনিক্যাল দিকটা রীতিমতো উদ্বেগে ফেলার মতো।
ব্যাটিংয়ের প্রধান ব্যাকরণটাই তো হচ্ছে বলের লাইনে এসে খেলা। ব্যাটিংয়ে একটা কথা আছে ‘ওয়ান-টু-থ্রি মুভমেন্ট’। মানে প্রথমে পিছনের পায়ে ‘শাফল’ করে অফস্টাম্পকে আড়াল করব, তার পরে ফরোয়ার্ড আসব এবং শেষে লাইনে এসে বলটাকে খেলার চেষ্টা করব অথবা ছাড়ব। বিশেষ করে বিদেশের মাঠে এটাই ব্যাটিং ম্যানুয়াল। সুনীল গাওস্কর এই ব্যাকরণ মেনেই সব মাঠে বিশ্বত্রাস সব বোলিংয়ের বিরুদ্ধে রান করেছে।
এই টিমে একমাত্র বিরাট কোহালি ছাড়া আর কাউকে আমি ‘ওয়ান-টু-থ্রি মুভমেন্ট’ করতে দেখি না। প্রত্যেকেই দেখি সোজাসুজি ফরোয়ার্ড এসে বলটা খেলার চেষ্টা করে। তার পরে রাস্তা হারিয়ে ছেলেমানুষের মতো ব্যাট বাড়িয়ে দিয়ে উইকেটের পিছনে আউট হয়। এই ইনিংসেই যেমন প্রথম সাত ব্যাটসম্যানের মধ্যে পাঁচ জন উইকেটের পিছনে আউট হয়েছে। ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কোনও তাগিদ দেখিনি, হোমওয়ার্ক দেখিনি, দায়বদ্ধতা দেখিনি। লড়াই করে হারলে কিছু বলার থাকে না। ওরা আত্মসমর্পণ করল। সেটাই বেশি হতাশ করেছে।
যশপ্রীত বুমরাকেই বা নাইটওয়াচম্যান হিসেবে পাঠাব কেন? দলে তো অশ্বিন রয়েছে। যে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ওপেন করেছে। টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি আছে। সকালের শুরুতেই বুমরাকে তুলে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া রোলার চালাতে শুরু করে দিল। এটা টেস্ট ক্রিকেট। কোনও উইকেটই সহজে দেওয়া উচিত নয়।
চেতেশ্বর পুজারাকেও মনে করিয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে যে, ব্যাটিংটা শুধু আঠার মতো ক্রিজে সেঁটে থাকার জন্য নয়। একটা দারুণ বোলিং স্পেলে বাউন্ডারি পাওয়া কঠিন হতে পারে। এ দিন যেমন অস্ট্রেলীয় পেসারেরা, বিশেষ করে জশ হেজ্লউড আর প্যাট কামিন্স দুর্দান্ত লাইন-লেংথে বল করছিল। সেই সময়টা ঝুঁকি না নিয়ে পড়ে থাকো। কিন্তু খুচরো রান নিয়ে অন্তত বোলারের উপরে কিছুটা পাল্টা চাপও তো রাখা দরকার। আমি নিজে বোলার ছিলাম বলে জানি, বোলার চায় ছ’টা বলই একটা ব্যাটসম্যানকে করতে। তা হলে খেলিয়ে তাকে বড়শিতে গাঁথা সহজ। পুজারা ঠিক সেই সুযোগটাই দিচ্ছে বোলারদের।
আমার মতে, পুজারাকে তিন নম্বরে পাঠানো ঠিক হচ্ছে না। তিন নম্বরে আসা উচিত কোহালির। যে ম্যাচটাকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। যে বোলারদের শাসন করতে পারবে, অহেতুক মাথায় চড়িয়ে দেবে না। চার বা পাঁচে নামুক পুজারা। ওপেনিংটা ভাল হচ্ছে না বলে পুজারার মন্থর ব্যাটিং আরও চাপে ফেলে দিচ্ছে। পৃথ্বী শ প্রতিভাবান হতে পারে কিন্তু এই পর্যায়ের জন্য এখনও পুরোপুরি তৈরি নয়। কে এল রাহুলকে দিয়ে ওপেন করানো উচিত। শুভমন গিলের কথাও ভাবা উচিত। প্রস্তুতি ম্যাচে ভাল করেছে। আইপিএলে আমি শুভমনকে দেখেছি। ইনিংসটাকে সাজাতে জানে, যেটা কি না ভাল ব্যাটসম্যানের বড় গুণ। আমার এটাও মনে হয় যে, তিন পেসারে না খেলে দুই স্পিনারে খেলা উচিত। অস্ট্রেলিয়ায় বরাবর আমরা তাই করে সফল হয়েছি। আমি, চন্দ্রশেখর, বেদী, বেঙ্কট একসঙ্গে খেলেছি যে সময়টায় তখন না হয় স্পিনের স্বর্ণযুগ ছিল। এখন ভারত হয়তো পেস বোলিংয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু অ্যাডিলেডে নেথান লায়ন, অশ্বিনদের বল প্রথম থেকে ঘুরেছে। পরের টেস্ট মেলবোর্নে। চন্দ্র ছয় উইকেট নিয়ে একা যেখানে জিতিয়ে দিয়েছিল। হাতে চোট পাওয়ার পরে শামি খেলতে পারবে না। ওর জায়গায় রবীন্দ্র জাডেজাকে খেলাক ভারতীয় দল। রাহুল খেলুক পৃথ্বীর জায়গায়। বিরাটের জায়গায় আসুক শুভমন গিল। উইকেটকিপিংকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ঋদ্ধিমান সাহাকে খেলাব না ব্যাটিং শক্তিশালী করার জন্য ঋষভ পন্থকে আনব, সেটাও ভাবতে হবে। ঋষভ থাকলে কাউন্টার অ্যাটাকও করতে পারবে অস্ট্রেলীয় বোলারদের।
আমাদের সেই ৪২ অলআউটের সফরে দিনে এক পাউন্ড করে পেতাম। আমাদের ছিল ভালবেসে ক্রিকেট খেলা। এখন সবাই পাক্কা পেশাদার। ১৯৭৪-এর সেই সফরে আমাদের দলটাকে নানা বিভেদ, বিতর্ক তাড়া করছিল। প্রথম একাদশ নির্বাচন নিয়ে তুমুল ঝামেলা চলছিল। অন্তর্কলহের প্রভাব পড়ছিল মাঠের ফলাফলে। লর্ডসে প্রথম ইনিংসে আমরা তিনশোর উপরে তুলেছিলাম (৩০২)। দ্বিতীয় ইনিংসে সেই কুখ্যাত ৪২ অলআউট। ড্রেসিংরুমে সে দিন পিন পড়লেও শব্দ শোনা যেত। নিশ্চয়ই বিরাটদেরও সে রকমই অবস্থা হয়েছিল শনিবার।
দেশে ফেরার পরে বোর্ড প্রধান চিদম্বরম আমাদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নানা প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। দুর্দান্ত প্রত্যাঘাত করে সিরিজে ফিরতে না পারলে এই দলটার সামনেও অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন হাজির হতে পারে। সর্বনিম্ন স্কোরের কলঙ্ক নিয়ে আমাদের কাটাতে হয়েছে ছেচল্লিশ বছর। বিরাটদের মাথার উপরে কত দিন এই অভিশপ্ত ৩৬ ঘুরতে থাকে, কে জানে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy